অভিযোগের তির এবার কার দিকে? ব্যক্তিগত সততার প্রমাণ দিতে কেন মরিয়া মমতা?
জনমানসে সিমপ্যাথি কুড়োতে চাইছেন মমতা, যা নিজেকে বাঁচানোর, দুর্নীতির পাক থেকে নিজেকে উদ্ধারের চেষ্টা?
২৯ আগস্ট, ২০২২। ধর্মতলার ছাত্র সমাবেশের আক্রমণাত্মক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেন কয়েক ঘণ্টাতেই বদলে গেলেন! ৩১ আগস্ট, ২০২২। বিনয়ী-পরিণত তৃণমূলনেত্রী নবান্নের সাংবাদিক সম্মেলনে আক্ষেপের সুরে বললেন, 'রাজনীতি এত নোংরা জানলে সরে যেতাম। মানুষের কাজ করব বলে এসেছিলাম!' তাহলে কি হঠাৎ বদলে গেলেন মমতা! পোড় খাওয়া রাজনীতিক, রাজনীতিকে ধ্যান করা নেত্রীর মুখে কেন রাজনীতি-বিদায়ের কথা! পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি, গরু-কয়লা দুর্নীতির আবহে, বিরোধী আক্রমণের তীব্রতায় কি অবশেষে বিপর্যস্ত হলেন লড়াকু নেত্রী? এই জল্পনা দানা বাঁধার আগেই উত্তরটাও যেন দিয়ে দিলেন তিনি। বললেন, 'আমার বিরুদ্ধে আমার পরিবারের বিরুদ্ধে জোর করে জমি, সম্পত্তি বাড়ানোর অভিযোগ উঠছে। আমি আধিকারিকদের বলেছি এমন কিছু পেলেই বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিন।' তাহলে কি তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ বেআইনি সম্পত্তি বাড়ানোর অভিযোগ এবং আদালতে মামলা নিয়ে অস্বস্তিতে তিনি। অভিষেক-রুজিরা আবহ, দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি নিয়ে যে অস্বস্তি আগেই তীব্র হয়েছিল বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর।
এখানেই ঘটল টুইস্ট! রাজনৈতিক জল্পনা বাড়িয়ে মমতা বললেন, "পরিবারের সঙ্গে শুধুই উৎসবের সম্পর্ক। পুজো, ভাইফোঁটা, রাখির সম্পর্ক। সকলেই আলাদা। তাঁদের ছেলেমেয়েরা অনেকেই প্রতিষ্ঠিত। আমার কাছে মা ছিলেন, তাঁর সঙ্গেই আমি থাকতাম।" এরপরেই শুরু হয় রাজনৈতিক টানাপড়েন। তাহলে কি সন্তর্পণে আবেগের কথা বলে, পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে নিলেন মমতা। আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক যে শুধুই উৎসবধর্মী; ব্যক্তিগত স্তরে তা একেবারেই গৌণ, এটাই প্রমাণ করতে চাইলেন তিনি! এই প্রশ্নের আবহেই খতিয়ে দেখা প্রয়োজন সমসাময়িক প্রেক্ষাপট। কেন?
পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়-গ্রেফতার হওয়া এবং অর্পিতার ফ্ল্যাট থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের ছবি প্রকাশ্যে আসতেই পার্থ থেকে দূরত্ব বাড়ানোর পথে হাঁটতে দেখা যায় তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বকে। যেখানে কুণাল ঘোষ এবং তৃণমূলের একাধিক নেতার প্রকাশ্য বিদ্রোহের আবহেই পার্থকে সরিয়ে দেওয়া হয়। দুর্নীতি থেকে দূরত্বের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন মমতা, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়রা। যার রেশ একের পর এক জনসভায় দেখা গিয়েছে। ওই দুর্নীতির দায় যে শুধুমাত্র ব্যক্তি পার্থের, তা প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে বারবার। এদিকে পার্থ-অস্বস্তির মধ্যেই গবাদি পশু পাচার মামলায় সিবিআই-হাতে গ্রেফতার হন অনুব্রত মন্ডল। একের পর এক বেআইনি সম্পত্তির অভিযোগ প্রকাশ্যে আসে। সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আর কড়া অবস্থান নিতে দেখা যায়নি তৃণমূলকে। উপরন্তু মমতা-অভিষেক পরোক্ষে বা প্রত্যক্ষে পাশে দাঁড়িয়েছেন অনুব্রতর। কেন্দ্রের তরফে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার অপব্যবহার নিয়েও সরব হয়েছেন তাঁরা।
আরও পড়ুন: চেক ভাঙিয়ে পাহাড়প্রমাণ সোনা কিনেছেন অভিষেক-পত্নী রুজিরা! শুভেন্দু-উবাচ যেন সিনেমা
