কেন ঘুমের জন্য ওষুধের দরকার পড়ল মানুষের? অবাক করবে স্লিপিং পিল আবিষ্কারের ইতিহাস
Sleeping Pills: প্রথম দিকে ব্যবহার হওয়া ঘুমের ওষুধগুলি বেশি মাত্রায় নিলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটত। তাই ঘুমের ওষুধ হিসেবে বারবিটিউরেটস, মিথ্যাঅ্যাক্যুয়ালুন এবং গ্লুটেথিমাইডের ব্যবহার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে।
ধরুন, আপনার কয়েক রাত ভালো ঘুম হচ্ছে না। আপনার বন্ধু বা অফিস কলিগ পরামর্শ দিলেন, কয়েক পেগ অ্যালকোহল সেবন করে ঘুমিয়ে পড়লেই জব্বর ঘুম হবে। আপনি সেই মতো কয়েক পেগ অ্যালকোহল পেটে ঢেলেও ফেললেন এবং সুহৃদের পরামর্শ মতোই খুব শিগগির চোখ জুড়ে এল ঘুমে। আপনি গভীর ঘুমে ঢলে পড়লেন। কিন্তু দেখা গেল রাত্রির দ্বিতীয় ভাগে আপনার ঘুম পাতলা হয়ে এসেছে, বিভিন্ন ধরনের স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন দেখে আপনার ঘুমে আবার সেই ব্যঘাত ঘটছে। এখন আপনি কাকে দুষবেন? আপনার সেই বন্ধুটিকে, যিনি আপনাকে মদ্যপান করতে বলেছিলেন নাকি সরাসরি অ্যালকোহলকেই?
আপনি খুব সম্ভবত প্রথম কাজটিই করবেন। তবে ক্ষান্ত হন, শান্ত হন। দোষ আপনার সেই বন্ধুটির নয়। দোষ অ্যালকোহলেরই। যাকে বহু কাল আগে থেকেই ঘুমের ‘ওষুধ’ হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন বেশিরভাগ মানুষই। তার কারণ শরীরে প্রবেশের কিছুক্ষণ পরেই অ্যালকোহল ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করে। তার সেই মাদকগুণ সে হারিয়ে ফেলে। আর তার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে আপনার ঘুমও পাতলা হয়ে আসে।
তবে শুধু অ্যালকোহল নয়, বহু কাল আগে থেকেই ঘুমের ওষুধ হিসেবে মানুষ ওপিয়েটের মতো জিনিস ব্যবহার করে এসেছে। এবং তাও অ্যালকোহলের মতোই ব্যর্থ হয়েছে। একই কথা খাটে পপি থেকে উদ্ধার করা মরফিন বা হেরোইনের ক্ষেত্রেও। ঘুমের ওষুধ হিসেবে তারাও ব্যর্থ হয়েছে। যদিও আমাদের অনেকের মধ্যেই ভুল ধারণা রয়েছে যে, অ্যালকোহল, ওপিয়েট বা মরফিনের মতো রাসায়নিক আমাদের গভীর ঘুম আনতে পারে। আর এই প্রতিবেদন পড়তে পড়তে এই মুহূর্তে এসে আপনার জানতে ইচ্ছে করে, তাহলে ঘুমের ওষুধ কোনটি? সেই জটিল গল্প বলার আগে না হয় জানা যাক কীভাবে ধাপে ধাপে তৈরি হল ঘুমের ওষুধ। ঘুমের ওষুধ আবিষ্কার হল কীভাবে?
আরও পড়ুন- কতটা নিরাপদ আইটির চাকরি! চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল ফেসবুক, টুইটার, বাইজুস, হটস্টারের ছাঁটাই
ফিরে যাওয়া যাক উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। বলা যেতে পারে, সেই সময়েই ক্লোরাল হাইড্রেটের সন্ধান পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নব্য যুগের ঘুমের ওষুধ আবিষ্কারের অধ্যায়ের সূচনা হয়। অন্যদিকে ডাক্তারি ও চিকিৎসার পরিসরে বারবিটিউরেটস তৈরি করা শুরু হয় বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। বারবিটিউরেটসের পাশাপাশি মিথ্যাঅ্যাক্যুয়ালুন এবং গ্লুটেথিমাইড ব্যবহার করা শুরু হয়। ব্যবহার এতটাই বহুলভাবে বাড়তে থাকে যে এক সময় বিভিন্ন ব্যক্তি এই ঘুমের ওষুধগুলির উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠেন। অর্থাৎ এই ওষুধগুলি না পেলে তাঁদের ঘুমই আসে না। শুধু তাই নয় এদের কার্যকারিতাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমতে শুরু করত। আর অন্যদিকে এই ওষুধগুলি খাওয়া বন্ধ করে দিলেও দেখা যেতে শুরু করল গুরুতর কিছু সমস্যা। যাকে চিকিৎসার ভাষায় উইথড্রল সিন্ড্রোম বলে।
