বারবার সুযোগ পেয়েও 'ঐতিহাসিক ভুল', জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হলে অন্যভাবে লেখা হত ভারতের ইতিহাস
Jyoti Basu: জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘ঐতিহাসিক ভুল’ করেছে দল
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন উঁকি দিয়েছিল দিল্লির আনাচ-কানাচে। বিরোধীদের সেই বাড়া ভাতে ছাই দেয় কেন্দ্র। '২১-এর বিধানসভা ভোটে বিজেপির তাবড় তাবড় নেতাদের একাই দুরমুশ করে রাজ্য থেকে বিদায় দিয়েছেন মমতা। তৃতীয়বারের জন্য বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। তারপর রাজনীতির অলিন্দে আগমী লোকসভা ভোটে মমতা 'মোদিবিরোধী মুখ' হয়ে উঠবেন কি না, তা নিয়ে চর্চা শুরু হয়। উনিশের ভোটেও বিজেপিবিরোধী জোট গড়ার চেষ্টা করেছিলেন মমতা। '২৪-এর ভোটের দিকে তাকিয়ে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার কাজ শুরু করেছিল বিরোধী দলগুলি। সেই আশা ফললে স্বাধীনতার ৭৭ বছরে দেশ প্রথম পেত কোনও বাঙালি প্রধানমন্ত্রী। সেই আশা ক্রমশই সোনার পাথারবাটিতে পরিণত হচ্ছে। সিবিআই ও ইডি মমতা সরকারকে দুর্নীতির পাঁকে নিমজ্জিত করেছে। সরকার সেই পাঁক থেকে স্বচ্ছ ইমেজ নিয়ে মুখ তুলে দাঁড়াতে পারছে না। অভিষেককে ধরেও টানাটানি শুরু হয়েছে। ফলে মমতাকে দাবিয়ে দেওয়ার এর থেকে ভালো হাতিয়ার আর কী হতে পারে?
কিন্তু মমতা প্রথম নন, বাঙালি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন আগেও উঁকি দিয়েছিল। একবার নয়, তিন তিন বার হাতে-গরম সুযোগ। যাঁকে কেন্দ্র করে এই স্বপ্নের জাল বুনেছিল বাঙালি, তিনি জ্যোতি বসু।
সাধারণত, আমরা জানি, ১৯৯৬ সালে টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জ্যোতি বসুর সামনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু, দলই তাতে আপত্তি তোলায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসতে পারেননি। একেই জ্যোতি বসু বলেছিলেন 'ঐতিহাসিক ভুল' বা 'হিস্টোরিক ব্লান্ডার'। তাঁর বইয়ে এক প্রাক্তন সিবিআই কর্তা দাবি করেন, ১৯৯৬ সালের আগে আরও দু'বার জ্যোতিবাবুর সামনে এমন সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল। ১৯৯০ এবং ১৯৯১ সালে। আর তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনুরোধ জানান স্বয়ং রাজীব গান্ধী!
