স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে নয়! জানেন, হস্তমৈথুন ঠেকাতেই তৈরি হয়েছিল কেলগ'স কর্নফ্লেক্স!

History of Kellogg's Cornflakes: শোনা যায়, তিনি এবং তাঁর স্ত্রী পৃথক ঘরে ঘুমোতেন এবং তাদের বৈবাহিক জীবনে তারা কোনওদিন যৌনতায় লিপ্ত হননি।

মানুষ যবে থেকে স্বাস্থ্য সচেতন হতে শেখার গুরুত্ব বুঝল, প্রাতঃরাশে লুচি-ছোলার ডাল, রুটি-আলুভাজার, ডিম-অমলেটের গুরুত্ব গেল কমে। সকাল সকাল ভাজাভুজি, তেল-ঘি খেলে যে কী কী হতে পারে তা নিয়ে দিস্তে দিস্তে নিবন্ধ কাগজে ছাপা হতে থাকল, মোবাইলে ঘুরতে থাকল, আড্ডাতে আলোচ্য হয়ে উঠল। ঘানির তেল ছাড়া মুখে না রোচা খাঁটি বাঙালি বাড়িও বাজারে গিয়ে তেল মশলাহীন, উপকারী খাবারের খোঁজ করতে থাকল। সেই খোঁজেই ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠল ভুট্টা। তবে কাঁচা ভুট্টা নয়, কর্ন ফ্লেক্স! ভারতে অনেক পরে হলেও বিশ্বে কর্নফ্লেক্সের জনপ্রিয়তা কিন্তু শতাব্দী প্রাচীন। তবে সকালের প্রথম খাবার হিসেবে কিন্তু এই কর্নফ্লেক্সের জন্ম নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত বিষয়, যা শুনে চক্ষু কপাল ছাড়িয়ে মহাকাশে উঠে গেলেও যেতে পারে। কর্নফ্লেক্স আসলে ১৯ শতকের এক ওষুধ। সেই সময় হস্তমৈথুন সম্পর্কিত 'পাপ' দূর করতে এবং বিশুদ্ধ খ্রিস্টান বিশ্বাসের আস্থা ফেরাতেই এই খাবারের জন্ম।

জন হার্ভে কেলগ ১৮৯৮ সালে তাঁর ভাই, ডব্লিউকে কেলগের সঙ্গে মিলে প্রথম কর্ন ফ্লেক্স তৈরি করেছিলেন। আসলে তারা তৈরি করতে চেয়েছিলেন গ্রানোলা, কিন্তু তা তৈরিতে ব্যর্থ হয়ে বানিয়ে ফেলেন ফ্লেক্স! মিশিগানের ব্যাটল ক্রিক স্যানিটারিয়ামে হার্ভে কেলগ কাজ করতেন। সেখানে রোগীদের খাওয়ানোর জন্য এই খাবারটি তৈরি হয়।

১৯ শতকের শুরুতে ফ্রান্সের একটি হস্তমৈথুন বিরোধী পোস্টার

হার্ভে কেলগ ছিলেন পেশায় একজন চিকিত্সক এবং পুষ্টিবিদ। সেভেন্থ-ডে অ্যাডভেন্টিস্ট চার্চের প্রতি তাঁর ভক্তির ছায়া এসে পড়ল তাঁর এই সদ্য আবিষ্কৃত খাবারের উপরেও! কর্ন ফ্লেক্সকে দেখা হতে থাকল এক অদ্ভুত 'পবিত্র' দৃষ্টিতে। ২০ শতকের সূচনাপর্বে কেলগই ছিলেন 'পরিচ্ছন্ন জীবনধারা আন্দোলন'-এর নেতৃত্বস্থানীয় মুখ। এই আন্দোলন মূলত নৈতিকতার উপর জোর দিয়েছিল। জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার সম্পর্ক, স্বাস্থ্যবিধি, পরিচ্ছন্নতা এবং বিশুদ্ধতার গুরুত্বের প্রচার করাই ছিল এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। সেই সময়ে যৌনতাকে দেখা হতো অদ্ভুত এক 'পাপ'নজরে। হার্ভে কেলগও এই নৈতিক বিশুদ্ধতার পথে হেঁটে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যৌনতা এক 'পাপ'। যৌনতার তীব্র বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। শোনা যায়, তিনি এবং তাঁর স্ত্রী পৃথক ঘরে ঘুমোতেন এবং তাদের বৈবাহিক জীবনে তারা কোনওদিন যৌনতায় লিপ্ত হননি। আত্মরতির সাংঘাতিক বিরোধিতা করতেন কেলগ যে কারণে তিনি ছিলেন হস্তমৈথুনের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন- টয়লেট পেপার নয়, এক সময়ে ভুট্টাই ছিল মানুষের শৌচাগারের অন্যতম সঙ্গী

