ট্রাম্প থেকে মমতা: ইচ্ছাকৃভাবেই নেতারা উদ্ভট কথা বলেন, নাটুকেপনা করেন?

Mamata Banerjee Gibberish Speech: মনমোহন সিং তাঁর সততা ও কাজের জন্য প্রশংসিত হওয়ার বদলে ‘মৌন মোহন’ বলে অভিহিত হয়েছেন, জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁদের দু-একটা আলগা উক্তির জন্য সারাজীবন সমালোচিত হয়েছেন।

যে কোনও গণতন্ত্রেই সরকার আর রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর সম্মুখীন হওয়া, দেশ বা সমাজকে সঠিকভাবে চালনা করা। কিন্তু অনেক সময়েই রাজনীতি শুধুমাত্র দেশ চালানোর কাজ হিসেবে না থেকে বিনোদনেরও অংশ বিশেষ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে, প্রায়শই এক ধরনের রাজনীতিবিদ ইচ্ছাকৃতভাবে উদ্ভট কথা বলে বা নাটকীয় আচরণ করে জনতার দৃষ্টি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিষয় থেকে সরিয়ে দেন। অমন অস্বাভাবিক বক্তব্য আর হাস্যকর কার্যকলাপের মাধ্যমে তাঁরা আলোয় তো আসেনই, অনেক সময় নিজেদের ব্যর্থতা আর দুষ্কর্মগুলোকে আড়াল করতেও সক্ষম হন। 

আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ধরনের নেতাদের আচার-আচরণের বিরুদ্ধে মানুষের কোনও প্রকৃত ক্ষোভ সাধারণত তৈরি হয় না। তাঁরা নিছক মজার পাত্র হয়ে ওঠেন, তাঁদের নাটুকেপনা নিয়ে বড়জোর তর্কবিতর্ক চলে, মিম তৈরি হয় কিন্তু তাঁদের অনৈতিক ব্যবহার অথবা দুর্বল শাসনব্যবস্থার বিশদ পর্যালোচনা করার কথা কারও মনেই আসে না। অন্যদিকে, যাঁরা সিরিয়াস রাজনীতিতে মনোযোগী, তাঁদের ছোটখাটো ভুলও কঠোরভাবে বিচার করা হয়। সব মিলিয়ে যেসব রাজনীতিবিদ সফলভাবে উদ্দেশ্যপূর্ণ ভাঁড়ামো করতে পারেন, তাঁদের জনগণের কাছে জবাবদিহির দায় থাকে খুবই সামান্য।  

এই প্রবণতা অবশ্য সারা বিশ্বেই দেখা যায়। আমেরিকার জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রায়ই হাস্যকর সব ভুলভাল কথা বলতেন, যা নিয়ে মিডিয়া ও সাধারণ মানুষ মজা পেয়েছে, টক শোয়ে তাঁর বক্তব্য নিয়ে হাসাহাসি হয়েছে। অথচ তাঁর শাসনকালে মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ইরাক আক্রমণ এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু নিয়ে তেমন কোনও শক্তিশালী জনরোষ মার্কিন দেশে তৈরিই হয়নি। ব্রিটেনের বরিস জনসনও তাঁর বোকাসোকা ভাবমূর্তি দিয়ে গণমাধ্যমকে ব্যস্ত রেখেছেন। তাঁর এলোমেলো চুল, জড়ানো কথাবার্তা, কখনও আবার হাফপ্যান্ট পরে সাংবাদিকদের চা খাওয়ানো— এসব নিয়ে এত আলোচনা হয়েছে যে, তাঁর বর্ণ-বৈষম্যবাদী ব্যবহার, ব্রেক্সিট-বিপর্যয় ও সরকারের দুর্নীতিগুলো সব চাপা পড়ে গেছে।

বরিস জনসন

আরও পড়ুন- অক্সফোর্ডে ৪৩ মিনিটের বক্তব্যে কোথায় গোলালেন, কোথায় ছক্কা হাঁকালেন মমতা?

