রুম ফ্রেশনার, ফ্লোর ক্লিনার কতটা বিপজ্জনক? কেন মেয়েদের বয়ঃসন্ধি শুরু হচ্ছে আগেই?

Early puberty: বেশ কিছু ওষুধ, সাবান, দৈনন্দিন প্রসাধনী, রুম ফ্রেশনার, এমনকী ডিটারজেন্ট বা ফিনাইলেও পাওয়া যেতে পারে এমন রাসায়নিক যা মেয়েদের অকাল বয়ঃসন্ধির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে সারা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে মেয়েদের মধ্যে অকাল বয়ঃসন্ধি বা ‘প্রিকশাস পিউবার্টির’ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ব্যতিক্রমী নয় ভারতও। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান ডেভলপমেন্টের মতে, মেয়েদের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধির স্বাভাবিক সময় আট থেকে তেরো বছর কিন্তু যদি তা আট বছরের আগেই শুরু হয়ে যায়, তাহলে তাকে অকাল বয়ঃসন্ধি বলতে হয়। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯৭০-এর দশক থেকেই মেয়েদের বয়ঃসন্ধির সময় প্রতি দশকে প্রায় তিন মাস করে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ ছেলেদের ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা এতটাও চোখে পড়ার মতো নয়। কেন এই প্রবণতা সারা বিশ্বজুড়ে দেখা যাচ্ছে, তার স্পষ্ট কোনও উত্তর এখনও কারও কাছেই জানা নেই। তবে এর নেপথ্যে যে বেশ কিছু বিষয়ের হাত রয়েছে, তা ধীরে ধীরে টের পাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। এই নিয়ে সাম্প্রতিক একটি গবেষণা চমকে দিয়েছে সারা বিশ্বকে। আমাদের আশেপাশেই ঘুরে বেড়ায়, এরকম ক্ষতিকর রাসায়নিক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সন্দেহ ছিল। কিন্তু কেউই ভাবেননি বেশ কিছু ওষুধ, সাবান, দৈনন্দিন প্রসাধনী, রুম ফ্রেশনার, এমনকী ডিটারজেন্ট বা ফিনাইলেও পাওয়া যেতে পারে এমন রাসায়নিক যা মেয়েদের অকাল বয়ঃসন্ধির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমনই এক রাসায়নিক হচ্ছে মাস্ক অ্যামব্রেট।

আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ এনভায়রনমেন্টাল হেলথ সায়েন্স ও নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির গবেষকদের সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে মাস্ক অ্যামব্রেট মেয়েদের অকাল বয়ঃসন্ধির কারণ হলেও হতে পারে। ‘এন্ডোক্রিনোলজি’ জার্নালে সেই গবেষণা প্রকাশ পেয়েছে সম্প্রতি। প্রসাধন দ্রব্য, বিশেষ করে সুগন্ধি, পাউডার, সাবান, নানা রকম সুগন্ধযুক্ত প্রসাধন, ডিটারজেন্ট, ফ্লোর ক্লিনার, এমনকী রুম ফ্রেশনারে আকছার এটি মেশানো হয়। স্বাভাবিকভাবেই জল ও বাতাসে মিশে পরিবেশকে দূষিত করে এই রাসায়নিক। প্রসাধন
সামগ্রীতে কৃত্রিমভাবে গোলাপ, পিচ, লিচু বা অন্যান্য ফলের গন্ধ আনার জন্য মাস্ক অ্যামব্রেট বহুল ব্যবহৃত। এছাড়াও অ্যামবারের গন্ধ যে প্রসাধনীতে রয়েছে, সেখানেও পাওয়া যাবে এই রাসায়নিক। এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ এনভায়রনমেন্টাল হেলথ সায়েন্সের বিজ্ঞানী নাতালি শ ইনস্ক্রিপ্টকে জানিয়েছেন,

“একজন গর্ভবতী মায়ের রক্ত, অমরার রক্ত এমনকী বুকের দুধেও পাওয়া গেছে মাস্ক অ্যামব্রেট।"

আরও পড়ুন- প্রজননে সক্ষম হবে রোবট, অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখালেন বিজ্ঞানীরা

