হুইলচেয়ারে বসেই পাথর ছুড়ে প্রতিবাদ! বিশ্বকে ধাক্কা দেয় প্যালেস্তাইনের যে লড়াই
Israel Palestine War : গাজা উপত্যকা এবং ইজরায়েলের মধ্যে চলা যুদ্ধে হুইলচেয়ারে বসা এক প্রতিবন্ধী প্যালেস্তিনিয়কে পাথর ছুড়তে দেখা যায়।
দিনটা ছিল ২০০০ সালের ২৯ অক্টোবর। এর ঠিক একমাস আগে ইজরায়েলের বিরোধীদলীয় নেতা এরিয়েল শ্যারন হারাম আল-শরিফ ভ্রমণে যান। শ্যারনের এই ভ্রমণকে 'উস্কানিমূলক' আচরণ হিসেবেই দেখা হয়েছিল তখন। হারাম আল-শরিফ জেরুজালেমের 'টেম্পল মাউন্ট কমপ্লেক্স' নামেও পরিচিত। এখানেই অবস্থিত আল-আকসা মসজিদ, ইসলামের সবচেয়ে সংবেদনশীল এবং পবিত্র স্থানগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে এই মসজিদ। লেবাননের একটি ফিলিস্তিনি শিবিরে ১৯৮২ সালের গণহত্যায় ভূমিকা ছিল শ্যারনের। তাই তাঁর এই সফরের তীব্র নিন্দা করে ফিলিস্তিনিরা। বিক্ষোভ ও হিংসার ঢেউ ওঠে প্যালেস্তাইন জুড়ে। আর বিক্ষোভের অস্ত্র হয় পাথর! ইজরায়েল আর প্যালেস্টাইনের যুদ্ধে হুইলচেয়ারে বসে ইজরায়েলি সেনার দিকে পাথর ছোড়ার দৃশ্য আবার ফিরে এসেছে চোখের সামনে। মনে করিয়ে দিচ্ছে ২৩ বছর আগের সেই ঘটনা।
২০০০ সালের ওই ঘটনায় বিক্ষোভকারীদের মধ্যেই বছর ১৪-র এক প্যালেস্তানিয় কিশোরও ছিল। গাজার একটি ইহুদি চৌকির কাছে ইজরায়েলি সেনাদের দিকে ঢিল ছুড়ছিল সে। দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের একজন চিত্রগ্রাহক এই কিশোরের ছবি তোলেন সেই সময়। ডান হাতে পাথর নিয়ে তাক করে রয়েছে একটি ইজরায়েলি ট্যাঙ্কের দিকে। ইজরায়েলের হামলা, ইজরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্যালেস্তানিয় প্রতিরোধের চেতনাকে ফুটিয়ে তুলেছিল সেই ছবি।
ইজরায়েলি সৈন্যদের দিকে ঢিল ছোড়ার কাজটি ফিলিস্তিনিদের কাছে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে। ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পাথর হাতে মূলত পুরুষদের সম্মিলিত এই প্রতিরোধকে অনেকে বাইবেলের শত্রু ডেভিড এবং গোলিয়াথের সঙ্গেও তুলনা করে। কাফিয়াহের মতো, খোপকাটা আরব স্কার্ফ ফিলিস্তিনিরা কখনও সখনও মুখ ঢাকতে আর কাঁদানে গ্যাসের থেকে বাঁচতে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে। এই স্কার্ফ আর পাথর ছোঁড়া ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব পরিচয় হয়ে ওঠে।
রাইফেল, কামানের মুখে স্রেফ পাথর? পরাজয় তো অনিবার্য। আসলে ইজরায়েলি সৈন্যদের পরাস্ত করতে এই পাথর ব্যবহার করা হয় না। দীর্ঘদিনের হতাশা এবং অনিবার্য পরাজয়ের মুখে দাঁড়িয়েও যে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সম্ভব, প্যালেস্টাইনের সেই আশার প্রতীক এই পাথর। হাতে ছোড়া পাথর, গুলতি দিয়ে ছোড়া পাথর।
আরও পড়ুন- পবিত্র দিনেই কেন খুন ইজরায়েলের সাধারণ মানুষ? কারা এই হামাস, কী-ই বা তাদের লক্ষ্য?
পাথর সঠিক জায়গায় লাগলে অবশ্য মৃত্যুও হতে পারে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে, পূর্ব জেরুজালেমে গাড়িতে ঢিল ছুড়তে থাকা ফিলিস্তিনিদের একটি দলের হামলায় ৫০ বছর বয়সি একজন ইজরায়েলি ব্যক্তি নিহত হন। কারও মাথায় এই পাথরের আঘাত লাগলে সহজেই তাঁর মৃত্যু হতে পারে, যে কারণে ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী পাথর ছোঁড়া এই বাহিনীকে যথেষ্ট গুরুত্বই দেয়। ২০১৫ সালে ইজরায়েলি সংসদ বিক্ষোভকারীদের পাথর ছোঁড়া ঠেকাতে পাথর নিক্ষেপকারীদের সাজা কঠোর করার পক্ষে ভোট দেয়।
গাজা উপত্যকা এবং ইজরায়েলের মধ্যে চলা দীর্ঘদিনের যুদ্ধের আবহেই, ২০১৮ সালে হুইলচেয়ারে বসা এক প্রতিবন্ধী প্যালেস্তিনিয়কেও পাথর ছুড়তে দেখা যায়। সাবের আল-আশকার নামের ওই বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তির ছবিটি অদ্ভুত ধাক্কা দিয়েছিল বিশ্বকে। গাজার বাফার জোনে, চারপাশে জ্বলন্ত টায়ার থেকে ওঠা কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মধ্যে হুইলচেয়ারে বসেই পাথর ছুড়ছিলেন তিনি ইজরায়েলি স্নাইপারদের দিকে। বয়স ছিল মাত্র ২৯। দেখতে অবশ্য অনেক বেশি বয়স্ক মনে হয়। একটি বাসে চেপে আসেন তিনি, বন্ধুরা তাঁকে নামিয়ে নেয় বাস থেকে। তারপর প্রতিবাদের স্থানে যান তিনি। সেখানে আরও দু'জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিও ছিলেন, নিয়মিত বিক্ষোভ দেখাতেন তারা। কিন্তু ইজরায়েলি সেনা তাদের হত্যা করে।
যে কিশোরটি ২০০০ সালের সেই দিনটিতে ঢিল ছুঁড়েছিল, এখন সবাই তাঁকে চেনে ফারিস ওদেহ নামে। ফারিস ওদেহ একজন উদাহরণ। ইজরায়েলকে পাথর ছুড়লে কী ফল হতে পারে ইজরায়েল এক সপ্তাহের মধ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছিল। গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল ১৪ বছরের ওই কিশোরকে। তবু ফিলিস্তিনিরা থামেনি। কামানের মুখে পাথর ছুঁড়েই নিজেদের ভূখণ্ডে নিজেদের বাঁচার অধিকার ফিরে পেতে চেয়েছে।