আরও পড়ুন: একচিলতে ঘরেই কেটে গেল জীবন, এনার্জিতে আশি বছরের বৃদ্ধ বিমান লজ্জায় ফেলবেন তরুণদেরও
আগে দু’বার প্রস্তাব ফিরিয়েছেন
১৯৮৯ সালে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের নেতৃত্বে কেন্দ্রে সরকার হয়, বাইরে থেকে সমর্থন করেছিল বিজেপি ও বামেরা। পরের বছর, ১৯৯০-এর শেষ দিকে বিজেপি নেতা আদবানি রামমন্দির রথযাত্রা শুরু করেন, দেশজুড়ে দাঙ্গা শুরু হয়, মাসখানেক পর আদবানি বিহারে গ্রেফতার হন। সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ-র সরকার থেকে বিজেপি সমর্থন তুলে নেয়, গরিষ্ঠতা হারিয়ে বিশ্বনাথ প্রতাপ সরকার পড়ে যায়। এহেন ডামাডোলে দেশের হাল ধরার জন্য রাজীব গান্ধী জ্যোতি বসুর কাছে প্রস্তাব পাঠান, এমনটাই জানিয়েছেন প্রাক্তন আমলা অরুণপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, তাঁর লেখা বইয়ে। অরুণবাবু এ-রাজ্যের ডিজিপি, পরে সিবিআই-এর ডিরেক্টর, কেন্দ্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের স্পেশাল সেক্রেটারি, তারও পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্তর উপদেষ্টা হয়েছিলেন। তিনি তাঁর আত্মজীবনী 'Unknown Facets of Rajiv Gandhi, Jyoti Basu, Indrajit Gupta’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, একবার নয়, অল্প সময়ের ব্যবধানে দু’বার এমন প্রস্তাব করা হয়েছিল। ১৯৯০ সালের অক্টোবরে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ-র সরকার পড়ে গেলে কংগ্রেস সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা জানত, কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন সরকার গড়া মুশকিল, প্রায় অসম্ভব। ফলে তারা এমন একজন নেতাকে খুঁজছিল, যাকে দেশের মানুষ শ্রদ্ধা করে। অরুণবাবু জানাচ্ছেন, রাজীব গান্ধীর তালিকায় তিনজনের নাম ছিল, প্রথম জ্যোতি বসু, শেষ জন চন্দ্রশেখর। সেই অনুযায়ী রাজীব গান্ধী বিশ্বস্ত দূত মারফত প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পাঠান জ্যোতি বসুকে। জ্যোতি বসু সব শুনে বলেছিলেন, "এই ব্যাপারে আমি দলে আলোচনা করব।" কিন্তু সিপিএম নেতারা সেই প্রস্তাব মানেননি, পত্রপাঠ তা নাকচ করে দেন। পরিণতিতে কংগ্রেসের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন চন্দ্রশেখর সিংহ। ৭ মাস পরে সামান্য অজুহাতে কংগ্রেস সমর্থন তুলে নেয়, চন্দ্রশেখর সরকার পড়ে যায় ৬ মার্চ, ১৯৯১। রাজীব গান্ধী আবার জ্যোতি বসুকে খবর পাঠান, জানিয়েছেন অরুণপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু এবারও সিপিএম নেতাদের অধিকাংশ বেঁকে বসেন, গোঁড়া মার্কসবাদীরা দেশের বাস্তবতা বুঝতে পারেননি। ফলে সরকার গড়া হয় না, চলে আসে ১৯৯১ সালের লোকসভা ভোট।
১৯৯১ সালে লোকসভা ভোট চলাকালীন রাজীব গান্ধী খুন হয়ে যান। জ্যোতি বসু তাঁর ‘যতদূর মনে পড়ে’ বইয়ে লিখেছেন,
২০ মে (১৯৯১) প্রথম দফার নির্বাচন সব শেষ হবার পরের দিনই রাজীব গান্ধী তামিলনাড়ুর পেরেমবুদুরে খুন হয়ে গেলেন। এলটিটিই জঙ্গিরা ওঁকে যেভাবে হত্যা করল তা এককথায় বীভৎস, ভয়াবহ ও নিন্দার যোগ্য। সারা দেশ শিউরে উঠেছিল ওই ঘটনায়। একজন তরুণ রাজনীতিবিদের এরকম পরিণতি সারা দেশকেই দুঃখিত করেছিল। কিন্তু এর ফলে নির্বাচনের চরিত্র পাল্টে যায় এবং একই নির্বাচনকে দু’টি নির্বাচনে পরিণত করে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে রাজীবের মৃত্যুর ফলে সহানুভূতির ঢেউ কংগ্রেস-আই এর পক্ষে যায়। রাজীব গান্ধী যদি মারা না যেতেন, তাহলে কংগ্রেস (আই) দল ২১৮টি আসন পেত না।
