ওপেনহাইমারকে 'গোপন চিঠি' পাঠিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু! কী ছিল ওই চিঠিতে?
Robert J Oppenheimer: যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ওপেনহাইমারের সঙ্গে ভাবা দেখা করেন এবং দু'জন ভালো বন্ধু হয়ে ওঠেন।
পরমাণু বোমা তৈরি করেছিলেন। দেশ, বিশ্ব, রাজনীতি, ক্ষমতা, আমাদের বিপন্নতায় এর কী প্রভাব পড়েছিল, তার জন্য আর কোনও ব্যাখ্যার প্রয়োজনই নেই। একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সারা বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়েছিল আসলে কত নড়বড়ে আমাদের বেঁচে থাকা, প্রতিবাদ। ক্রিস্টোফার নোলানের সর্বশেষ চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তুই এই বোমা আর তার আবিষ্কারক রবার্ট জে ওপেনহেইমার। আমেরিকান পদার্থবিদ ওপেনহাইমার ছিলেন 'পরমাণু বোমার জনক'। স্বাভাবিকভাবেই সিনেমাটি মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বজুড়ে গুগল কেঁপে উঠেছে এই বিজ্ঞানীর তথ্যের সার্চে। বিজ্ঞানী ওপেনহাইমারের জীবন নিয়ে নতুন করে ফের আগ্রহ দেখা দিয়েছে যার ফলে নিত্য নতুন বিষয় উঠে আসছে যা এই সময়ের নিরিখে বিচার করতে গিয়ে বদলে যাচ্ছে কূটনৈতিক বোঝাপড়া। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বই দাবি করেছে, ওপেনহাইমারকে ভারতে চলে আসতে বলা হয়েছিল। ভারতবর্ষ চেয়েছিল পাকাপাকিভাবে ওপেনহাইমার এখানেই থেকে যান। এই জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বিজ্ঞানীকে। এমনই দাবি করেছেন লেখক বখতিয়ার কে দাদাভয়। হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার একটি ৭২৩ পৃষ্ঠার জীবনী লিখেছেন তিনি। এই বছরের এপ্রিলে প্রকাশিত হয়েছে সেই বই। বইটির ছত্রে ছত্রে ওপেনহাইমার এবং ভাবার মধ্যেকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উঠে এসেছে।
লেখক ওই বই, অর্থাৎ ‘হোমি জে ভাবা : আ লাইফ’-এ বলেছেন, সম্ভাবনা রয়েছে যে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ওপেনহাইমারের সঙ্গে ভাবা দেখা করেন এবং দু'জন ভালো বন্ধু হয়ে ওঠেন। ভাবা ছিলেন ভারতের পরমাণু প্রকল্পের জনক। প্রায়শই একসঙ্গেই খাওয়াদাওয়া করতেন ওপেনহাইমার ও ভাবা। বিষয়টা খুব একটা আশ্চর্য হওয়ার মতো ছিল না। ওপেনহাইমার ভাবার মতোই একজন অত্যন্ত সংস্কৃতিবান মানুষ ছিলেন। ওপেনহাইমার সংস্কৃত পড়েছিলেন এবং ল্যাটিন আর গ্রিক ভাষাও জানতেন।
আরও পড়ুন- আতঙ্ক বিশ্বজুড়ে! ভয়াবহ পরমাণু যুদ্ধর সম্ভাবনা কতটা জোরালো হচ্ছে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে আমেরিকা তাঁর তৈরি পারমাণবিক বোমা ফেলার পর ওপেনহাইমার এর পরিণতি দেখে স্তব্ধ হয়ে যান। যখন বোমা তৈরি হচ্ছে, এই ভয়াবহ বস্তুটি তৈরির বিষয়ে তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই নৈতিক দ্বিধা দেখা দেয়। বিজ্ঞানকে এভাবে ধ্বংসের কাজে ব্যবহার, তার অভাবনীয় পরিণতি ভাবিয়েছিল বিজ্ঞানীদের। গীতা পড়েছেন ওপেনহাইমার। সহকর্মীদের আশ্বস্ত করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, তাঁরা কেবল নিজেদের কাজটিই করছেন। অস্ত্রটি কীভাবে ব্যবহার করা উচিত সে সম্পর্কে কে কী সিদ্ধান্ত নেবে এর জন্য তাঁরা দায়ী নন। কিন্তু পরমাণু বোমা তৈরির কাজ হয়ে যাওয়ার পর চিন্তা পরিবর্তন করেন ওপেনহাইমার। আরও অন্যান্য