ভারতেও অবশ্য এই কৌশল অনেকদিন আগে থেকেই ব্যবহৃত হচ্ছে। লালু প্রসাদ যাদব সম্ভবত এর প্রথম সফল উদাহরণ। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী বা দেশের রেলমন্ত্রী থাকার সময় তিনি তাঁর রসিকতা, নাটুকে ভাষণ, আর মজার ভঙ্গির মাধ্যমে নজর কাড়তেন। সংবাদমাধ্যম তাঁর কথাবার্তা নিয়ে মশগুল থাকত, অথচ তাঁর গোশালা কেলেঙ্কারি সেই সময় মিডিয়াতে তেমনভাবে গুরুত্ব পায়নি। একই প্রবণতা দেশের শীর্ষস্তরের নেতৃত্বেও দেখা গেছে। নরেন্দ্র মোদি সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে বলেন, "ক্লাউড কভার থাকলে রাডার ঠিকমতো কাজ করবে না" — আর মানুষ তাতে মজা পায়, অনেকে ঠাট্টা করে। কিন্তু আসল প্রশ্ন ওঠে না যে একজন প্রধানমন্ত্রী যদি প্রযুক্তিগতভাবে এত বড় ভুল ধারণা পোষণ করেন, আর তাঁকে সেকথা বলার কেউ না থাকে, তাহলে তিনি কীভাবে সঠিক সামরিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন? আবার, কোভিডের সময় যখন জনগণকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থালা বাজানোর পরামর্শ দেওয়া হয়, তখন সেটি কতটা কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন না উঠে পুরো ঘটনাটি একপ্রকার ভাঁড়ামির উৎসবে পরিণত হয়।

লালু প্রসাদ যাদব

পশ্চিমবঙ্গে এই অস্ত্রটি আরও নিখুঁতভাবে ব্যবহার করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নেতৃত্বে রাজ্যের অর্থনৈতিক মন্দা, শিল্পহীনতা, ভয়াবহ নির্বাচনী হিংসা, আর প্রশাসনিক দুর্নীতির মতো গুরুতর সমস্যাগুলো সমাজে অথবা সমাজমাধ্যমে সঠিকভাবে আলোচিত হয় না। বরং এইসবের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর নাটকীয় প্রতিক্রিয়াগুলোই মূল আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। সম্প্রতি অক্সফোর্ডে এক ভাষণে রাজ্যের আগেকার এবং এখনকার অর্থনীতি বিষয়ে তিনি যে নানা তথ্য তুলে ধরেছেন, তার সত্যতা আর সারবত্তা নিয়ে বহু প্রশ্ন তোলা সম্ভব। কিন্তু সব ছাপিয়ে মানুষ এবং মিডিয়ার সামনে বড় হয়ে উঠেছে ওঁর এক পুরনো ছবি দু'হাতে তুলে দাঁড়িয়ে থাকার অস্বাভাবিক দৃশ্য!

আগেও, এক ছাত্রী যখন সরকারের মন্ত্রীদের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তখন তিনি প্রকাশ্যে ওই ছাত্রীকে ‘মাওবাদী’ বলে দাগিয়ে দিয়ে অনুষ্ঠান ছেড়ে বেরিয়ে যান! এই দাগিয়ে দেওয়া কিন্তু নেহাৎ হঠকারিতা নয়। কারণ তখন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে মুখ্যমন্ত্রীর আচরণ, আর সেই ছাত্রীর প্রশ্নের আসল গুরুত্ব হারিয়ে যায়। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি যখন বলেন, "এগুলো সব সাজানো ব্যাপার", তখন সাময়িক হইচই হয় বটে কিন্তু নারীদের সুরক্ষায় প্রশাসনের ব্যর্থতা নিয়ে কোনও গভীর অনুসন্ধান হয় না। একইভাবে, তিনি নিজস্ব ভঙ্গিতে চিটফান্ডের টাকা ফেরানোর জন্য সিগারেটের ওপর ট্যাক্স বাড়িয়ে লোকজনকে সিগারেট একটু বেশি খেতে বলেন। আপাতদৃষ্টিতে এমন মন্তব্য হয়তো দায়িত্বহীন মনে হয়, সাধারণ মানুষ তাই নিয়ে হাসাহাসি করে, মিম বানায় কিন্তু চিটফান্ডের টাকা কার বা কাদের পকেটে ঢুকেছে, সেই প্রশ্ন সবাই ভুলে যায়। 

