৬১ বছর ছিল গোপনে, নোবেলজয়ী মেরি কুরিকে কেন শোয়ানো হয় সীসার কফিনে?
Marie Curie Death: কুরি যখন মারা যান, তখন তাঁর শরীর এতটাই তেজস্ক্রিয় ছিল যে তাঁকে সীসা দিয়ে তৈরি কফিনে শুইয়ে কবর দিতে হয়েছিল।
রেডিও অ্যাক্টিভিটি বা তেজস্ক্রিয়তা। পদার্থবিজ্ঞানের বিপজ্জনক বাঁক বদলের অন্যতম ঘটনা এই তেজস্ক্রিয়তা, আর এই আবিষ্কারের নেপথ্যে রয়েছেন মেরি কুরি। তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে তাঁর অগ্রণী কাজের জন্য মেরি কুরির নাম শোনেননি এমন পাঠক, পড়ুয়া কমই। এই আবিষ্কারের জন্য দু'টি নোবেল পুরস্কারই স্রেফ অর্জন করেননি, 'আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের মা' হিসাবে স্বীকৃতিও পেয়েছেন মেরি কুরি। এতদূর অবধি সকলেরই জানা। কিন্তু অনেকেই জানেন না, এই আবিষ্কার মেরি কুরির কবর অবধি তাড়া করেছিল তাঁকে। তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে বৈজ্ঞানিক উত্তরাধিকার মেরি পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু মুদ্রার উল্টোপিঠে ছিল আরেক অবাক করা ঘটনা। তেজস্ক্রিয় উপাদান পোলোনিয়াম এবং রেডিয়াম নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এই পদার্থগুলি তাঁর শরীরে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে যায়।
মেরি কুরিই প্রথম মহিলা হিসেবে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন। শুধু তো তাই নয়, মেরি কুরিই একমাত্র মহিলা যিনি দু'টি ভিন্ন ক্ষেত্রে পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৮৯৬ সালে, ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী হেনরি বেকারেল আবিষ্কার করেছিলেন যে, ইউরেনিয়াম লবণ এমন রশ্মি নির্গত করে যা বস্তুর মধ্য দিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে, খানিকটা এক্স-রে-এর মতো। এই আবিষ্কারটিই কুরিকে তাঁর গবেষণার দিকে এগিয়ে দেয়। বেকারেলের ফলাফলগুলির আরও গভীরে যেতে চান কুরি। মেরি কুরি এবং তাঁর স্বামী পিয়েরে কুরি এই নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং ১৮৯৮ সালে দু'টি নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল রেডিয়াম এবং পোলোনিয়াম আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারের ফলে কুরি ১৯০৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানের জন্য নোবেল পুরস্কারের অর্ধেক পুরস্কার পান। বাকি অর্ধেক পুরস্কার পান বেকারেল।
আরও পড়ুন- নোবেলের জন্য চার বার মনোনয়ন! বাংলাতেই তবু জাতের লড়াইয়ে কোণঠাসা ছিলেন মেঘনাদ সাহা
১৯০৬ সালে প্রয়াত হন পিয়েরে কুরি, হঠাৎই। ব্যক্তিগত শোক বিজ্ঞানের পথ থেকে মেরি কুরির সাধনাকে সরিয়ে রাখেনি অবশ্য। ১৯১১ সালে, বিশুদ্ধ রেডিয়াম বিচ্ছিন্ন করার জন্য কুরিকে রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। তিনি তাঁর গবেষণাকে তেজস্ক্রিয় পদার্থের রসায়নের দিকটি বিশ্লেষণের পাশাপাশি ওষুধে তাদের প্রয়োগের জন্য উত্সর্গ করেন। মেরি কুরি এই কাজটি যদি না করতেন, ক্যান্সারের জন্য আমাদের আজকের দিনের চিকিত্সা সম্ভবই হতো না। কিন্তু তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও, এই পদার্থগুলির সঙ্গে দীর্ঘকাল কাটানোর ফলে মেরি কুরির দেহে পড়েছিল ভয়াবহ প্রভাব।
