নন্দীগ্রামে 'বিশ্বাসঘাতকতা', কেন মমতার মুখে ঘুরেফিরে সেই একই কথা
Mamata Banerjee: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন বারবার বলছেন নন্দীগ্রামের কথা?
২০২১ সাল। জানুয়ারি মাস। শীতের তীব্রতার মধ্যেই বঙ্গের রাজনীতিতে সবেমাত্র আগুন লাগিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। বঙ্গোপসাগরে ঢেউ তুলে একদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রিয় সেনাপতি সদ্য যোগ দিয়েছেন গেরুয়া শিবিরে। ঠিক এই সময়ে দাঁড়িয়েই রাজ্যে নিজ-উত্থানের চাবিকাঠি নন্দীগ্রামে প্রবেশ ফের ঘটে মমতার।
১৮ জানুয়ারি, ২০২১। মমতা-আন্দোলনের নন্দীগ্রাম ভিত্তি, তেখালির সভা থেকে তৃণমূল নেত্রী বললেন, "ভবানীপুর আমার বড় বোন আর নন্দীগ্রাম আমার মেজ বোন। আমি দু'টি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে এবার দাঁড়াব। কারণ, নন্দীগ্রামে থেকেই আমি আন্দোলনটা করব। ভবানীপুরের মানুষ দুঃখ পেতে পারে। আমি দুঃখ দেব না। যদি ম্যানেজ করতে পারি আমি দুটোতেই দাঁড়াব। কিন্তু নন্দীগ্রামে আমি দাঁড়াচ্ছিই।" কথা রেখেছিলেন, শুধুমাত্র 'মেজ বোন'-এর জন্য। নির্বাচনে সঙ্গ দিয়েছিলেন 'মেজ বোন'-এর। কিন্তু 'বড় বোন'? মমতাকে পরবর্তীতে আদর দিলেও অর্থাৎ ভোটে জেতালেও 'মেজ বোন' সেদিন ভালবাসেনি তাঁকে। জিততে জিততে হেরে গিয়েছিলেন মমতা। তীব্র সবুজ ঝড়েও রয়ে গিয়েছিল মারাত্মক এই কাঁটা!
সাধারণ একটি আসন। ভোটে হার, বিধায়ক না হওয়া; এইরকম অঢেল রাজনৈতিক পরিস্থিতি জল্পনা না বাড়াতেই পারত! কাঁটা কিছুদিন পরেই নষ্ট হয়ে যেতে পারত আবার! কিন্তু এ যে নন্দীগ্রাম। আর বিপক্ষে শুভেন্দু। মমতার রাজনৈতিক ইতিহাসে যে দু'টি নাম গুরুত্বের। যে দু'টি বিষয় তাঁর উত্থানে বড় ভূমিকা পালন করে একদা। তাই, অন্যান্য সাধারণ হারের মতো এই হার মেনে নেননি তৃণমূল নেত্রী! আদালতের দ্বারস্থ হয়ে পুনর্গণনা দাবি করেছেন আবার।
আরও পড়ুন: ছাপিয়ে যাচ্ছেন সুপ্রিমোকেই! মহুয়ায় কেন মউ জমল না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের?
তারপর কেটে গিয়েছে এক বছরের বেশি সময়। হলদি নদী থেকে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। শুভেন্দু-অস্ত্রে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে বঙ্গ বিজেপি। মমতা ছাড়িয়ে শুভেন্দুর লড়াই পৌঁছেছে অভিষেক-অন্দরে। কিন্তু কথায় বলে, খারাপ স্মৃতি যদি কঠোর হয়, তা ভুলে থাকা চাপের! পোড় খাওয়া রাজনীতিক মমতার কাছে বোধহয় সেটিই সাড়া দিয়েছে বারবার। ভোলেননি তিনি। আর সেই না ভোলার তাগিদেই ফের জল্পনা উসকে দিলেন তৃণমূল নেত্রী। প্রেস্টিজ-ফাইটে নন্দীগ্রামে মমতা যাঁর ওপর ভরসা করেছিলেন, সেই শেখ সুফিয়ানকে উদ্দেশ্য করে মঙ্গলবার খড়গপুরের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ''সেই দিন তুই কোথায় ছিলি? আমি হেরে যাওয়ার পর রি-কাউন্টিং চেয়েছিলিস?'' এর সঙ্গেই মমতা আক্রমণ শানান অধিকারীদের দিকে। তিনি বলেন, ''নন্দীগ্রাম আন্দোলন যখন হয়েছিল, তখন কোথায় ছিল বাপ-ব্যাটা? আনিসুর রহমানের বাইকে করে আমি নন্দীগ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছি। ওরা কোথায় ছিল?'' এ-দিনের ওই বৈঠকে মমতার নির্দেশ, পুনরুদ্ধার করতে হবে নন্দীগ্রামকে। মানুষের মধ্যে ফিরতে হবে আবার। যদিও নন্দীগ্রাম এবং মমতা মন্তব্য নিয়ে কটাক্ষের সুর শোনা গিয়েছে শুভেন্দু-পিতা শিশির অধিকারীর গলায়। তিনি বলছেন, ''মমতা এক-একবার এক-এক কথা বলেন!''
