ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ বুঝতেন অটল বিহারী, বাজপেয়ীর বিজেপির থেকে কোথায় আলাদা মোদির বিজেপি?

Atal Bihari Vajpayee: নিজের প্রায় পাঁচ দশকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ৯০ শতাংশ সময়ই বিরোধী আসনে বসেছেন অটল বিহারী বাজপেয়ী।

আজকাল ভারতের রাজনীতিতে একটি শব্দ খুব ব্যবহৃত হচ্ছে, রিসর্ট পলিটিক্স। যাতে নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীরা কোনওভাবেই বিরোধী শিবিরে না যেতে পারেন তাই শপথ গ্রহণ পর্যন্ত তাঁদের ফাইভ স্টার রিসর্টে নজরবন্দি করে রাখা হয়। এই রিসর্ট পলিটিক্সের জন্ম হয়েছে একটি আশঙ্কা থেকে। ভোটে জিতেও সরকার না গড়তে পারার আশঙ্কা। এই ধরনের রাজনীতি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিগত কয়েক বছরে দেখা গিয়েছে বিজেপির দৌলতে। সে মধ্যপ্রদেশ হোক, কর্নাটক হোক, গোয়া হোক বা হোক মহারাষ্ট্র, সবেতেই নিজের চাণক্য নীতি দেখিয়েছেন অমিত শাহ। এই তো সম্প্রতি দিল্লির এমসিডি নির্বাচনে জয়ী আপ এবং হিমাচল প্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী কংগ্রেস ফলাফল বেরনোর সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের জয়ী নেতাদের রিসর্ট বন্দি করার জন্য হোটেল খুঁজছিল। শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের ক্ষমতা রক্ষা করতে পেরেছে, বা বলা ভালো বিজেপির তরফে এখনও পর্যন্ত সরকার ফেলার চেষ্টা করা হয়নি। এই মুহূর্তে বিপুল জনমতের সঙ্গে কেন্দ্রে বিজেপির সরকার এবং ভারতের অধিকাংশ রাজ্যই বিজেপির দখলে।

তবে আজ থেকে ২৩ বছর আগে চিত্রটা অন্য রকমের ছিল। এই বিজেপিরই এক অন্য রূপ দেখেছিল গোটা দেশ। ১৯৯৯ সালের শুরু থেকেই জয়ললিতা বাজপেয়ীকে বারবার 'আল্টিমেটাম' দিচ্ছিলেন তামিলনাড়ুতে করুণানিধির ডিএমকে সরকারকে বরখাস্ত করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু জনতার নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করতে চাইছিলেন না প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী। ফলত জয়ললিতার এআইএডিএমকে সমর্থন টেনে নেয় এনডিএ সরকারের থেকে। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় এনডিএ। মায়াবতী সমর্থন দেবেন বলেও কথা রাখেননি। সংসদে ফ্লোর টেস্টে মাত্র এক ভোটে পড়ে যায় অটল বিহারী বাজপেয়ীর ১৩ মাসের সরকার। সেই সময়ে সংসদে দাঁড়িয়ে অটল বিহারী বাজপেয়ী মুক্তকণ্ঠে বলেছিলেন, “যদি অন্য পার্টি ভেঙে আমায় নিজের সত্তা বাঁচাতে হয়, তাহলে সেই সত্তাকে আমি হাত তো দূর, সামান্য চিমটে দিয়েও ধরব না।” তাঁর হাতে ছিল সকল মেশিনারি। তিনি চাইলেই একটি ভোট ‘ম্যানেজ’ করে নিজের সরকার বাঁচিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সম্মান করতেন গণতন্ত্রের, তিনি সম্মান করতেন জনতার রায়ের। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই চিত্র দেশ কল্পনাও করতে পারবে না। সাম্প্রতিক অতীতে, বিভিন্ন সময় বিজেপি নির্বাচিত সরকার ফেলে বিধায়ক ভাঙিয়ে নিজেদের সরকার কায়েম করেছে। যাকে ন্যাশনাল মিডিয়া নাম দিয়েছে 'চাণক্য নীতি'।

আরও পড়ুন-নিজেরই মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ধর্না-অনশনে বসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এই মুখ্যমন্ত্রী! কেন?
 

তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিচ্ছেন অটল বিহারী বাজপেয়ী

 

বিজেপির রাজনৈতিক অবস্থান ধর্মভিত্তিক। ধর্মনিরপেক্ষতার ধার ধারে না তারা। বর্তমানে প্রায়শই বিজেপি নেতাদের মুখে শোনা যায়, "গোলি মারো সালো কো" কিংবা "আমরা ৮০ ওরা ২০"-র মতো উস্কানিমূলক বক্তব্য। আর এখানেই তফাৎ নরেন্দ্র মোদির বিজেপি এবং অটল বিহারী বাজপেয়ীর বিজেপির মধ্যে। ১৯৮৪ সালে গোয়ালিয়র থেকে লোকসভা নির্বাচন বাজে ভাবে হেরে যান বাজপেয়ী। এই সময় বিজেপিতে আডবাণী যুগ শুরু হয়েছে। রাম-মন্দির আন্দোলন নিজের চরমে পৌঁছেছে। বিজেপি, শিবসেনার মতো দলগুলি রাম মন্দিরের আবহে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান শক্ত করছে। তবে এই নীতি একেবারেই না-পসন্দ ছিল অটল বিহারী বাজপেয়ীর। তিনি অনেকাংশে একজন প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ নেতা ছিলেন। ফলত ১৯৮৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে ভোটেই দাঁড়াননি বাজপেয়ী। এছাড়াও যখন আডবাণীর রথ অযোধ্যার দিকে এগোচ্ছিল, বাজপেয়ী বলেছিলেন, “অযোধ্যা শব্দের অর্থ যেখানে যুদ্ধ হয় না। আমি সকলকে অনুরোধ করবো হিংসার রাস্তা অবলম্বন করবেন না।”

অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং নরেন্দ্র মোদি দু'জনেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ থেকে উঠে এসেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই দুই নেতার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। হিন্দুত্ববাদী দল হলেও বাজপেয়ী ছিলেন নেহেরু-গান্ধী ঘরানার নেতা। তাই সেই রাজনৈতিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করেই বিজেপির যাবতীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেই কারণেই সেই সময় সংসদে বিরোধীদের বক্তব্যকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো বিজেপির পক্ষ থেকে। এমনকী বিরোধী দলনেতা থাকাকালীনও বাজপেয়ী, প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের আবেদনে জাতি সংঘে গিয়ে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কিন্তু এই জমানায় সংসদে বিরোধীদের জায়গাই নেই। এর কারণ, এনডিএ সরকারের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। তবে নরেন্দ্র মোদি নিজে অনেক বেশি আগ্রাসী মেজাজের রাজনীতিবিদ। অনেকেরই মনে আছে সেই ভাইরাল ভিডিওর কথা যেখানে অটল বিহারী বাজপেয়ী, নরেন্দ্র মোদিকে রাজধর্ম পালন করার কথা বলছেন। রাজধর্মের কথা তুলতেই বাজপেয়ীকে এক প্রকার চুপ করিয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, “আমরা কি অন্য কিছু করছি নাকি? আমরাও তো রাজধর্মই পালন করছি।”

২০০২-এর সেই সাংবাদিক সম্মেলনে বাজপেয়ীকে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন মোদি

সরকার পরিচালনা করার ক্ষেত্রে বাজপেয়ীর বিজেপির সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির বিজেপির আকাশ-পাতাল পার্থক্য। অটল বিহারী বাজপেয়ী তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। প্রথমবার ১৩ দিনের, দ্বিতীয়বার ১৩ মাসের এবং তৃতীয়বার নিজের মেয়াদ সম্পূর্ণ করেছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন প্রথম অকংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী যিনি নিজের মেয়াদ পূর্ণ করেছেন। তবে তিনবারের মধ্যে শেষ দু'বার তাঁকে শরিকদের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠন করতে হয়েছিল। প্রথমবার কোনও শরিক না মেলায়, সবচেয়ে বড় দল হওয়া সত্ত্বেও বিজেপির সরকার পড়ে যায়। তাঁর আমলেই এনডিএ জোট তৈরি হয়। শরিকদের উপর নির্ভর করে সরকার গড়ার ফলে অনেক বেশি মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হয়েছিল বাজপেয়ীকে। ২৪ টি দলের জোট ছিল এনডিএ। এই জোটে ছিল এলজেপি এবং জেডি(ইউ) যাদের বিহারে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। আবার এই জোটেই ছিল ফারুক আব্দুল্লাহর ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং বালাসাহেব ঠাকরের শিবসেনা। উত্তর ভারতের কৃষক বেল্টের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, শিরোমনি অকালি দল এবং হরিয়ানা লোক দলও ছিল এই জোটে। এছাড়াও বিজু জনতা দল, তৃণমূল কংগ্রেস, তেলুগু দেশম পার্টি, ডিএমকে প্রভৃতি পৃথক বিচারধারার দল ছিল এই জোটে। আলাদা আলাদা বিচারধারা অর্থাৎ আলাদা আলাদা কর্মসূচি। স্বাভাবিকভাবেই নিজের কার্যকালে বাজপেয়ীর পক্ষে বিজেপির সব ক'টি এজেন্ডা রূপায়ণ করা সম্ভব হয়নি।

বরাবরই জোট শরিকদের উপর নির্ভর করতে হয়েছে বাজপেয়ীকে

আরও পড়ুন- নতুনভাবে ইতিহাস লেখার নিদান অমিত শাহের, ‘হিন্দুরাষ্ট্রের’ পথে আরও এক ধাপ?

অপরপক্ষে, নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বারের জন্য তাঁর সরকার ক্ষমতায় আসে। এই দু'বারই নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জোট শরিকদের এজেন্ডা বা বিরোধীদের বিরোধিতা, কোনওটাতেই বেশি মাথা ঘামাতে হয় না বর্তমান সরকারকে। তারা নিজেদের মতো নিজেদের কর্মসূচি পূরণ করে চলেছে। নিজের প্রায় পাঁচ দশকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ৯০ শতাংশ সময়ই বিরোধী আসনে বসেছেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। ফলত নিজে ক্ষমতায় এসে সদনে বিরোধীদের জন্যও যথেষ্ট জায়গা রেখেছিলেন তিনি। অপরপক্ষে নরেন্দ্র মোদি বিগত কুড়ি বছর ধরেই ক্ষমতায় রয়েছেন। প্রথমে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন এবং পরে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী আসনে তাঁকে বসতে হয়নি কখনও। এই কারণেই তিনি অনেক বেশি আগ্রাসী। এই আগ্রাসনই ‘ব্র্যান্ড মোদি’ তৈরি করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কারণে দেশের অধিকাংশ রাজ্যে ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার। একথা অস্বীকার করার জো নেই দুই নেতারই বিপুল জনসমর্থন রয়েছে দেশে। তবে জনসমর্থন থাকলেও দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রিয় হতে পারেননি নরেন্দ্র মোদি। দেশের অনেক মানুষই এই প্রধানমন্ত্রীকে পছন্দ করেন না। তবে অটল বিহারী বাজপেয়ীর ‘হেটার’ পাওয়া মুশকিল। তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীরাও তাঁকে সম্মান করে চলতেন। এখানেই কিছুটা হলেও পিছিয়ে নরেন্দ্র মোদি।

More Articles