ভোটের ঠিক আগেই কেন CAA? কোন চাল বিজেপির?
CAA implementation: চার বছর পর কেন কার্যকর হচ্ছে সিএএ আইন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মমতা। তাঁর সাফ কথা, "নির্বাচনের মুখেই এটা করার প্রয়োজন পড়ল তার কারণ, এটা একটা রাজনৈতিক পরিকল্পনা।"
দ্বিতীয়বার শপথ নিয়েই সিএএ কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। বছর চারেক আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন। পাশও হয়ে গিয়েছিল তা লোকসভা ও রাজ্যসভায়। তবে তা কার্যকর হতে হতে সময় লেগে গেল অনেকটাই। অবশেষে সোমবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়ে দেওয়া হল, কার্যকর হচ্ছে সিএএ। লোকসভা ভোটের আর দেরি নেই। ইতিমধ্যেই একাধিক রাজ্যে বিভিন্ন দলের প্রথম বা দ্বিতীয় দফার প্রার্থী তালিকাও প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে। ঠিক এ সময় দেশ জুড়ে কার্যকর হয়ে গেল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ। ভোটের ঠিক আগে আগে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ মোদি সরকারের এই সিদ্ধান্ত। স্বাভাবিক ভাবে উঠেছে প্রশ্ন।
ভোট ঘোষণা হয়ে যেতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। তবে বিজেপি সরকারের তরফে একাধিক বার জানানো হয়েছে, ভোটের আগে যে কোনও ভাবেই তারা সিএএ কার্যকর করবে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বারবার বলেছেন, শীঘ্রই সিএএ চালু হবে দেশে। দিন কয়েক আগে পর্যন্ত বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের মুখেও শোনা গিয়েছে একই কথা। বিরোধীরা সেসব কথা তেমন ভাবে কানে নেয়নি। তবে শেষপর্যন্ত মিলে গিয়েছে সেই আশঙ্কাই। দেশ জুড়ে সোমবার থেকে চালু হয়ে গিয়েছে সিএএ আইন।
২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় কারণে নিপীড়নের জন্য এ দেশে আসা শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ওই দেশগুলি থেকে হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পার্সি এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি সিএএ-তে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও এই আইনে মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্তদের কথা বলা হয়নি। অর্থাৎ ওই ছয় সম্প্রদায় ছাড়া পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান বা অন্য কোনও দেশ থেকে আসা অন্য কোনও সম্প্রদায়ের শরণার্থীকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। কী ভাবে সিএএ থেকে সুবিধা পাবেন পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে আগত শরণার্থীরা? আইন অনুযায়ী, ভিসা বা পাসপোর্টের মতো নথি না থাকলেও ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে বলা হয়েছিল, নাগরিকত্ব পেতে টানা এক বছর ভারতে থাকতে হবে। এ ছাড়াও বিগত ১৪ বছরের মধ্যে ১১ বছর ভারতে থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সংশোধনী আইনে সেই ১১ বছরের সময়কাল কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: নোটবন্দির স্মৃতি উস্কে দেশ জুড়ে চালু সিএএ আইন, কতটা ছাপ পড়বে ভোটবাক্সে?
২০১৯ সালে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসেই মোদী সরকার ঘোষণা করেছিল যে, ভারতে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করা হবে। সেই মতোই সংশোধনী বিল আনে কেন্দ্র সরকার। লোকসভা এবং রাজ্যসভায় পাশ হয়ে যায় সেই বিল। ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিলে সই করেন। যদিও কেন্দ্রের সিএএ মানতে নারাজ বিরোধীরা। সিএএ কার্যকর করা নিয়ে দীর্ঘ দিন কেন্দ্র সরকারের মধ্যেই টালবাহানা চলছে। অন্য দিকে, করোনা পর্বের আগে থেকেই দেশের নানা প্রান্তে সিএএ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। বিজেপি বিরোধী দলগুলিই এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মতো বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলি ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সিএএ কার্যকরের বিরোধী। সিএএ নিয়ে এর আগে কম বিক্ষোভ-আন্দোলন হয়নি। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ (২০১৯)-কে চ্যালেঞ্জ করে একাধিক জনস্বার্থ মামলা হয়েছে দেশের বিভিন্ন আদালতে। ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর সিএএ-র বিরুদ্ধে আর্জির প্রথম শুনানি শুরু হয়েছিল শীর্ষ আদালতে। ওই বছরেরই ১১ ডিসেম্বর সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হওয়ার পর দেশ জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। সারা দেশে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে প্রাণ যায় প্রায় ১০০ জনের। বিজেপি বিরোধী দলগুলিই এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল। ফলে অবিজেপি রাজ্যগুলিতেই এই সিএএ নিয়ে বিরোধিতা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এদিকে সব ঠিক থাকলে মার্চেই ভোট ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। সেক্ষেত্রে রাজ্যগুলির আইনশৃঙ্খলা চলে যাবে কমিশনের হাতেই। ফলে এই পরিস্থিতিতে আন্দোলন বা বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় বাহিনী পৌঁছে গিয়েছে রাজ্যের একাধিক জায়গায়। সেই কারণেই ভোট ঘোষণার আগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হল বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