কিন্তু এর মধ্যেও প্রশ্ন উঠেছে। 'চোরের রানি মমতা' অথবা 'চোর ধরো জেল ভরো'-র মতো স্লোগানে উত্তপ্ত হয়েছে রাজপথ। বিরোধীরা বারবার আক্রমণের তির ছুড়েছে কালীঘাটের দিকে। এই পরিস্থিতিতে বিরোধী আক্রমণ এবং তৃণমূলের পাল্টা দাবির যাঁতাকলে আগুন ছড়িয়েছেন বিজেপি নেতা, আইনজীবী তরুণজ্যোতি তিওয়ারির একটি জনস্বার্থ মামলা। যেখানে অভিষেক ছাড়িয়ে এবার অভিযোগ করা হয়েছে মমতার ভাইদের বিরুদ্ধে, তাঁদের আত্মীয়দের বিরুদ্ধে। ২০১১ এবং পরবর্তীতে ২০১৩ সালের পর থেকে হুহু করে বেড়েছে মমতার পরিবারের সদস্যদের সম্পত্তি। অভিযোগ, কলকাতা পৌরসভার ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মমতার ভাইয়ের স্ত্রী কাজরী বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে সমাজকর্মী হিসেবে দাবি করেও নির্বাচন কমিশনের হলফনামায়, তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ৫ কোটি! এমনকী, কাজরীর পুত্রের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি থাকলেও তার উল্লেখ করা হয়নি। দাবি, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবার নামে চারটি কোম্পানি রয়েছে।
এছাড়াও মমতার ভাইরা একাধিক সম্পত্তির মালিকানা নিয়েছেন বাজারের থেকে কম দামে, অভিযোগ উঠেছে এমনও। এই ঘটনার তদন্তে কেন্দ্রীয় সংস্থার দাবি করা হয়েছে ওই মামলায়। যেখানে উল্লেখযোগ্যভাবে পার্টি করা হয়েছে তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষকে। অভিযোগ, জেলবন্দি কুণাল বলেছিলেন, সারদায় সর্বাধিক সুবিধা নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও সময় পরিবর্তন হয়েছে। এখন সেই বিস্ফোরক কুণাল ঘোষ তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক। তিনি দলের মুখপাত্রও বটে! উল্লেখ্য, অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়, অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, সমীর বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়, গণেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজরী বন্দ্যোপাধ্যায় -মুখ্যমন্ত্রী মমতার পরিবারের এই ৬ সদস্যের বিরুদ্ধে বেআইনি সম্পত্তি বৃদ্ধির অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে। মামলায় সাক্ষী হিসেবে কুণাল ঘোষকে পার্টি করা হলেও মমতা নিজে পার্টি হননি। এ দিকে সিবিআই ডিরেক্টর, আয়কর দফতরের ডিরেক্টরকে পার্টি করা হয়েছে ওই মামলায়। মামলা সংক্রান্ত নোটিশের কথা স্বীকার করেছেন কুণাল ঘোষও।
প্রসঙ্গত, একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগে নাস্তানাবুদ শাসক দল বিশেষত, নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষের সামনে তাঁর ভাবমূর্তির অক্ষুণ্ণতায় এগিয়েছেন। একাধিক প্রকাশ্য সভায় বাম আমলের দুর্নীতির কথা বলে, দলে ব্যক্তি খারাপ কিন্তু তিনি অর্থাৎ পুরো দল খারাপ নয়, এই বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। ৫ সেপ্টেম্বরের শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠান মঞ্চেও টেনে এনেছেন এই প্রসঙ্গ। অনুষ্ঠান-মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'একটা খারাপ মানুষ, একটা খারাপ কাজ করল, তাঁর জন্য পুরো সমাজকে কুৎসা করে ক্ষোভ উগরে দিলাম। সবাইকে এক জায়গায় ফেলে দেওয়া, সেটা ঠিক হয় না। কখনও ভাল মানুষ বিপথে পরিচালিত হন। সঙ্গদোষে, ফ্রাস্ট্রেশনে চলে যান। তাঁদের আমাদেরই ভালো মানুষে পরিণত করতে হবে।' বাম আমলে 'বড় দুর্নীতি' এবং বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় প্রসঙ্গও তুলে আনেন তিনি। এখানেই শুরু হয়েছে জল্পনা, আসলে কি দুর্নীতি এবং তৃণমূলের একটি অংশের দায়কে বারবার সামনে আনতে চাইছেন মমতা। যেখানে সমগ্র দল বিশেষত তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ার যে স্বচ্ছ, এটি খুব সহজেই বোঝানো যাবে। মানুষের সামনে গুটিকয়েক লোক খারাপ কিন্তু সবাই নন, মমতা তো ননই! সন্তর্পণে এই বার্তাও দেওয়া যাবে জনমানসে। যে কারণে প্রকাশ্য সমাবেশে বিজেপি বিরোধিতা, কেন্দ্রীয় এজেন্সির অপব্যবহার নিয়ে সরব হলেও আসলে দুর্নীতি এবং ওই খারাপ অংশের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াচ্ছেন মমতাও। যে কাজে বাধ সেধেছে তাঁর পরিবারের নাম জড়ানোয়। এই প্রেক্ষাপটে, যে বিরোধিতা খানিকটা সহজ করে ফেলছিলেন