সহানুভূতির হাওয়ায় কংগ্রেসের ভালো ফলের উপর সওয়ার হয়ে আরও কিছু দলের সমর্থন নিশ্চিত করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন নরসিংহ রাও। নরসিংহ রাও নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে পাঁচ বছর সরকার চালান। পাঁচ বছর পরে ১৯৯৬-এর ভোটে কংগ্রেসের ফল খারাপ হলে আবার জ্যোতি বসুর কাছে একই প্রস্তাব আসে।
'৯৬ এর 'ঐতিহাসিক ভুল'
১৯৯৬-এ কোনও দল বা জোট অর্ধেকের বেশি আসন পায়নি। এই অবস্থায় কংগ্রেস-সহ প্রায় সব বিজেপি-বিরোধী শক্তি জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করতে চেয়েছিল। কিন্তু সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটি দু’বার ভোটাভুটি করে সেই প্রস্তাব ভেস্তে দিল। প্রথমবার এই সিদ্ধান্ত জানাতে গেলে বন্ধু দলরা সিপিএমকে পুনর্বিবেচনা করতে বলে। ফলে পরের দিন সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটি আবার বৈঠকে বসে, কিন্তু জ্যোতি বসু হরকিষেন সিংহ সুরজিত-সহ বরিষ্ঠ নেতাদের যুক্তি মেনে সরকারে না যাওয়ার মতই আঁকড়ে থাকেন। কিছুদিন পরে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘ঐতিহাসিক ভুল’ করেছে দল। যাই হোক, বাধ্য হয়ে এইচডি দেবগৌড়াকে প্রধানমন্ত্রী বাছা হলো।
এই সময়েই ঘটে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। শপথ নেওয়ার ঠিক আগে দেবগৌড়া এক চিঠি লেখেন জ্যোতি বসুকে। চিঠিতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে জ্যোতি বসুকে হাল ধরার অনুরোধ করেন। কিন্তু দলে সংখ্যালঘু জ্যোতিবাবু তা নিয়ে অগ্রসর হতে চাননি। এই বিষয়ে বিশদ তথ্য ও দেবগৌড়ার চিঠিটি পাওয়া যায় সুরভি বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'Jyoti Basu– The Authorised Biography’ গ্রন্থে।
২৩ বছর ১৬৫ দিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। জীবদ্দশায় তাঁর রেকর্ড ভাঙতে পারেনি দেশের কোনও মুখ্যমন্ত্রী। জনপ্রিয়তায় তাঁকে পাল্লা দেওয়া ছিল মুশকিল। ১৯৯৬ সালে যুক্তফ্রন্ট যখন সিপিআই(এম) নেতা ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনুরোধ জানায়, তখন তাঁর দলই বিরোধিতা করে। মূল বিরোধিতা করেছিলেন সিপিএম-এর শীর্ষ নেতা প্রকাশ কারাট। তাঁর সেই সিদ্ধান্তকে এখন 'ঐতিহাসিক ভুল' বলে মনে করা হয়। এখনও অনেক সিপিএম নেতা যা নিয়ে আক্ষেপ করেন।
এই বই সম্পর্কে লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও বহিষ্কৃত সিপিএম নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, "আমি জ্যোতিবাবুর 'ঐতিহাসিক ভুল' উক্তির সঙ্গে একমত। ওই ভুল না হলে দেশের ইতিহাস অন্যরকমভাবে লেখা হত। এখন দলটার কী অবস্থা দেখুন। রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।" বইটিতে লেখক সিপিএম নেতাদের 'অবাস্তব', 'অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন' বলে উল্লেখ করেছেন।
বাঙালির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন কি অধরাই থেকে গেল? এর উত্তর এখনই মেলা ভার। কারণ মমতাকে কেন্দ্র করে দিল্লির রাজনীতি আবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দিলেও তা ম্লান হতে সময় লাগেনি। তবে রাজনীতির পাশা কখন কোন দিকে ঘুরবে, বলা মুশকিল।