নায়ক-নায়িকা নয়, তাঁদের জুটির আকর্ষণে হল ভরাত দর্শক! কেন ভেঙেছিল সেলিম-জাভেদ জুটি?
Selim-Javed Duo: কেন ভেঙেছিল এই ঐতিহাসিক জুটি?
পর্দায় নায়ক-নায়িকাদের জুটির থেকে কোনও অংশে কম হিট ছিল না পর্দার পিছনের এই চিত্রনাট্যকার জুটি। তাঁরা বহু অংশে বাড়িয়ে দিয়েছিল হিন্দি ছবির চিত্রনাট্যকারদের গ্রহণযোগ্যতার পরিসর। একটা সময় ছিল, যখন চিত্রনাট্যকারদের নিয়ে তেমন কোনও আলোচনাই হতো না, এমনকী, পোস্টারে নামও উল্লেখ করা হতো না৷ বলিউডের এই ধারা বদলে দেওয়ার অন্যতম কারিগর ছিলেন চিত্রনাট্যকার সেলিম খান ও জাভেদ আখতার। পারিশ্রমিক নেওয়ার পাশাপাশি তাঁরা দাবি তোলেন, নাম উল্লেখ করে যথাযথ ঋণস্বীকার করতে হবে, যথারীতি সেই দাবি মনে নেন প্রোডিউসাররা। একটা সময় তো সিনেমার নায়কদের থেকেও বেশি পারিশ্রমিক নিতেন সেলিম-জাভেদ। পোস্টারে এই জুটির নামই যথেষ্ট ছিল হলে দর্শকদের টেনে আনার জন্য। চিত্রনাট্যকারদের জন্য প্রকৃত অনুপ্রেরণা ছিলেন এই জুটি।
বলিউডে সেলিম এবং জাভেদ উভয়েই একটু অন্যভাবে কেরিয়ার শুরু করেছিলেন৷ সুদর্শন সেলিম খান শুরু করেছিলেন অভিনয় দিয়ে। ‘তিসরি মঞ্জিল’, ‘সরহদি লুটেরা’, ‘দিওয়ানা’ ছবিতে কাজ করলেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি। এভাবে সাত বছর কেটে গেল। ছয়ের দশক শেষ হয়ে আসছিল, কিন্তু তখনও খুব একটা সফল নন সেলিম। অভিনয়ে অসফল হওয়ার পর ঠিক করলেন, স্ক্রিপ্ট লিখবেন। অন্যদিকে জাভেদ আখতার লেখালিখির পাশাপাশি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করতেন। ছয়ের দশকে মুম্বইয়ে পা রেখেছিলেন গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতার। শুরুটা মোটেই সহজ ছিল না তাঁর কাছে। সারাদিন কাজের সন্ধানে মায়ানগরীর রাজপথে ঘুরতেন। রাত হলে কখনও কোনও বারান্দা, কখনও বা কোনও করিডর, মাঝে মাঝে আবার গাছের তলায় ভিড়ের মধ্যে রাত কাটিয়েছেন তিনি। ১৯৬৯ সালে তাঁরা দু'জনেই এমন একটি কাজ পান, যার ফলে তাঁদের জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। ১৯৬৯ সালে সেলিম খানের সঙ্গে জুটি বাঁধেন জাভেদ। এরপর পরবর্তী ১৬-১৭ বছর একসঙ্গে বলিউডের একের পর এক সুপারহিট ছবির সংলাপ লিখেছিলেন তাঁরা। ক্রমে সেলিম-জাভেদ নামে পরিচিতি পেতে শুরু করেন। ১৯৬৬ সালে এঁদের আলাপ হয় ‘সরহদি লুটেরা’ ছবির সেটে। এই সূত্র ধরে বন্ধুত্ব শুরু হলো। সাতের দশক, জুটি বাঁধলেন সেলিম-জাভেদ। রাজেশ খান্না তাঁর ছবির জন্য ভালো স্ক্রিপ্টরাইটার খুঁজছিলেন৷ সেলিম-জাভেদের হাতে এসে পড়ে ‘হাতি মেরে সাথি’ ছবির চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্ব। এরপর জেপি সিপ্পির প্রোডাকশন হাউস সিপ্পি ফিল্মসে স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে কাজ পেলেন দু'জনে।
সাত এবং আটের দশকে জুটি বেঁধে বহু ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন তাঁরা। 'আন্দাজ', 'ইয়াদোঁ কি বরাত', 'জাঞ্জির', 'শোলে', 'ডন', 'কালা পাত্থর', 'শক্তি', 'সীতা অউর গীতা', 'দিওয়ার', 'মিস্টার ইন্ডিয়া'-র মতো জনপ্রিয় ছবিগুলোর চিত্রনাট্য এই জুটির হাতেই লেখা। কথায় আছে, সব ভালো জিনিসেরই একটি ‘এক্সপায়রি ডেট’ হয়। যথারীতি কালের নিয়মে ভেঙে যায় এই কালজয়ী জুটি। তাঁদের লেখা চিত্রনাট্যে সর্বশেষ ১৯৮৭ সালে নির্মিত ছবি ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’। কিন্তু কী কারণে এই জুটি ভেঙে যায়? এর পিছনেও জড়িয়ে আছে সুপারহিট ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ ছবির ইতিহাস।