মমতা। সেখানেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ অভিষেক, তাঁর স্ত্রীর কয়লাকাণ্ডে অথবা গরুকাণ্ডে যোগের অভিযোগ উঠলেও, তা সামলে নেওয়ার চেষ্টা চললেও বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার, নিজের ভাই, তাঁদের স্ত্রীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ স্বাভাবিকভাবে অস্বস্তি বাড়িয়েছে। প্রকাশ্যে তীব্র বিরোধিতা চললেও সমস্ত দুর্নীতির আঁতুড় যে কালীঘাট থেকে, রাজ্যবাসীর কাছে এই বার্তা দিতে খানিকটা সফল হয়েছে বিরোধীরা। পদে পদে মমতার নাম উঠে আসছে। যে প্রেক্ষাপটে, নিজেকে রক্ষা এবং ভাবমূর্তি বাঁচাতে অথবা স্পষ্ট করে মুখ খুলতেই হত মমতার। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, এই পরিস্থিতিতেই এক বাক্যে সূক্ষ্মভাবে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে করতে চেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যেখানে, তিনি যে একা অর্থাৎ মানুষের জন্যই তিনি, আর কেউ তাঁর কাছের নয়, এই বিষয়টি জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই যা ঘটেছে, যদি হয়েও থাকে তা যে তাঁর জন্য নয়, কোনও দায় তাঁর নেই। এই বিষয়টি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, গত বিধানসভা নির্বাচনে প্রকাশ্যে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল সব আসনে তিনিই প্রার্থী। 'ভুল হলে চড় মারুন'। অর্থাৎ দলের সমস্ত কু-কাজের সঙ্গে তাঁর কোনও যোগ নেই। তিনিই সব, তিনিই শেষ কথা। তাঁর জন্যই ভোট দিক মানুষ। একদা মমতার ছবি-সহ সততার প্রতীক লেখা পোস্টারে ভরে যাওয়া রাজ্যে ২০২১-এও ক্ষমতায় আসেন মমতা। অনেকেই বলেন, মানুষের মধ্যে সমস্ত খারাপের মধ্যেও যে তিনি সৎ। তিনি স্বচ্ছ, এই বিষয়টি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে সেই সততাকে নামিয়ে আনতে হচ্ছে ভাবমূর্তি রক্ষার এক পক্ষ হিসেবে। এক টিকে থাকার তাগিদ হিসেবে। যা ভূরি ভূরি অভিযোগের আবহেই মমতা যে একই, তিনি সৎ। তিনি এসব জানেন না, এই ভাবনার উদগীরণে সহায়ক। সেই বিষয়টি মাথায় রেখে বারবার এই দূরত্ব বাড়ানোর কৌশল আয়ত্ত্ব করেছেন মমতা। অর্থাৎ তোমার সব দায়, শুধুই এবার তোমার! আমার নয়! যদিও এই তৃণমূল নেত্রীই বলেছেন, 'আমি ভাইদের সঙ্গে তত যোগাযোগ রাখি না। ভাইয়ের বউদের সঙ্গে গল্প করি। অভিষেকের মা খাবার দিয়ে যান। আমি প্লেনে বিজনেস ক্লাসে চড়ি না।' একদিকে পরিবারের সঙ্গে উৎসবের সম্পর্ক বলার পরেই ভাইয়ের বউদের সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানিয়েছেন তিনি। বিরোধীদের দাবি, ভাইয়ের বউ তো কাজরী বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাহলে কি ওঁর বিপুল সম্পত্তির ব্যাপারে ননদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানতেন!
যদিও নিজের সম্পর্কে, নিজের আয়ের বিষয়ে বারবার ব্যখ্যা দিয়েছেন মমতা। তাঁর দাবি, "এক পয়সা পেনশন নিই না। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বরাদ্দ বেতন নিই না। আমার চলে ছবি এঁকে, বই লিখে। আমি সরকারের কাছ থেকে এককাপ চা-ও খাই না।" এই আবহেই রাজনৈতিক মহলের একাংশের ব্যাখ্যা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পেনশন বা ভাতা নেন না। অর্থাৎ তিনি সরকারি অর্থ নিচ্ছেন না। নিজের কষ্টার্জিত অর্থেই দিন গুজরান করছেন, এই নিদর্শনের কথা ২০১১ থেকেই বারবার জানিয়েছেন মমতা। ওই অংশের দাবি, তবে নেত্রীর এই মানসিকতা পৌঁছয়নি দলের অন্দরে। ওঁর মন্ত্রিসভার সব সদস্য, ওঁর সমস্ত সাংসদ থেকে বিধায়ক সরকারি সম্পত্তিতেই দিন গুজরান করছেন। এখানেই বিরোধীদের প্রশ্ন, তাহলে নিজেকে আর সৎ দেখিয়ে লাভ কী! পোস্টারে সততার প্রতীক লেখার মুখ নেই আর! তাই এসব করে জনমানসে সিমপ্যাথি কুড়োচ্ছেন মমতা। যা নিজেকে বাঁচানোর, দুর্নীতির পাঁক থেকে নিজেকে উদ্ধারের চেষ্টা! রাজনৈতিক মহলের মতে, এই চেষ্টার ঢাল হয়েছে মমতার মন্তব্য। যা অভিযোগের স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও করতে পারে! বলবে ভবিষ্যৎ।