কেন সংবাদমাধ্যমগুলির বিরুদ্ধে এফআইআর-এর নির্দেশ দিল জম্মু ও কাশ্মীর আদালত?

Jammu and Kashmir Court Order : রিপাবলিক ওয়ার্ল্ড ইকবালকে "পুলওয়ামা-সহ বড় বড় সন্ত্রাসী হামলার সাথে জড়িত শীর্ষ কমান্ডার" বলে দাবি করেছিল। সিএনএন, নিউজ১৮ তাঁকে "লস্কর-ই-তৈয়বার একজন সন্ত্রাসী" বলে দাবি করে।

সংখ্যালঘু শিক্ষককে 'সন্ত্রাসী' বলে দাবি করেছিল জি নিউজ, নিউজ১৮ এবং অন্যান্য কিছু সংবাদমাধ্যম। তাদের সম্পাদক ও রিপোর্টারদের বিরুদ্ধে এফআইআর-এর নির্দেশ দিয়েছে জম্মু ও কাশ্মীর আদালত। সংবাদমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে কী অভিযোগ?

ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের পুঞ্চ শহরের বাসিন্দা মুহাম্মদ ইকবাল ৭ মে সকালে নিহত হন। এর ঠিক আগের দিনই পহেলগাঁও হামলার প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছিল ভারত। মুহাম্মদ ইকবালের মৃত্যুর পর তাঁকে 'পাকিস্তানি সন্ত্রাসী' হিসেবে দাবি করেছিল কিছু সংবাদমাধ্যম। ২৮ জুন সাব-জজ শফিক আহমেদের আদালত পর্যবেক্ষণ করেছে যে, পাকিস্তান এবং পাক-অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসী ঘাঁটির বিরুদ্ধে ভারত 'অপারেশন সিন্দুর' শুরুর পর জম্মু ও কাশ্মীরের তীব্র উত্তেজনার সময় কিছু সংবাদমাধ্যম "দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রতিবেদন" করেছে।

নিহত ওই শিক্ষককে 'সন্ত্রাসী' বলে দাবি করে জি নিউজ, এবিপি এবং নিউজ ১৮ সহ আরও কয়েকটি চ্যানেল। একটি চ্যানেল দাবি করেছিল, ওই শিক্ষক পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে "সন্ত্রাসী শিবিরের ওপরে ভারতীয় হামলায়" নিহত হয়েছেন এবং তিনি পাকিস্তান-ভিত্তিক 'সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার একজন সন্ত্রাসী'। আগেই বিবিসি এ বিষয়ে টিভি চ্যানেলগুলির প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে যোগাযোগ করেছিল, কিন্তু কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

নিহত শিক্ষকের ভাই ফারুক আহমেদ বিবিসি-কে বলেছেন, জম্মু ও কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলার বৃহত্তম মাদ্রাসা জামিয়া জিয়া-উল-উলূমে শিক্ষক ছিলেন ক্বারী মোহাম্মদ ইকবাল। এখানে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা করতেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল তাঁকে সন্ত্রাসী বলে মিথ্যা দাবি করে।

আরও পড়ুন-ইংরেজি চায়নি বামেরা, চাইছেন না অমিত শাহও! কোথায় মিল, কোথায় ফারাক?

রিপাবলিক ওয়ার্ল্ড ইকবালকে "পুলওয়ামা-সহ বড় বড় সন্ত্রাসী হামলার সাথে জড়িত শীর্ষ কমান্ডার" বলে দাবি করেছিল। সিএনএন, নিউজ১৮ তাঁকে "লস্কর-ই-তৈয়বার একজন সন্ত্রাসী" বলে দাবি করে। এবং জি নিউজ দাবি করে "অপারেশন সিন্দুর"-এর সময় নিহত "সন্ত্রাসী" বলে দাবি করে। পুঞ্চের বাসিন্দা যাঁরা ইকবালকে জানতেন তাঁরা এই মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। স্থানীয় পুলিশ একটি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, তিনি সন্ত্রাসী নন, এই দাবি অসত্য। বিবৃতিতে চ্যানেলগুলিকে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও সতর্কবার্তা দেওয়া ছিল ওই বিবৃতিতে। এখানে বলে রাখার, নিউজ ১৮ ছাড়া আর কোনো চ্যানেলই ক্ষমা চায়নি।