শোনা যায়, এই ছবিটির চিত্রনাট্য নিয়ে সেই সময়ের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চনের কাছে প্রথমে গিয়েছিলেন সেলিম-জাভেদ। কিন্তু ছবিটিতে কাজ করতে রাজি হননি অমিতাভ। চিত্রনাট্য অনুযায়ী 'মিস্টার ইন্ডিয়া' এমনই এক চরিত্র, যে অদৃশ্য হতে পারে। ফলে পর্দায় তাঁকে কম 'দেখা' যাবে। অমিতাভ তাঁদেরকে জানান, দর্শক বড় পর্দায় অভিনেতাকে দেখার জন্য আসবেন। তাঁকে যদি বেশিরভাগ সময় পর্দায় দেখাই না যায়, তা হলে তিনি এই ছবিতে অভিনয় করবেন না। অমিতাভের এই মন্তব্যে ক্ষুণ্ণ হন দু'জনেই। তাঁরা দুজনেই ভেবেছিলেন, পর্দায় অমিতাভকে দেখা না গেলেও তাঁর কণ্ঠস্বরই এই ছবির প্রাণ হয়ে উঠবে। অমিতাভ বচ্চন রাজি না হওয়ায় পরবর্তীকালে এই ছবির স্ক্রিপ্ট যায় অনিল কাপুরের কাছে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন শ্রীদেবী এবং অমরেশ পুরী, বাকিটা ইতিহাস।
যাই হোক, এরপর জাভেদ আখতার সিদ্ধান্ত নেন, অমিতাভের সঙ্গে তিনি আর কাজ করবেন না। সেলিম খানও ছিলেন নিরব ভূমিকায়। কিছুদিন পর হোলি উৎসবের পার্টিতে অংশ নিতে অমিতাভের বাড়িতে যান জাভেদ। সেখানে তিনি অমিতাভকে বলেন, সেলিম অমিতাভর সঙ্গে কাজ করতে চান না। এরপর সেলিম-জাভেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। সেলিম অনুমান করেন, জাভেদ হয়তো তাঁর নামেই দোষ দিয়েছেন। এই ভুল বোঝাবুঝির কারণে তিন জনের সম্পর্কে প্রভাব পড়ে। আবার অনেকে মনে করেন, সেলিম খানই নাকি প্রথমে বলেছিলেন যে, তিনি আর অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কাজ করবেন না কোনদিন। তবে প্রত্যেক তরফেই সত্যের নিজস্ব ‘ভার্সন’ আছে।
তবে জুটি কিন্তু তখনও ভাঙেনি। এই পর্যায় থেকেই তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হওয়া শুরু হয়। জাভেদের পরিকল্পনা ছিল যে, তাঁরা ছবির চিত্রনাট্য ও গান লিখে একসঙ্গে পরিচালকদের কাছে নিয়ে যাবেন। ভুল বোঝাবুঝি হওয়ার পর জাভেদ শুধু গান লিখতে চান বলে জানান সেলিমকে। কিন্তু সেলিম জানিয়ে দেন, তিনি গান লেখায় পারদর্শী নন। সেলিমের মনে হয়েছিল, গান লেখার ক্ষেত্রে তাঁর কোনও অবদান নেই। ফলে গান না লিখেও খ্যাতি পাবেন, তা চাইছিলেন না সেলিম।
যদিও এই জুটি ভাঙার পিছনে জাভেদ আখতারকেই অনেকাংশে দোষী করা হয়। সেলিম কখনওই চাননি তাঁদের জুটি ভেঙে যাক। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া সুপারহিট ‘জাঞ্জির’ ছবির চিত্রনাট্য একাই লিখেছিলেন সেলিম খান। কিন্তু সঙ্গে তিনি বন্ধু জাভেদের নাম জুড়ে দিয়েছিলেন। অপরপক্ষে জাভেদ নিজের কর্তৃত্বে অন্য কাউকে ভাগ বসাতে দিতে রাজি হননি। এক সাক্ষাৎকারে সেলিম বলেন, তাঁর সঙ্গে জাভেদের সম্পর্কের শেষ দিনটাও তাঁর মনে রয়েছে। জাভেদ তাঁকে বলেছিলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের এখন থেকে আলাদা ভাবে কাজ করা উচিত।" এরপরে আরেকটি শব্দও খরচ করেননি সেলিম খান। নিঃশব্দে গাড়িতে উঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি। জাভেদ আখতারও নিঃশব্দে ঢুকে যান বাড়িতে। দু'জনেই পিছনে ফিরে দেখলে হয়ত দেখতে পেতেন পড়ে রয়েছে সেলিম-জাভেদ ‘জুটির’ মৃতদেহ।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, কয়েকমাস আগে শোনা গিয়েছিল যে এই কিংবদন্তি চিত্রনাট্যকার জুটি সেলিম খান এবং জাভেদ আখতারের ওপর তৈরি হতে চলেছে একটি তথ্যচিত্র। আর সেই দায়িত্বে রয়েছেন জাভেদ-কন্যা ওরফে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জোয়া আখতার এবং তাঁর টিম। জানা গেছে, ইতিমধ্যেই জোরকদমে এই তথ্যচিত্র তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে, তথ্যচিত্রটির নাম রাখা হয়েছে ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’। এটি প্রযোজনার দায়িত্বে এগিয়ে এসেছেন সলমন খান, ফারহান আখতার এবং জোয়া আখতার। এই প্রথম একসঙ্গে কোনও প্রোজেক্ট-এ হাত মিলিয়ে কাজ করছেন এই ত্রয়ী। সূত্রের খবর, যদি এই তথ্যচিত্র দর্শক দারুণভাবে গ্রহণ করেন, তাহলে ভবিষ্যতে পূর্ণদৈর্ঘ্যের একটি ফিচার ফিল্ম তৈরি করারও ইচ্ছে রয়েছে সলমন-ফারহানদের।