মেরি কুরি প্রয়াত হন ১৯৩৪ সালের ৪ জুলাই। বিকিরণ নিয়ে কাজ করার কারণে অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া হয়ে মারা যান মেরি কুরি। অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া সাধারণ রক্তাল্পতার চেয়ে অত্যধিক জটিল। এটি রক্তের এক বিরল অবস্থা, এই অবস্থাতে অস্থি মজ্জা শরীরের সঠিকভাবে কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত নতুন রক্তকণিকা তৈরি করতে পারে না। কুরি যখন মারা যান, তখন তাঁর শরীর এতটাই তেজস্ক্রিয় ছিল যে তাঁকে সীসা দিয়ে তৈরি কফিনে শুইয়ে কবর দিতে হয়েছিল। এই সেদিন অবধি বিষয়টি অবশ্য কেউই জানতেন না। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত মেরি কুরির কফিনের গল্প ছিল মানুষের জ্ঞানের পরিধির ঢের গভীরে, গোপনে। ১৯৯৫ সালে প্রথম তাঁর কফিনটি বের করা হয়েছিল।
সেই সময়ে, ফরাসি কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞানে তাঁদের অবদানের সম্মানে এবং ফরাসি ইতিহাসের কিংবদন্তি হওয়ার জন্য মেরি কুরি ও পিয়েরে কুরির কফিন প্যান্থিয়নের জাতীয় সমাধিতে স্থানান্তর করতে চেয়েছিল। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মৃতদেহের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সম্পর্কে উদ্বেগ নিয়ে ফরাসি বিকিরণ সুরক্ষা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং কবরস্থানে কর্মীদের সুরক্ষার জন্য সাহায্য চান।
আরও পড়ুন- হেলায় নোবেল প্রত্যাখ্যান! ব্যতিক্রম তৈরি করেছিলেন যাঁরা
যখন কবর খোঁড়ার কাজে কর্মীরা কুরিদের কবরের কাছে আসেন, তারা বাতাসে স্বাভাবিক মাত্রার বিকিরণ শনাক্ত করেন। কবরটি খোলার সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিমাণটি বেড়ে যায় (যদিও খুব বেশি পরিমাণে নয়)। প্রথমে, মেরি কুরির কফিনটি কাঠের তৈরি বলেই মনে হয়েছিল, কিন্তু যখন খোলা হয়, তখন তারা দেখতে পান যে এতে ২.৫ মিলিমিটার (০.০৯ ইঞ্চি) সীসার প্রলেপ দেওয়া রয়েছে। মেরি কুরির দেহের পরবর্তী পরীক্ষায় জানা যায়, উল্লেখযোগ্যভাবে সংরক্ষিত ছিল তাঁর দেহ এবং অল্পমাত্রায় আলফা ও বিটা দূষণও শনাক্ত করা গিয়েছিল। ব্রিটিশ সোসাইটি ফর দ্য হিস্ট্রি অব রেডিওলজির জার্নাল অনুযায়ী, এর সম্ভাব্য কারণ ছিল, মেরি কুরি পরবর্তী জীবনে বিকিরণের সরাসরি সংস্পর্শে আসার বিষয়টি সীমিত করার পদক্ষেপ করেছিলেন।
১০০ বছর পরেও, আসবাবপত্র, রান্নার বই, জামাকাপড় এবং পরীক্ষাগারে তাঁর নোট সহ কুরির অনেক জিনিসপত্রই অত্যন্ত তেজস্ক্রিয় থেকে যায়। এই নোটগুলিও প্যারিসের ফ্রান্সের বিবলিওথেক ন্যাশনালের সীসাযুক্ত বাক্সে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই জিনিসগুলি দেখতে হলে এখন দর্শকদের একটি বন্ডে সই করতে হয় এবং রেডিয়াম-২২৬-এর সংস্পর্শ রোধ করতে প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরতে হয়।