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

আরও পড়ুন- মহিলাদের খেলা থেকে কেন রূপান্তরকামীদের নিষিদ্ধ করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প?

এই ধরনের নেতাদের একটি বিশেষ সুবিধা হলো, তাঁদের ব্যক্তিগত চরিত্রের বিভিন্ন গোঁজামিল ও নৈতিক বিচ্যুতি প্রায়ই তাঁদের কৌতুকপূর্ণ আচরণের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। সাধারণত কোনও রাজনীতিবিদের অবৈধ সম্পর্ক, দুর্নীতি, বা অনৈতিক কাজ প্রকাশ্যে এলে সেটি নিয়ে বিশাল বিতর্ক হয়। কিন্তু যাঁরা আগেই নিজেদের হাস্যকর বা লঘুচরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাঁদের এইসব কেলেঙ্কারি নিয়েও জনতার প্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে হালকা থাকে। ব্রিটেনে বরিস জনসনের একাধিক অবৈধ সম্পর্কের খবর এসেছে, লকডাউনের সময় পার্টি করার মতো গুরুতর নৈতিক বিচ্যুতি প্রকাশ্যে এসেছে কিন্তু এগুলো নিয়ে কেবল কিছুদিন ঠাট্টা হয়েছে, বড় ধরনের রাজনৈতিক মূল্য জনসনকে দিতে হয়নি। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কর ফাঁকি, নারী বিদ্বেষমূলক মন্তব্য, এমনকী ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে, কিন্তু তাঁর অদ্ভুত কথা বলা ও হাস্যকর নাটকীয়তার কারণে এইসব অভিযোগ অনেকটাই আড়ালে থেকে গেছে।

পশ্চিমবঙ্গে অনুব্রত মণ্ডল দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে গুড়-বাতাসা খাওয়ানো অথবা পুলিশকে বোমা মারার মতো বহু অদ্ভুত মন্তব্য করেছেন। এমনকী তদন্তের মুখেও তিনি নানা হাস্যকর কাণ্ড করেছেন, যা মিডিয়াকে ব্যস্ত রেখেছে। কিন্তু তাঁর গরু পাচার, বারবার লটারি পাওয়া বা অন্যান্য আর্থিক দুর্নীতির গভীরে প্রবেশের খুব একটা চেষ্টা মিডিয়া করেনি। নিজের ভোটকেন্দ্রের বাইরে মদন মিত্রের জনপ্রিয়তা মূলত তাঁর চটুল কথাবার্তা, গান, ও ভিডিও ক্লিপের মাধ্যমে। মানুষ তাঁর এই মজাদার রূপ পছন্দই করে, ফলে সারদা কেলেঙ্কারির মতো গুরুতর দুর্নীতিতেও তাঁর বিরুদ্ধে জনরোষ তেমন তীব্র হয় না। অথচ মানুষের অগোচরেই নেতাদের এই কৌশল জনগণের বিচারবুদ্ধির সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। এর ফলে ব্যক্তি বা রাজনৈতিক চরিত্রের ব্যর্থতা কম গুরুত্ব পায়, বরং সেই ব্যক্তি বিনোদনের উৎস হয়ে ওঠেন।