অস্ত্র, বিশেষত হাইড্রোজেন বোমা তৈরির বিরুদ্ধে যুক্তি দেখান তিনি। নিজের এই পালটে যাওয়া মতাদর্শের কারণে ওপেনহাইমারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে সরকার। ১৯৫৪ সালে মার্কিন সরকার ওপেনহাইমারের নিরাপত্তা সংক্রান্ত ছাড়পত্র কেড়ে নেয় এবং নীতিগত কোনও সিদ্ধান্তে এরপর আর যুক্ত করা হয়নি বিজ্ঞানীকে। ওপেনহাইমার এবং তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিনের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে বলেও অভিযোগ তোলা হয়।
আরও পড়ুন- স্পাই নাকি প্রেমিক? পারমাণবিক বোমার সূত্র ‘পাচারের অভিযোগে’ মরতে হয়েছিল যাঁদের
এই গোটা ঘটনাটিই জানতেন ভাবা। বইটির লেখক লিখছেন, হোমি ভাবার পীড়াপীড়িতেই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ওপেনহাইমারকে ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে যখন ওপেনহাইমারের নিরাপত্তা কেড়ে নেয় মার্কিন মুলুক তখন সম্ভবত ভাবার হস্তক্ষেপেই জওহরলাল নেহরু তাঁকে একাধিকবার ভারত সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, যদি ওপেনহাইমারের ইচ্ছা হয় তবে পাকাপাকিভাবেই এদেশে চলে এসে থাকতে পারেন তিনি, জানিয়েছিলেন নেহরু। তবে এই প্রস্তাবে সাড়া দেননি ওপেনহাইমার। তিনি মনে করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি না মেলা পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে ঠিক হবে না। তাতে তাঁর বিরুদ্ধেই সন্দেহ আরও বেড়ে যাবে।
লেখিকা নয়নতারা সেহগালও তাঁর বই 'জওহরলাল নেহরু: সিভিলাইজিং আ স্যাভেজ ওয়ার্ল্ড' বইতে লিখছেন, নেহরু তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধের শক্তিগুলির বিরুদ্ধে তৃতীয় বিশ্বের শক্তিগুলিকে একত্রিত করার জন্য জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। লেখিকার মতে, ওপেনহাইমার বাঙালি কবি এবং শিক্ষাবিদ অমিয় চক্রবর্তীর মাধ্যমে একটি গোপন বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন নেহরুকে।
ওপেনহাইমার বিশ্বাস করতেন, আমেরিকা থোরিয়াম পাওয়ার আশায় ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলছে। যদিও থোরিয়াম ইউরেনিয়ামের মতো বোমা তৈরির উৎকৃষ্ট কাঁচামাল না। তবে থোরিয়াম অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং ভারতে মেলে প্রচুর পরিমাণে। এই মুহূর্তে ভারতেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি থোরিয়াম মেলে।
ওপেনহাইমার নিজে নেহরুকে জানাতে চেয়েছিলেন যে, পরমাণু বোমাতে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং মারাত্মক প্রকৃতির কাজ করা হচ্ছে, যে প্রক্রিয়াতে ধাপে ধাপে আমেরিকা ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংসের যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন নেহরুকে এমন বার্তা দিলেন ওপেনহাইমার?
লেখিকার মতে ওপেনহাইমার চেয়েছিলেন, মানবতার নামে ভারতকে তার বর্তমান পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখার জন্য এবং কোনও জাতীয় বা আন্তর্জাতিক চাপের দ্বারা প্রভাবিত না হতে হয়। মজার বিষয় হলো, ১৯৫০-এর দশকে ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কত থোরিয়াম সরবরাহ করেছিল তা জানার জন্য কোনও আইনি রেকর্ড নেই। যদিও ১৯৫০ এবং ১৯৮০-র দশকে আমেরিকার গমের সরবরাহের তথ্য রয়েছে সবটুকু।