চিকিৎসক কেলগ মানুষের যৌনতার তীব্রতায় এতটাই বিরক্ত হয়েছিলেন যে তিনি যৌনতা, হস্তমৈথুন, 'নোংরা স্বপ্ন’, বেশ্যাবৃত্তি এবং অন্যান্য যৌনতা সম্পর্কে একটি আস্ত বইও লিখে ফেলেছিলেন। তাঁর সেই মূল গ্রন্থ – প্লেইন ফ্যাক্টস ফর ওল্ড অ্যান্ড ইয়াং: এমব্রেসিং দ্য ন্যাচারাল হিস্ট্রি অ্যান্ড হাইজিন অব অর্গানিক লাইফ-এ তিনি কিছু 'টিপস' লিখলেন কীভাবে হস্তমৈথুন থেকে মানুষকে দূরে রাখা যায় এই বিষয়ে। আত্মরতিকে তিনি মনে করতেন 'স্ব-অত্যাচার'। তাই নিজেকে এভাবে অত্যাচার করা থেকে কীভাবে একজন ব্যক্তি বিরত থাকতে পারেন সে সম্পর্কে পরামর্শ দিলেন কেলগ। তাঁর মতে, ব্যায়াম এবং খাদ্যাভ্যাসই নাকি হস্তমৈথুনের মতো ঘটনা থেকে মানুষকে দূরে রাখতে পারে।

ঝাল এবং মশলাদার খাবার ছিল তাঁর নজরে বিষ! তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, সাধারণ খাবারই হস্তমৈথুনের আকাঙ্ক্ষাকে বশ করতে পারে, যেমন তাঁর সদ্য আবিষ্কৃত কর্ন ফ্লেক্স! এবং সেই থেকেই বেচারা কর্ন ফ্লেক্স হয়ে উঠল হস্তমৈথুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের এক সৈনিক!

আরও পড়ুন- যৌনতার খেলনা নয়, উন্মাদনার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো ‘রেক্টাল ডাইলেটর’?

যদিও হস্তমৈথুন বিরোধী প্রাতঃরাশ ছিল শুরুয়াদ মাত্র! কেলগ হস্তমৈথুন প্রতিরোধের কিছু চরমপন্থী পদ্ধতিও লিখেছিলেন। মহিলাদের ক্ষেত্রে 'অস্বাভাবিক উত্তেজনা' রোধ করতে তিনি ক্লিটোরিসে বিশুদ্ধ কার্বলিক অ্যাসিড প্রয়োগের পরামর্শ দেন। তিনি আরও বলেন, হস্তমৈথুন ঠেকাতে সমস্ত অল্প বয়সি ছেলেদের লিঙ্গের উপরের চামড়াটি কেটে দেওয়া উচিত৷ এসব ভয়ানক পরামর্শ একজন চিকিৎসক কীভাবে দিতে পারেন, প্রশ্নটি যদি মাথার মধ্যে কামড়ায়, মাথায় রাখতে হবে সময়টা ১৯ শতক। যৌনতাকে ধর্মের সঙ্গে মিশিয়ে তাতে পাপ-ভয় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল সচেতনভাবেই।

জন হার্ভে কেলগ এসব মারাত্মক যৌনতারোধী কাজের পাশাপাশি অবশ্য রোগের জীবাণু তত্ত্ব নিয়েও বিশাল কাজ করেছিলেন। নির্দিষ্ট মাইক্রোস্কোপিক জীবগুলিই যে নির্দিষ্ট সব রোগের কারণ, তা বলেছিলেন তিনিই। অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম বোঝার ক্ষেত্রেও তিনি তাঁর সময়ের চেয়ে ঢের এগিয়ে ছিলেন। আর রইল কথা কর্নফ্লেক্সের, হস্তমৈথুনবিরোধী খাবার হিসেবে কর্নফ্লেক্স কিন্তু বাজারে টিকে রইল না। এই খাবার টিকে রইল তার স্বাস্থ্যগুণের জন্যই। শতাব্দী পেরিয়েও তাই প্রাতঃরাশে এখনও কর্ন ফ্লেক্স অন্যতম বিশ্বস্ত খাবার। তা নিয়মিত খেয়েও মানুষ হস্তমৈথুন উপভোগ করেন, যথেষ্ট। এই দুইয়ের কোনও সংঘাত নেই, সম্পর্কও না।

More Articles