প্রথম দিকে ব্যবহার হওয়া ঘুমের ওষুধগুলি বেশি মাত্রায় নিলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটত। তাই ঘুমের ওষুধ হিসেবে বারবিটিউরেটস, মিথ্যাঅ্যাক্যুয়ালুন এবং গ্লুটেথিমাইডের ব্যবহার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। এর পরে এল বেঞ্জোডায়াজেপিন। বেঞ্জোডায়াজেপিনের আবিষ্কার বেশ মজার। একটি ওষুধনির্মাণকার্রী সংস্থার গবেষক ছিলেন লিও স্টার্নব্যাক। তখন ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি সময়। লিও ঘুমের ওষুধ বানানোর একটি গবেষণামূলক প্রকল্পে কাজ করছেন। লিওর উদ্দেশ্য এমন একটি রাসায়নিককে খুঁজে বের করা যার বার্বিচুরেটসের মতো ঘুমপাড়ানি গুণ থাকবে, অথচ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ডোজ় নিয়ে ফেললেও বিশেষ ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না শরীরে। কিন্তু সেই গবেষণায় বিশেষ সাফল্য না পেয়ে লিও গবেষণায়টি ছেড়ে অন্য গবেষণায় মন দেন।
বেশ কয়েক বছর বাদে, ওই ১৯৫৭ নাগাদ তিনি পুরনো রাসায়নিকের বোতল পরিষ্কার করছিলেন নিজের ল্যাবে বসে। দেখলেন তাঁকে চল্লিশটি বোতল পরিষ্কার করতে হবে। তিনি নিজের সহকারীকে বললেন বোতলগুলি পরিষ্কার করার আগে, তাতে যে রাসায়নিকগুলি আছে, সেগুলির প্রত্যেকটি ল্যাবের প্রাণীদের শরীরে প্রয়োগ করে দেখতে। ঊনচল্লিশটি রাসায়নিক ল্যাবের প্রাণীদের শরীরে কোনও প্রভাব ফেলেনি। আশ্চর্য জাগায় বাকি একটি রাসায়নিক, যার প্রয়োগে ল্যাবের প্রাণীটি ঘুমিয়ে পড়ে। দেখা যায়, এই রাসায়নিকটিই ক্রিস্টালের রূপে বোতলে পড়ে আছে। যার শুধু ঘুমপাড়ানি গুণই নেই, সে পাশাপাশি খিঁচুনি বা কনভালশন আটকায়, এমনকী পেশিকেও আরাম দেয়।
আরও পড়ুন- মানুষ এক ছোবলেই ছবি! তবে কোন রহস্যে সাপের তীব্র বিষেও বেঁচে যায় বন্য প্রাণীরা?
তারপরে আর খুব বেশি সময় লাগেনি, বেঞ্জো়ডায়াজে়পিন ট্রাঙ্কুলাইজা়র লিব্রিয়াম নামে রাসায়নিকটি বাজারে বিক্রি হতেও শুরু করে। তার দশ বছরের মধ্যেই বেঞ্জো়ডায়াজে়পিনের নাম ঘুমের ওষুধ হিসেবে প্রেসক্রিপশনেও লিখতে শুরু করেন ডাক্তাররা। ১৯৭০ সালে যখন আনুষ্ঠানিক ভাবে বেঞ্জো়ডায়াজে়পিন বাজারে বিক্রি হওয়া শুরু হলো, তখন সেটি ফ্ল্যুরাজে়পাম নামে বিক্রি হতো। যদিও খারাপের থেকে ভালো দিকই বেশি ছিল বেঞ্জো়ডায়াজে়পিনের, তাও দেখা গেল মানুষ বেশিদিন ব্যবহারে এদের প্রতি নির্ভরশীলতা গড়ে তুলছে। যা মোটেই কাম্য ছিল না। পাশাপাশি দিনের বেলা ঘুমের জন্যও অনেকে সেবন করছেন এই ওষুধ, এমনটাও দেখা যেত। আশির দশকের শেষের দিকে এদের ব্যবহার কমে যেতে শুরু করলেও, এদের ব্যবহার এখনও পৃথিবী জুড়েই দেখা যায়।
১৯৮৮ সালে ইউরোপে বেঞ্জো়ডায়াজে়পিনের জায়গা নেয় জ়লপিডেম। তারও পাঁচ বছর বাদে অর্থাৎ ১৯৯৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জ়লপিডেম বিক্রি হতে শুরু করে। এই সমস্ত রাসায়নিকের মধ্যে একটি মিল ছিল। এরা প্রত্যেকেই গামা-অ্যামাইনো বিউটাইরিক অ্যাসিডের কাজে সাহায্য করে। কিন্তু একদম সাম্প্রতিক ঘুমের ওষুধগুলির মূল কাজ ভিন্ন প্রকারের। তাদের মধ্যে কেউ মেলাটোনিন রিসেপ্টরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে কাজ করে, কেউ বা ওরেক্সিনের মতো নিউরোট্রান্সমিটার- যার মূল কাজ আমাদের জাগিয়ে রাখা, তার কাজকে বাধা দিয়ে ঘুমপাড়ানির কাজ করে। মোদ্দা কথা হল, ঘুম পাড়ানোর জন্য একটি নয় একাধিক ওষুধ তৈরি হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।
আমরা যে সময়ে বাস করি, এই সময় মলিকিউলার মেডিসিনের, এই সময় পার্সোনালাইজ়ড মেডিসিনের। কয়েক বছরের মধ্যে হয়তো দেখা গেল, এক একজনের শরীরের জন্য মানানসই হিসেবে ব্যক্তি বিশেষে আলাদা আলাদা ঘুমের ওষুধ তৈরি করা হচ্ছে।