মেয়েদের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধির শুরু, অর্থাৎ তার স্তনগ্রন্থির বেড়ে ওঠা, মাসিক রজঃচক্রের শুরু, আর তার ধীরে ধীরে জননে সক্ষম হয়ে ওঠা – সবটাই ইস্ট্রোজেন হরমোন সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে। আবার এই হরমোনের ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে ফলিকিউলার স্টিমুলেটিং হরমোন। যাকে আবার নিয়ন্ত্রণ করে গোনাডোট্রপিন রিলিজিং হরমোন। গোনাডোট্রপিন রিলিজিং হরমোন আদতেই নারী ও পুরুষের রিপ্রোডাকটিভ অ্যাক্সিস বা জনন অক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং, এই পুরো বিষয়টাই এদিক-ওদিক হয়ে যাবে যদি গোনাডোট্রপিন রিলিজিং হরমোনের ক্ষরণ ভারসাম্য হারায়। দেখা যাচ্ছে, মাস্ক অ্যামব্রেটের মতো রাসায়নিক মেয়েদের শরীরে অসময়ে গোনাড্রোপিন হরমোন ক্ষরণের সূত্রপাত করতে পারে, আর তাতেই অকালে বয়ঃসন্ধির শিকার হতে পারে একটি বাচ্চা মেয়ে।

আমাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস গ্রন্থি থেকে তৈরি হয় গোনাডোট্রপিন রিলিজিং হরমোন। কীভাবে এবং কখন এই হরমোনের ক্ষরণ শুরু হয়? যখন গোনাডোট্রপিন রিলিজিং হরমোন ক্ষরণের জন্য দায়ী রিসেপ্টরগুলি সক্রিয় হয়, তখনই শুরু হয় এই হরমোনের ক্ষরণ। আমাদের জিন, আমাদের পরিবেশ ঠিক করে দেয় এই রিসেপ্টগুলি কখন সক্রিয় হবে। আরও যদি সহজভাবে বোঝানো হয়, তাহলে একটি মেয়ের বয়ঃসন্ধি কখন হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করে তার জিন, কোন পরিবেশে সে বেড়ে উঠছে, তার শারীরিক অবস্থা কেমন, এই বিষয়গুলি। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, মাস্ক অ্যামব্রেট গোনাডোট্রপিন রিলিজিং হরমোনের রিসেপ্টরগুলিকে সক্রিয় করে। পাশাপাশি সক্রিয় করে এমন কিছু জিনকেও যেগুলি প্রকারান্তরে আবার এই হরমোনের ক্ষরণকে বাড়িয়ে তুলবে। এখানেই শেষ নয় কিন্তু। মাস্ক অ্যামব্রেট আমাদের হাইপোথ্যালামাস অঞ্চলে, অর্থাৎ ঠিক যেখান থেকে গোনাডোট্রপিন রিলিজিং হরমোন তৈরি হয়, সেখানেও বাড়িয়ে তুলেছে এমন নার্ভকোশের সংখ্যা, যারা আরও বেশি করে এই হরমোনের তৈরি হওয়াকে বাড়িয়ে তুলবে।

এই গবেষণা সরাসরি মানুষের শরীরে করে দেখেননি বিজ্ঞানীরা। সরাসরি এই পরীক্ষা মানুষের উপরে করা নীতিবিরুদ্ধও। কাজেই বিজ্ঞানী ও গবেষকরা বেছে নিয়েছেন মানুষের শরীর থেকে পাওয়া কিছু বিশেষ ধরনের কোশ। এছাড়াও তাঁরা বেছে নিয়েছেন জেব্রা ফিশের শরীরের বিশেষ ধরনের কোশ, যেগুলি ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম পরিবেশে বাঁচিয়ে রেখে, মাস্ক অ্যামব্রেট প্রয়োগ করেছেন তাঁরা। মাস্ক অ্যামব্রেট যে বাচ্চা মেয়েদের অকাল বয়ঃসন্ধির কারণ, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া এখনও বাকি। “ভবিষ্যতে আমরা শিশু ও বয়ঃসন্ধির আগের ধাপে থাকা রক্ত পরীক্ষা করে দেখতে চাই, তাদের শরীরে ইতিমধ্যেই মাস্ক অ্যামব্রেট ঢুকে পড়েছে কিনা আর তার কারণে খুদেদের শরীরে কী কী পরিবর্তন আসছে,” জানাচ্ছেন ডঃ শ। এর পাশাপাশি সরাসরি ইঁদুরের শরীরে এই রাসায়নিক প্রবেশ করিয়ে দেখা হবে। “যাতে আমরা বুঝতে পারি অল্পবয়সে, অল্প পরিমাণে এবং ধারাবাহিকভাবে মেয়েরা মাস্ক অ্যামব্রেটের সংস্পর্শে এলে কী কী হতে পারে”, জানালেন ডঃ শ।

