আদবানিই গড়েছেন তাঁকে, অথচ কেন গুরুকেই বাতিল করে দিলেন একলব্য মোদি?
Modi and LK Advani Relation : ১৯৯০ সালে আদবানি বাবরি মসজিদের জায়গায় মন্দির নির্মাণের প্রচারের জন্য সমর্থন জোগাড় করতে ভারত ভ্রমণ করেছিলেন।
একলব্য আঙুল কেটে দিয়েছিলেন। সে যুগ গত, সেই একলব্যও বদলে গিয়েছে তুমুল। শিষ্য গুরুদক্ষিণা দিতে গিয়ে আসলে গুরুকেই করে তুলছে অপাংক্তেয়। এতটাই অপাংক্তেয় যে দেশ বদলে দেওয়া রাজনীতির এক চরম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে গুরুকে অস্বীকার করছেন একলব্য! রামমন্দিরের উদ্বোধনে আদবানি, মুরলি মনোহর যোশীদের না আসার অনুরোধ করা হয়েছে। অথচ ভারতের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ভারতীয় জনতা পার্টির উত্থানের নেপথ্যের সিংহভাগ কৃতিত্বই লালকৃষ্ণ আদবানির।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জনপ্রিয় হওয়ার আগে নবতিপর আদবানিই ছিলেন বিজেপির পোস্টার বয়। কে না জানে, অযোধ্যায় বিতর্কিত জমিতে মন্দির নির্মাণের রাজনৈতিক খেলায় প্রতিটা চাল ছিল আদবানিরই মস্তিষ্কপ্রসূত! ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আদবানি ফের মূল বিজেপি রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। ১৯৯২ সালে ১৬ শতকের বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার জন্য হিন্দু জনতাকে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে আদবানিকে খালাস করে এক আদালত। ১৯৯২ এর বাবরি ধ্বংস সারা দেশে বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদের উত্থানের ভিত্তি ছিল। আদবানি ছিলেন সেই উত্থানের হোতা। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই বলছেন, আদবানি যে দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাতে তিনি নিজেই এখন কার্যত অপ্রাসঙ্গিক। দল বা সরকারের কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদেই তিনি নেই, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তাঁর মতামতও শোনা যায়নি কোনও। তাঁর মতামতের ধারও ধারেনি বিজেপি। এমনকী তাঁকে সেই রাম মন্দিরের উদ্বোধনেই আসতে বারণ করা হয়েছে যা তিনি না থাকলে তৈরিই হতো না।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি বিজেপিকে ক্ষমতায় আনার পরপরই আদবানি এবং দলের অন্যান্য বরিষ্ঠ নেতাদের 'গাইডেন্স কাউন্সিল' নামে একটি দলে রাখেন। মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার এক মাসের মধ্যে অমিত শাহ দলের সভাপতি হন। সেই বছরের অগাস্টেই আদবানি, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং প্রাক্তন বিজেপি সভাপতি মুরলি মনোহর যোশী -- ১৯৮০ সালে দলের তিন প্রতিষ্ঠাতাদের নবগঠিত উপদেষ্টা পরিষদের অংশ করা হয়। শুনতে উপদেষ্টার মতো হলেও বিশ্লেষকদের মতে কোনও বাস্তব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই ছিল না এই বয়োজ্যেষ্ঠদের।
আরও পড়ুন- ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ বুঝতেন অটল বিহারী, বাজপেয়ীর বিজেপির থেকে কোথায় আলাদা মোদির বিজেপি?
১৯৮৪ সালে দু'টি সংসদীয় আসন ছিল বিজেপির। সেইখান থেকে ১৫ বছরের মধ্যে সরকার গঠন করতে বিজেপিকে সাহায্য করেছিলেন আদবানি, কিন্তু যে তরুণ নেতাদের হাতে ধরে গড়েছিলেন আদবানি তাঁরাই কেউ পাত্তাও দেননি তাঁকে। বিজেপিতে নরেন্দ্র মোদিকেও এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন আদবানিই। ২০১৩ সালে প্রবীণ আদবানি ঘোষণা করেন যে, তিনি সমস্ত দলীয় পদ থেকে পদত্যাগ করছেন। বিশ্লেষকরা বলেন, আদবানির তরফে এটিই ছিল বিশাল ইঙ্গিত। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে দলের নির্বাচনী প্রচারে নেতৃত্ব দেওয়ার নরেন্দ্র মোদিকে বেছে নেওয়াতে সন্তুষ্ট ছিলেন না আদবানি। পদত্যাগের পর অনেক নেতাই আদবানিকে বোঝাতে তাঁর বাড়িতেও ছুটে যান। শেষ পর্যন্ত মোদিকে সমর্থনই করেছিলেন আদবানি, এমনকী তাঁর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আদবানি আরও নীরব হয়ে যান। ২০১৯ সালে মোদি ফের ব্যাপকভাবে জয়ী হন।