এই কৌশল মূলত ডানপন্থী জনপ্রিয়তাবাদী (রাইট-উইং পপুলিস্ট) রাজনীতিবিদদের মধ্যেই বেশি লক্ষ্য করা যায়। এর একটি বড় কারণ হলো, এই নেতারা সাধারণত যুক্তিসঙ্গত ও দীর্ঘমেয়াদি নীতির বদলে আবেগনির্ভর এবং তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা অর্জনকারী রাজনীতি করেন। তাঁরা বাস্তব সমস্যা সমাধানের বদলে জনতাকে উত্তেজিত করার কৌশল নেন এবং তার ব্যর্থতা ঢাকতে নাটকীয়তার আশ্রয় নেন। ট্রাম্প থেকে বরিস জনসন, মোদি থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় — সবাই যুক্তিযুক্ত সমালোচনা এড়াতে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপকে অস্ত্র করেন আর ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে’ ধরনের নাটকীয় দাবি তোলেন। এই কারণেই বরিস জনসনের ব্রেক্সিট ভুল, ট্রাম্পের কর ফাঁকি, মোদির নোটবন্দি ব্যর্থতা বা মমতার প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা নিয়ে গভীর আলোচনা কম হয়, বরং তাদের নাটকীয় মন্তব্য ও কর্মকাণ্ডের দিকেই মানুষের মনোযোগ আটকে থাকে। একই সঙ্গে, যেহেতু এই ডানপন্থী জনপ্রিয়তাবাদীরা যুক্তিপূর্ণ আলোচনাকে 'প্রতিষ্ঠানভিত্তিক' বলে বিরোধিতা করেন, তাই ভাঁড়ামো তাঁদের এক ধরনের রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে ওঠে, যা জনগণের বিচার করার মানদণ্ডকে ধীরে ধীরে ভোঁতা করে দেয়।

ডোনাল্ড ট্রাম্প

আরও পড়ুন- ২০২৪-এ ফিরে এল ২০১৯! কেন মমতারা বারবারই ‘বেলতলায়’ যান?

এর পেছনে একটি বড় কারণ মনস্তাত্ত্বিক — যাকে আচরণমূলক অর্থনীতিতে (বিহেভিয়ারাল ইকোনোমিক্স) বলা হয় ‘রেফারেন্স পয়েন্ট এফেক্ট’। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল কাহনেম্যানের তত্ত্ব অনুযায়ী, রেফারেন্স পয়েন্ট বা মানবিন্দু হল এক মানসিক প্রত্যাশার পরিমাপ, যার ভিত্তিতে মানুষ কোনও কিছুর ভালোমন্দ বিচার করে। আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমরা সাধারণত কারও সাফল্য-ব্যর্থতা কিংবা সততা-অসততাও নির্ধারণ করি নির্দিষ্ট একটি মানবিন্দুর সঙ্গে তুলনা করেই। যদি কোনও ব্যক্তির প্রতি শুরু থেকেই উচ্চ প্রত্যাশা থাকে, তবে তাঁর ছোটখাটো ভুলও বড় বলে মনে হয়, আর যদি কারও মানবিন্দুই নিচু হয়, তবে বড় ব্যর্থতাও স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয়। ক্রিকেট থেকে এর উদাহরণ দেওয়া যায়। ভারতের ঋষভ পন্থ কয়েক ম্যাচে ব্যর্থ হলেই দেশজুড়ে হায় হায় রব ওঠে, কারণ তার মানবিন্দু অনেক উঁচুতে। কিন্তু পাকিস্তানের উইকেটকিপার আজম খান পরপর ক্যাচ এবং স্টাম্প মিস করলেও মানুষ বিশেষ কিছু গা করেন না কারণ, তাঁর ক্ষেত্রে প্রত্যাশার স্তর বা মানবিন্দুই কম। রাজনীতিতেও ঠিক এই একই ঘটনা ঘটে। সিরিয়াস রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের যে উচ্চ প্রত্যাশা, সেটিই তাদের কঠোর সমালোচনার কারণ হয়ে দাঁড়ায় — সাধারণ মানুষ এবং মিডিয়া তাদের ছোটখাটো ব্যর্থতা বা বিচ্যুতিও বড় করে দেখেন। অন্যদিকে, যারা শুরু থেকেই উদ্ভট মন্তব্য করেন, হাস্যকর আচরণ করেন, তাদের বড় ব্যর্থতা বা কেলেঙ্কারিও জনগণের কাছে খুব স্বাভাবিক মনে হয়, ফলে তারা তুলনামূলকভাবে সমালোচিত হনও কম।