অনেকেই বলছেন, খড়গপুরে দাঁড়িয়ে মেদিনীপুরের রাজনীতি এবং শুভেন্দু-অলিন্দে নন্দীগ্রাম আবেগকে ফের ঢাল করলেন মমতা। যে ইতিহাস তাঁর পক্ষে ভোলা প্রায় অসম্ভব! রাজনৈতিক মহলের একাংশের যুক্তি। ভুলবেনই-বা কেন? একদা যা দিয়ে তীব্র উত্থান। যা দিয়ে রাজনৈতিকভাবে বেঁচেছিলেন তিনি, সেই নন্দীগ্রাম ভুলবেন মমতা! যেখানে 'আবেগের বশে' পুরনো সেনাপতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলেন কিন্তু পারেননি। ভাঙা পায়ে রাজ্যজুড়ে খেললেও দিদির অস্ত্র একটু হলেও ভোঁতা করেছিলেন শুভেন্দু। যে ক্ষতে প্রলেপ দেওয়া যায়নি এখনও। আর সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই কি বারবার মমতার মুখে নন্দীগ্রাম। কেন?
২০০৬ সাল। রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে নাস্তানাবুদ তৃণমূল (TMC) ঘুরে দাঁড়ানোর মন্ত্র খুঁজছে। এদিকে ক্ষমতার চরম শিখরে তখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের (Buddhadeb Bhattacharjee) নেতৃত্বাধীন বাম সরকার। 'আমরা ২৩৫, ওরা ৩০'-এর বুদ্ধ-দম্ভ সমালোচিত হচ্ছে সেই সময়। এদিকে রাজ্যের জঙ্গলমহলে অর্থাৎ লালমাটির দেশে বাড়ছে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি। তখনও মাওবাদী (Maoists) তকমা আসেনি আন্দোলনে। সরকার বিরোধী সংগঠনের দাপটে জঙ্গলমহলের ক্ষমতা খানিকটা করায়ত্ত করেছেন ছত্রধর মাহতরা (Chhatradhar Mahata)। ঠিক এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে শিল্প আসতে থাকে রাজ্যে। পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম (Nandigram) এলাকায় জমি অধিগ্রহণের পথে এগোয় বাম সরকার। ইন্দোনেশিয়ার সালিম (Salim Group) গোষ্ঠীর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (SEZ) তকমা দিয়ে নন্দীগ্রামে একটি কেমিক্যাল হাব (Chemical Hub) নির্মাণের দিকে এগোয় সরকার। ঠিক এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েই আন্দোলনের সুতো পাকতে শুরু করে নন্দীগ্রামে। কার্তিক পাল, সিপিআইএম-এমএল (CPIM ML)-এর তরফে বাড়ে সংগঠন। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি-র নামে এককাট্টা হয়ে আন্দোলন শুরু হয় নন্দীগ্রামে। প্রথম অবস্থায় খুব একটা চড়া আন্দোলন না হলেও ২০০৭-এর প্রথম থেকেই এর মাত্রা বাড়ে। রাজ্য সরকারের তরফে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হয় বারবার। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে, স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে ওই আন্দোলনে তেমন একটা গুরুত্ব না দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তখনই। দাবি করা হয়, এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে মাওবাদীরা।