মাস্ক অ্যামব্রেট ছাড়াও আরও কিছু রাসায়নিক নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন ডঃ শ ও তাঁর সঙ্গীরা। সেই পরীক্ষা থেকে তাঁরা জানাচ্ছেন, বেশ কিছু রাসায়নিক, যেগুলো ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয় সেগুলিরও হাত রয়েছে অকালে বয়ঃসন্ধি শুরুর নেপথ্যে। সেই তালিকায় রয়েছে কার্বাকল, মিথাকোলাইন, অ্যাসিটাইল কোলাইন, বিথ্যানেকোল। গ্লুকোমার চিকিৎসায় একটি অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধ এই কার্বাকল।
এছাড়াও প্রয়োজন পড়ে চোখের অপারেশনের ঠিক আগে। অ্যাস্থমা শনাক্ত করতে যে ব্রিদিং টেস্ট করা হয়, সেই সময় ব্যবহার করা হয় মিথাকোলাইন। অন্যদিকে অ্যাসিটাইলকোলাইনও ব্যবহার করা হয় অতিরিক্ত রক্তচাপ ও হার্টরেট কমাতে। তাছাড়া হৃদপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণ কমাতেও অত্যন্ত জরুরি একটি ওষুধ এটি। কিন্তু যেহেতু, এই রাসায়নিকগুলি অকালে বয়ঃসন্ধির কারণ হতে পারে, তাহলে কতটা ভয় পাওয়া উচিত আমাদের এদের নিয়ে? গবেষক ও বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এই রাসায়নিকগুলির ব্যবহার কেবল হাতেগোনা কিছু মানুষের উপর হয়। পরিবেশে লাগামছাড়াভাবে এগুলি পাওয়া যায় না। কাজেই অন্তত এদের নিয়ে আশঙ্কার কিছু নেই।

আরও পড়ুন- মা হওয়ার ক্ষমতা কাড়ছে লিপস্টিক, নেলপালিশ! প্রসাধনীর যে ভয়াবহ দিকটি অজানা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দীর্ঘদিন আগেই মাস্ক অ্যামব্রেটকে ক্ষতিকর রাসায়নিক হিসেবে শনাক্ত করেছিল। তাছাড়া এর আগে বেশ কিছু গবেষণায় বিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেছিলেন যে, এই রাসায়নিক আমাদের হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। কিন্তু তখনও স্পষ্ট ছিল না যে এই রাসায়নিক অকাল বয়ঃসন্ধির কারণ হয়েও দাঁড়াতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও কানাডা এবং ইওরোপে প্রসাধন সামগ্রীতে মাস্ক অ্যামব্রেটের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও, সারা পৃথিবীজুড়ে নানারকম দৈনন্দিন জিনিসে এর ব্যবহার বহুল।

মাস্ক অ্যামব্রেট যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করার দরুণ এই রাসায়নিক পরিবেশে আকছার মেলে। কাজেই অন্যান্য মানুষের পাশাপাশি, কোনও অল্পবয়সি মেয়ের এই রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসা অসম্ভব কিছু নয়। জার্নাল অফ পেডিয়াট্রিক অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট গাইনিকোলজিতে ইউনিভার্সিটি অফ সিনসিনাটির বিজ্ঞানীদের ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, মেয়েদের অকাল বয়ঃসন্ধি নানারকম শারীরিক সমস্যা ডেকে আনতে পারে। যার মধ্যে কার্ডিওমেটাবলিক অসুখ, স্থূলতা, ডায়বেটিস, ইশ্চেমিক হার্ট ডিজিজ, ক্যান্সার, বিশেষ করে স্তন ক্যান্সারের অন্যতম। এর পাশাপাশি মানসিক অসুখের একটি কারণও অকাল বয়ঃসন্ধি। ডঃ শ ইনস্ক্রিপ্টকে জানিয়েছেন, “এই ধরনের রাসায়নিক নিয়ে আমাদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।"

More Articles