আদবানি অটল বিহারী বাজপেয়ীর অধীনে প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৪ সালের মে মাসে সাধারণ নির্বাচনে হারের পর দলকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন তিনি। নিজের ওয়েবসাইট এবং ব্লগের মাধ্যমে তরুণ ভোটারদের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করেন আদবানি। ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রচারের সময় জিমে অবধি প্রচার চালান আদবানি। তবে দলের তাতে কোনও লাভ হয়নি। কংগ্রেসকে হারেতে পারেনি বিজেপি, মনমোহন সিংই সেবার ক্ষমতায় আসেন। ১৯৯০ সালে আদবানি বাবরি মসজিদের জায়গায় মন্দির নির্মাণের প্রচারের জন্য সমর্থন জোগাড় করতে ভারত ভ্রমণ করেছিলেন। বাবরির ধ্বংস ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক ধর্মীয় হিংসার ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলে। হিন্দুদের উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ ওঠার পর থেকেই আদবানি নিজের নাম ওই তালিকা থেকে মুছে ফেলার জন্য লড়াই করেছেন। খালাস পাওয়া সত্ত্বেও হিন্দু-মুসলিম উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করার অভিযোগ কিন্তু মুছে যায়নি আদবানির নাম থেকে।
আদবানির জন্ম পাকিস্তানের করাচিতে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার ঠিক আগে তাঁর পরিবার ভারতে চলে আসে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সদস্য ছিলেন আদবানি। এইখানেই নিজের আদর্শের শিকড় তৈরি হয়ে যায় তাঁর। আদবানিকে নিয়ে প্রথম বিতর্ক হয় পাকিস্তান সফর নিয়ে। ২০০৫ সালের জুন মাসে ছয় দিনের পাকিস্তান সফর করেছিলেন তিনি। সেখানে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ আলি জিন্নাহর প্রশংসা করা এবং তাকে ধর্মনিরপেক্ষ বলায় আদবানিকে ঘিরে ক্ষোভ ও বিতর্কের জন্ম দেয়। বিজেপি ধীরে ধীরে আদবানিকে সরিয়ে দিতে থাকে। দলের সভাপতি পদ থেকে সরে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয় তাঁকে।
আরও পড়ুন- মোদির রামমন্দির উদ্বোধনে কেন ব্রাত্য লালকৃষ্ণ আদবানিরা?
অথচ আদবানিই আসলে ডানপন্থী এই দলের মেরুকরণ প্রকল্পের মূল স্থপতি। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি মোট ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ২৮২টি আসন জিতেছিল। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত দলের সভাপতি হিসাবে তাঁর প্রথম মেয়াদেই বিজেপি ১৯৮৪ সালে লোকসভার দু'টি আসন থেকে ১৯৮৯ সালে ৮৫ টি আসনে জিতে যায়। হিন্দুত্ব বা উগ্র হিন্দুত্বের দিকে এই ছিল প্রথম উল্লেখযোগ্য বাঁক। ১৯৯০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আদবানি একটি রথযাত্রা শুরু করেছিলেন গুজরাতের সোমনাথ মন্দির থেকে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা পর্যন্ত (রাম জন্মভূমি), মন্দিরের দাবিতে। ফলস্বরূপ, ভারতের প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের নামে একটি মসজিদ গুঁড়িয়ে যায় ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। মসজিদ ধ্বংসের ফলে দেশের বিভিন্ন অংশে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়। বিজেপির উগ্রতা আর সাম্প্রদায়িক চেহারা প্রথম প্রকাশ্যে এনেছিলেন আদবানিই। অথচ, সেই রাম মন্দিরের উদ্বোধনে তিনিই ব্রাত্য।
বহু বছর পরে, যখন বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হন এবং ২০০২ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ করতে গুজরাত সরকারের ব্যর্থতার জন্য মোদির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিলেন, তখন আদবানিই দলের জাতীয় কার্যনির্বাহী সভায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মোদিকে ধারাবাহিক ভাবে সমর্থন জুগিয়ে যান। আদবানির স্নেহচ্ছায়ায় নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
সেই নরেন্দ্র মোদিই ধীরে ধীরে নিজেকে বিজেপির হোতা করে তুলতে থাকেন। নিজেকে এমন একজন ব্যক্তি হিসাবে তুলে ধরতে থাকেন মোদি যিনিই দলকে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে জয়ের মুখ দেখাবেন। আদবানি মোদির এই স্বঅভিষেকের চেষ্টাকে প্রতিহত করতে চেয়েছিলেন। মোদি বিজেপিকে জেতানও। দলের অনেকেই ততক্ষণে বলতে শুরু করে দেন, কীভাবে আদবানি নতুন প্রজন্মের সাফল্য হজম করতে পারেননি, কীভাবে আদবানি মোদিকে দমাতে চেয়েছিলেন। বাকিটা ইতিহাস। মোদিই দলের প্রচার কমিটির প্রধান হন, প্রধানমন্ত্রীও হন। তাঁর এই উত্থানকে বাধা দেওয়ার চেষ্টার জন্য তিনি আদবানিকে কখনই ক্ষমা করেনি। রাম মন্দিরে কাহিনি মোদি-আদবানির সেই তিক্ততারই ফল মাত্র। বিজেপির এই একলব্য নিজের আঙুল কাটেননি, গুরুকেই সরিয়ে দিয়েছেন যত্নে!