পাহেলগাঁও হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত যত তীব্র হচ্ছিল, পাল্লা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ফেক নিউজের ছড়িয়ে পড়েছিল। যেমন পাকিস্তানের করাচী বন্দর ধ্বংস করে দিয়েছে ভারত, এমন খবরও ছড়িয়ে পড়েছিল। যদিও পরে ভারত সরকার নিজেরাই এই তথ্য ভুয়া বলে জানিয়েছিল।

স্বাধীন সংবাদ পোর্টাল নিউজ লন্ড্রি-র ম্যানেজিং এডিটর মনিষা পাণ্ডে বলছিলেন, "যে মাত্রায় ফেক নিউজ এবং যাচাই না করা তথ্য গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে, তা দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়।" তাঁর কথায়, চ্যানেলগুলি যে দর্শক টানার জন্য উস্কে দেওয়ার মতো খবর করবে, তা প্রত্যাশিত ছিলই। তবে "উগ্র দেশপ্রেম এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন" ভাবে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের মাত্রাহীন সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। অন্তত তিনি আগে কখনও এরকমটা দেখেননি বলেই দাবি করেন।

আদালত জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশকে, ভারতীয় ন্যায় সংহিতা ২০২৩ সালের ধারা ৩৫৩ (২) (জনসাধারণের ক্ষতি), ৩৫৬ (মানহানি) এবং ১৯৬ (১) (কোনো ধর্মীয় পরিচিতির জন্য শত্রু বলে প্রচার) এবং ২০০০ সালের তথ্য প্রযুক্তি আইন, ধারা ৬৬ (কম্পিউটার ব্যবহার করে অসৎ বা প্রতারণামূলক কাজ)-এর অধীনে এফআইআর নথিভুক্ত করতে বলেছে।

আরও পড়ুন-যেভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জোর করে সমুদ্রে নামিয়ে দিল ভারতীয় নৌবাহিনী

পুঞ্চ থানার হাউস অফিসার (এসএইচও)-কে সাত দিনের মধ্যে একটি রিপোর্ট তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংবিধানের ১৯(১)(ক) অনুচ্ছেদের অধীনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও, ১৯(২) অনুচ্ছেদে কিছু বিধিনিষেধও রয়েছে। তার মধ্যে মানহানি, জনসাধারণের মধ্যে শান্তি বজায় রাখা এবং নৈতিকতার মতো বিষয়গুলি রয়েছে।

আদালত তরফে জানানো হয়, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তথ্য যাচাই না করেই একজন মাদ্রাসার বেসামরিক শিক্ষককে 'পাকিস্তানি সন্ত্রাসী' বলে দাবি করার বিষয়টি শুধুমাত্র ভুল বলে মেনে নেওয়া যায় না। আদালত বলেছে, সংবাদমাধ্যম গুলির সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে তাদের প্রতিবেদনগুলি "সঠিক, ন্যায্য এবং যাচাইকৃত" করে তবেই প্রকাশ করার। আরও বলা হয়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশের লাইসেন্স তো দেয়ই না, এই ধরনের ঘটনা সমাজের জন্যও অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই ঘটনা শুধুমাত্র আতঙ্কেরই সৃষ্টি করে না, মৃত ব্যক্তির মর্যাদাকেও অসম্মান করা হয়। ফলত এই ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানায় আদালত। এখন দেখার সত্যিই এই ঘটনার বিচার হয় কিনা।

উল্লেখ্য, আগেও ভারতে বিভিন্ন ঘটনায় ফেক নিউজের বাড়বাড়ন্ত দেখা গিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, কেন দিন দিন এই প্রবণতা বেড়েই চলেছে? কেন এর বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না?

More Articles