ঠিক এই আবহেই নন্দীগ্রাম-মঞ্চে প্রবেশ ঘটে তৃণমূলের। নুইয়ে পড়া মমতার দল ফের জেগে ওঠে। 'সাহসী শুভেন্দু' এবং অধিকারী পরিবার এবং আনিসুর রহমানদের সহযোগিতায় নন্দীগ্রাম আন্দোলনের রাশ হাতে নেয় তৃণমূল। মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে চলতে থাকে আন্দোলন। যা ৩৪ বছরের বাম শাসন শেষের কফিনে প্রথম তীর বলে মনে করেন অনেকেই। এই আন্দোলন দেশজুড়ে প্রতিফলিত হয়। কেন্দ্রের প্রতিনিধি দল থেকে শুরু করে মেধা পাটেকরের মতো সমাজকর্মী। সকলের নজর কাড়েন মমতা। বিরোধী, বিক্ষোভকারীদের পরিবারের মহিলাদের গণধর্ষণ। খুন, তাদের বাড়িছাড়া করার অভিযোগ ওঠে সিপিএমের 'হার্মাদদের' বিরুদ্ধে।
১৪ মার্চ। ২০০৭। প্রায় ৩০০০ হাজার পুলিশ আর কয়েকহাজার গ্রামবাসীর খণ্ডযুদ্ধে উত্তপ্ত হয় পরিস্থিতি। আগুন জ্বলে নন্দীগ্রামে। গুলি চলে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী মৃত্যু হয়, ১৪ জনের। কলকাতার রাজপথে যুব-কংগ্রেসের নেত্রী থাকাকালীন মমতার মহাকরণ অভিযানে গুলি। একাধিক মৃত্যুর ঘটনার পর এই ঘটনা ফের অস্বস্তিতে ফেলে বাম সরকারকে। রাজ্যজুড়ে উত্তাল হয় পরিস্থিতি। তৃণমূল দাবি করে, শতাধিক গ্রামবাসী নিখোঁজ। মৃত্যু হয়েছে ৫০-এর বেশির। রাজ্যের তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী থেকে শুরু করে রাজ্যের বিদ্বজনেরা, বুদ্ধ-নিন্দায় সরব হন সকলে। সিপিএমের একচ্ছত্র আধিপত্যে জোরদার আঘাত লাগে। ঘটনায় তদন্তভার যায় সিবিআইয়ের হাতে।
পরবর্তীতে তদন্ত এগিয়েছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার পক্ষে 'ক্লিন-চিট' এসেছে বুদ্ধ-দরবারে। কিন্তু তার আগে ঠিক যতটা পাওয়া সম্ভব, সব পেয়েছে তৃণমূল। সিঙ্গুর, নেতাই-কে দোসর করে নন্দীগ্রাম-অস্ত্রে বধ হয়েছে সিপিএম। একের পর এক নির্বাচনে বিপুল জয় পেয়েছেন মমতা। অর্থাৎ মমতার ক্ষমতালাভে জিয়নকাঠি হয়েছে নন্দীগ্রাম। তৃণমূলের জীবিত থাকার ওষুধ হয়েছে নন্দীগ্রাম। বিশ্বজোড়া খ্যাতি (বেদনার) আর মমতা-স্পর্শে রাতারাতি বদলে গিয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরের এই ছোট্ট জনপদ। আর তার বৃহৎ কান্ডে ভর করে আবর্তিত হয়েছে রাজ্যের, সামগ্রিকভাবে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।
যা বহুদিন স্বাভাবিক থাকলেও গত বিধানসভা নির্বাচনে ফের অন্য মাত্রা প্রদান করে। পুরনো সেনাপতির সঙ্গে 'অযাচিত লড়াই'য়ে রাজ্যের নির্বাচনী কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় নন্দীগ্রাম। যা একটা সময় উজাড় করেছিল মমতাকে, সেখানেই হেরে যান তৃণমূল নেত্রী। এই বিষয়টি যেমন রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যের, ঠিক তেমনই ব্যক্তি মমতার কাছে যে খুব একটা সুখের নয়, একথা অস্বীকার করবেন না কেউই। ঠিক এই আবহেই হয়তো বারবার কাঁটা বিনষ্টের চেষ্টা করছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রতিমুহূর্তে ফের বুঝিয়ে দিচ্ছেন, নন্দীগ্রাম আমার! আমিই নন্দীগ্রামের অন্য কেউ নয়, অন্য কেউ হতেই পারে না!