মোদীর জন্মদিনে কেন শুভেচ্ছা জানালেন না মোহন ভাগবত?
একদিকে ভাগবত চান মোদী হিন্দুত্বের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করুন। অন্যদিকে ভাগবত বারবার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে মোদী একক আধিপত্য কায়েম করে আরএসএসের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণকে উপেক্ষা করছেন।
সাম্প্রতিক ভারতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের নানা আলোচনায় মাঝে মধ্যেই শোনা যাচ্ছে দেশের দুই ক্ষমতাবান ব্যক্তিত্বের পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের কথা। একজন দেশের শাসন ক্ষমতার সর্বোচ্চ পদে আসীন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, আর একজন দেশের প্রধান শাসক দল বিজেপির প্রধান আদর্শিক কেন্দ্র আরএসএস-এর প্রধান মোহন ভাগবত। যদিও, ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় নরেন্দ্র মোদী ও মোহন ভাগবতের সম্পর্ককে আলাদা করে দেখা যায় না। তবুও তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে প্রায়শই চায়ের কাপে তুফান উঠছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী, যিনি ভারতীয় জনতা পার্টির মুখ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত, যিনি সরাসরি কোনো সাংবিধানিক পদে না থাকলেও সংগঠনগত ও আদর্শগত দিক থেকে বিজেপির ওপর ছায়ার মতো প্রভাব বিস্তার করেন। অতীতে দেখা গিয়েছে, এই দুই ব্যক্তিত্বের মধ্যে সম্পর্ক কখনো মধুর, কখনও মতবিরোধ ও দ্বন্দ্বপূর্ণ —কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল। মোদীর জন্মদিনে সমাজমাধ্যম ব্যবহার করে শুভেচ্ছা পাঠানো থেকে বিরত থাকা কি তাতে নতুন কোনো মাত্রা?
আরএসএস দীর্ঘদিন ধরে বিজেপিকে রাজনৈতিক শাখা হিসেবে ব্যবহার করেছে। বিজেপির সাফল্য মানে আরএসএস-এর সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ। নরেন্দ্র মোদী নিজেও গুজরাট রাজনীতিতে পা রেখেছেন আরএসএস-এর একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবেই। নরেন্দ্র মোদী বিজেপির মুখ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হলেও তিনি আরএসএস-এর প্রাক্তন কর্মী এবং দীর্ঘদিনের আদর্শিক সন্তান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই তিনি ধীরে ধীরে একটি স্বাধীন শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। আরএসএস-এর ঐতিহ্যবাহী ‘কালেক্টিভ লিডারশিপ’ বা সমষ্টিগত নেতৃত্বের মডেল ভেঙে তিনি দল ও সরকারের প্রায় সমস্ত সিদ্ধান্তকে নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করেছেন। এতে আরএসএস কখনও খুশি, কখনও অস্বস্তিতে।
আরও পড়ুন- বিশ্বজুড়ে ভোট কারচুপি! গণতন্ত্র টিকবে?
মোহন ভাগবতের সঙ্গে মোদীর সম্পর্কের দ্বৈত চরিত্র এখানেই স্পষ্ট। একদিকে ভাগবত চান মোদী হিন্দুত্বের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করুন—ধর্মনিরপেক্ষতাকে ক্রমশ দুর্বল করে, নাগরিকত্ব আইন, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপ, এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আরএসএসের আদর্শ চাপিয়ে দিয়ে। এই দিক থেকে মোদী ভাগবতের উদ্দেশ্যকে এগিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে ভাগবত বারবার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে মোদী একক আধিপত্য কায়েম করে আরএসএসের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণকে উপেক্ষা করছেন। বিভিন্ন সময় ভাগবত প্রকাশ্যে ‘সংঘ সংস্কার’ বা ‘হিন্দুত্বের মানবিক রূপ’ নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে মোদীর একমাত্রিক রাজনৈতিক হিন্দুত্বকে নরম করার চেষ্টা করেছেন।
এখানে লক্ষণীয়, মোদী সবসময় ভাগবতের প্রকাশ্য মন্তব্যকে গুরুত্ব দেন না। বরং তিনি আরএসএসকে ব্যবহার করেন নির্বাচনী শক্তি হিসেবে, কিন্তু রাজনৈতিক নীতিনির্ধারণে নিজের দলীয় কোটারিকেই অগ্রাধিকার দেন। এভাবে মোদী ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আরএসএস-এর ওপর নির্ভরশীল থেকেও স্বাধীন সত্তা গড়ে তুলেছেন।
এখানেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে পারস্পরিক নির্ভরতা ও সন্দেহের দ্বন্দ্ব। মোদী জানেন, আরএসএস ছাড়া তিনি সংঘ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন, বিজেপির নির্বাচনী শক্তি দুর্বল হবে। আবার ভাগবত জানেন, মোদী ছাড়া জাতীয় রাজনীতিতে হিন্দুত্বের আধিপত্য বজায় রাখা সম্ভব নয়। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর বিজেপি ক্ষমতায় টিকে গেলেও আগের মতো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। এর পরপরই ভাগবত প্রকাশ্যে বিজেপির অহংকার ও অতিরিক্ত আত্মতুষ্টির সমালোচনা করেন।
আরও পড়ুন- নেহরু-নৈতিকতার বিসর্জন! ভারতের বিদেশনীতিতে দ্বিচারিতার যে ছায়া
সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, নির্বাচনী প্রচারণায় আরএসএস ক্যাডাররা তেমন সক্রিয় ছিল না। এতে বোঝা যায়, সংঘ–বিজেপির দ্বন্দ্ব মূলত আদর্শিক নয়, বরং নেতৃত্বের ধরন ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণকে ঘিরে।ফলে দুজনেই একে অপরকে সহ্য করছেন, কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাস করেন না।
আরএসএস ও বিজেপির সম্পর্কের ইতিহাস যেমন আদর্শগত ঐক্যের ওপর দাঁড়িয়ে, তেমনই নেতৃত্ব ও ক্ষমতার প্রশ্নে মতবিরোধেপূর্ণ। মোহন ভাগবতের সাম্প্রতিক মন্তব্য পাকিস্তান প্রসঙ্গে বিজেপির অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও চিন ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তাঁর কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা স্পষ্ট। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদীর একক আধিপত্য আরএসএস-কে অস্বস্তিতে ফেলেছে। তবে সম্পর্কের জটিলতা এখানেই শেষ নয়। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর বিজেপি যদিও ক্ষমতায় টিকে গেছে, কিন্তু আগের মতো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন যে ভাগবতের প্রভাব আবার বেড়ে যেতে পারে, কারণ দুর্বল মোদীর সরকারকে সংগঠন ও মতাদর্শের মদত ছাড়া স্থিতিশীল রাখা কঠিন। ভাগবত এই মুহূর্তে মোদীকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করবেন না, তবে তাকে বারবার মনে করিয়ে দেবেন যে ‘দল সরকার চালালেও, আদর্শের নিয়ন্ত্রণ সংঘের হাতে।’
নরেন্দ্র মোদী ও মোহন ভাগবতের সম্পর্ক ভারতের গণতন্ত্রে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের প্রতীক। একজন রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতিমূর্তি, আরেকজন সংগঠন ও মতাদর্শের অদৃশ্য অভিভাবক। তাদের সম্পর্ক যতটা সহযোগিতার, তার সমান বা আরও বেশি সন্দেহ ও দ্বন্দ্বের। এই দ্বন্দ্ব ভবিষ্যতে বিজেপি ও আরএসএস-এর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বড় কোনো সংকট তৈরি করবে কিনা, তা এখনই বলা না গেলেও, এর ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন- অনুপ্রবেশকারীদের উৎখাত: নির্বাচনী রাজনীতির হাতিয়ার?
তবে, আরএসএস ও বিজেপির দীর্ঘ সম্পর্কের ইতিহাসে বহুবার অমিল ঘটেছে। জনতা পার্টি যুগ থেকে লালকৃষ্ণ আদবানি সহ বহু বিজেপি নেতা অভিযোগ করেছেন যে আরএসএস অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ করে। আবার, কেএস সুদর্শন-সহ একাধিক সংঘ প্রধান অতীতে বিজেপির নেতৃত্বের ধরন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, বিশেষত অন্তর্ভুক্তিমূলক সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়া না থাকার অভিযোগে। ২০১৭ সালে পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) আইন নিয়ে আরএসএস ক্ষুদ্র ব্যবসার স্বার্থে সরকারের সমালোচনা করে এবং চাপ প্রয়োগ করে কিছু পরিবর্তন আনতে বাধ্য করে।
ভারতের সমকালীন রাজনীতিকে বোঝার জন্য রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) ও তার রাজনৈতিক শাখা—প্রথমে ভারতীয় জনসংঘ, পরে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)—এর সম্পর্ক একটি অন্যতম কেন্দ্রীয় সূত্র। আরএসএস মূলত হিন্দুত্ববাদের সাংগঠনিক ও আদর্শিক কেন্দ্র, অন্যদিকে বিজেপি সেই আদর্শকে ভোটের রাজনীতির ভাষায় রূপান্তর করেছে। এই সম্পর্ক বহু ক্ষেত্রে সহযোগিতা ও একমুখী অঙ্গীকারের প্রতীক হলেও, ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে—এখানে মতবিরোধ, টানাপোড়েন ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বও সমানভাবে উপস্থিত। কিন্তু বিজেপি দেশের শাসন ক্ষমতায় থাকাকালীন এই টানাপোড়েন বা দ্বন্দ্ব ব্যাপকতা লাভ করবে না। কারণ, এক, আদর্শ। দুই, ক্ষমতার ক্ষীর। আরএসএস প্রধান জানেন, দিল্লির মসনদে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ-রা না থাকলে দিল্লির ঝান্ডেওয়ালায় কেশব কুঞ্জে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের লক্ষ বর্গফুট আয়তনের তিনটি ১২ তলা বিশিষ্ট টাওয়ার, ২৭০টি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা, ১,৩০০ জনেরও বেশি লোকের বসার ক্ষমতা সম্পন্ন তিনটি অত্যাধুনিক অডিটোরিয়াম, গবেষণার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা কিউবিকেল সহ একটি লাইব্রেরি, পাঁচ শয্যা বিশিষ্ট একটি হাসপাতাল, সুন্দরভাবে সাজানো লন এবং একটি হনুমান মন্দির সহ নবনির্মিত সদর দপ্তর সম্ভব হতো না। স্বাভাবিকভাবেই, নরেন্দ্র মোদির জন্মদিনে মোহন ভাগবত শুভেচ্ছা জানালেন না কেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সময় ও বুদ্ধিমত্তা, দুটোরই অপচয়।
লেখকের মতামত সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত
Whatsapp