তাই কিছু ধূর্ত নেতারা এক বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক কৌশল নেন। নিজেরাই নিজেদের জন্য এক নিম্নমানের রেফারেন্স পয়েন্ট স্থাপন করেন। সাধারণ মানুষও তাদের কাছ থেকে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু আশা করেন না, বরং ধরেই নেন এরা এমনিই অদ্ভুত সব কথা বলবেন বা উল্টোপাল্টা কাজ করবেন। তাই তাঁরা যখন সত্যিই ভয়াবহ কোনও কাজ করে ফেলেন, তখনও সেটি খুব বড় বিষয় বলে মনে হয় না। জর্জ বুশ বা বরিস জনসনকে মানুষ খুব একটা গুরুত্ব সহকারে নেননি, তাই তাঁরা বিশাল ক্ষতি করেও শুধু ঠাট্টার বিষয় হয়েছিলেন। অথচ বারাক ওবামা যদি সামান্য ভুলও করতেন, সেটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতো। ভারতে মনমোহন সিং তাঁর সততা ও কাজের জন্য প্রশংসিত হওয়ার বদলে ‘মৌন মোহন’ বলে অভিহিত হয়েছেন, জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁদের দু-একটা আলগা উক্তির জন্য সারাজীবন সমালোচিত হয়েছেন কিন্তু নিয়মিত একের পর এক অসাংবিধানিক উক্তি করার পরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হাসি-ঠাট্টার বেশি কোনও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি। আসলে বারাক ওবামা বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা বিনোদনমূলক চরিত্র ছিলেন না, তাই তাঁদের নিয়ে মানুষের ধৈর্যও কম ছিল। অন্যদিকে, নিম্নমানের রেফারেন্স পয়েন্ট হওয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা ডোনাল্ড ট্রাম্পরা তাঁদের ধারাবাহিক নাটকীয়তার মাধ্যমে প্রশাসনিক দুর্বলতা বা অস্বাভাবিকতা ঢেকে রাখতে সক্ষম হন।

এই হতাশার দুষ্টচক্র থেকে বেরনোর উপায় কী? এর থেকে বের হতে হলে দায়িত্ব নিতে হবে জনগণকেই। সাধারণ মানুষের উচিত হবে রাজনীতিকে কেবল বিনোদন হিসেবে দেখা বন্ধ করা, আর প্রতি রাজনীতিবিদ অথবা নেতাকে একই মানবিন্দুতে বিচার করা। একই সঙ্গে, ভোট দেওয়ার সময় নিছক ভাঁড়ামোতে না ভুলে রাজনীতির নেতাদের জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। মিডিয়ারও তার নিজস্ব ভূমিকা বুঝতে পারা খুব জরুরি। শুধু নাটকীয় ভাষণ বা হাস্যকর মন্তব্য প্রচার না করে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে প্রশাসনিক ব্যর্থতাগুলো তাদের তুলে ধরতে হবে। তা যদি না হয়, তবে রাজনীতিতে আসল কাজের চেয়ে নাটকই বেশি গুরুত্ব পাবে, আর নির্বাচন এবং প্রশাসন ক্রমশ পরিণত হবে রাজসভার কূট-বিদূষক বেছে নেওয়ার খেলায়।

 

মতামত ব্যক্তিগত

আচরণমূলক অর্থনীতির নিরিখে একটি পর্যালোচনা

লেখক শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক

More Articles