সিএএ বাতিল আন্দোলনের অন্যতম মুখ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বরাবর সিএএ নিয়ে বিরোধিতা করে আসছেন। তাঁর কথায়, নাগরিকত্ব দেওয়াই যদি কেন্দ্র সরকারের আসল লক্ষ্য হয় তবে নতুন আইনের প্রয়োজন কেন পড়ছে? পাশাপাশি, আইনে মুসলিমদের বাদ দেওয়া নিয়েও আপত্তি তাঁর। মমতার কথায়, এ ভাবেই ‘নাগরিকত্ব’ কেড়ে নেওয়া হবে? বিরোধীদের দাবি, সিএএ ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক নীতি বিরোধী। এই আইনের মাধ্যমে ধর্মের ভিত্তিতে ‘বৈষম্য’ সৃষ্টি করছে। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমারের মতো দেশগুলিকে কেন বাদ দেওয়া হল তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। চার বছর পর কেন কার্যকর হচ্ছে সিএএ আইন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মমতা। তাঁর সাফ কথা, "নির্বাচনের মুখেই এটা করার প্রয়োজন পড়ল তার কারণ, এটা একটা রাজনৈতিক পরিকল্পনা। যে নিয়মটা করা হয়েছে, সেখানে কী বলা হয়েছে। এটা ভোটের আগে মানুষের সঙ্গে ছলনার চেষ্টা, কোনও বৈষম্য মানব না। যদি সিএএ নিয়ে নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়, তাহলে তীব্র প্রতিবাদ করা হবে। সিএএ-র নাম করে ডিটেনশন ক্যাম্প রেখে দেবে, তা হবে না। এটা ছলনা। যারা বাংলায় বসবাস করেন, দেশে বসবাস করেন তাঁরা প্রত্যেকে নাগরিক। সিএএ রাজ্যে লাগু হতে দেব না।"
তবে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করছেন, ইলেক্টোরাল বন্ড কেলেঙ্কারি মামলা নিয়ে বেশ বিপাকে মোদি সরকার। ইতিমধ্যেই ওই প্রকল্পকে বেআইনি বলে ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। এসবিআইয়ের কাছ থেকে ওই ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলির অনুদানের হিসেবও জানাতে বলেছে শীর্ষ আদালত। ভোটের পরে সেই ফলাফল সামনে আনার জন্য কৌশলে আবেদন জানিয়েছিল এসবিআই। তবে লাভ হয়নি। ক্রমেই পরিস্থিতি হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখেই জনগণের মন অন্য দিকে ঘোরাতে চাইছে বিজেপি সরকার, তেমনটাই মনে করছেন অনেকে।
বাংলায় বসবাসকারী মতুয়া সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরেই সিএএ-র দাবিতে সরব। মোদি সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাংলায় মতুয়াদের ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলবে বলেও মনে করছে কেউ কেউ। কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণার পরে পরেই শুভেন্দু অধিকারী টুইটারে মতুয়াদের কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, "মোদির প্রতিশ্রুতি মানে প্রতিশ্রুতি পূরণের গ্যারান্টি"। তাঁর কথায়, "১৯৪৫ সাল থেকে ধর্মীয় কারণে উৎপীড়িত জনগোষ্ঠী; মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রত্যেক ব্যক্তি সমনাগরিকত্বের দাবি তে সোচ্চার হয়েছেন। আজ অপেক্ষার অবসান হল।" ইতিমধ্য়েই তার আঁচ মিলেছে বিভিন্ন জায়গায়। মোদির ঘোষণার পর থেকেই শিলিগুড়ি-সহ একাধিক জায়গায় আনন্দে মেতেছেন মতিুয়া-মানুষজন। শিলিগুড়িতে ইস্টার্ন বাইপাস সংলগ্ন ঠাকুরনগর এলাকায় সন্ধে থেকে মতুয়াদের মধ্যে উৎসবের মেজাজ। নতুন আইন কার্যকর হতেই আনন্দে রাস্তায় নেমে পড়েছেন মতুয়া সমাজের মানুষজন। কেউ ঢাক-ঢোল বাজাচ্ছেন, কেউ কাঁসর বাজাচ্ছেন, কেউ আবার উলুধ্বনি দিয়ে এই আনন্দ-মুহূর্তে সামিল হয়েছেন। অনেকেই জানিয়েছেন, তাঁরা মোদি সরকারের এই সিদ্ধান্ত খুশি। আর এই খুশির ছাপ লোকসভার ভোটবাক্সেও পড়তে চলেছে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
আরও পড়ুন: তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা: বিজেপিকে সুবিধা করে দিতেই দুর্বল প্রার্থী?
মাঝখানে রাজ্যের বেশ কয়েকটি জায়গার বাসিন্দাদের আধার কার্ড নষ্ট হয়ে যায়। সেই ঘটনায় অনেকেই আঁচ করেছিলেন সিএএ চালু হওয়ার আশঙ্কা। আর সেই আশঙ্কাই শেষমেশ মিলে গেল অক্ষরে অক্ষরে। বিতর্কিত সিএএ দিয়ে শেষপর্যন্ত ইলেক্টোরাল বন্ড-কলঙ্ক ধামাচাপা দিতে পারবে বিজেপি সরকার? উল্টে মোদিকে বিপাকে ফেলবে না তো এই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন? গোড়া থেকেই লোকসভা ভোট নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী বিজেপি। তবে ভোটের ঠিক আগে আগে মোদি সরকারের এই সিদ্ধান্ত কি কোনওভাবে বিজেপির অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসকেই জোরালো করে তুলল? একগুচ্ছ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।