এবার ইডির নজরে রাহুল সোনিয়া, কী পরিণতি অপেক্ষা করছে?

৭৫ বছর বয়সি সোনিয়া গান্ধীকে ৮ জুনের আগেই ইডি অফিসে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে, রাহুল গান্ধীকে হাজিরা দিতে হবে তারও আগে।

মোদি সরকারের অষ্টম বর্ষপূর্তির অব্যবহিত পরেই আবার নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলা। বহুদিন পুরনো এই মামলায় প্রধান অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছেন গান্ধী পরিবারের সদস্যরা। কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং তাঁর পুত্র রাহুল গান্ধী এই মামলার প্রধান অভিযুক্ত। এতদিন পর্যন্ত ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলা নিয়ে তদন্ত চললেও রাহুল গান্ধী কিংবা সোনিয়া গান্ধী কাউকেই তদন্তের খাতিরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তেমনভাবে ডাকেনি কোনও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। কিন্তু এবার সেই ট্রেন্ড বদলাতে চলেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট ওরফে ইডি। বুধবার তাঁদের বিরুদ্ধে শমন জারি করে, ইডি জানিয়ে দিয়েছে, এবারে ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় তদন্তের খাতিরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজিরা দিতে হবে কংগ্রেস সভানেত্রী এবং তাঁর পুত্রকে। ইডি সূত্রে খবর, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাটি প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট (পিএমএলএ) অনুযায়ী এই দুই কংগ্রেস নেতার বক্তব্য রেকর্ড করতে চলেছে।

৭৫ বছর বয়সি সোনিয়া গান্ধীকে ৮ জুনের আগেই ইডি অফিসে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে, রাহুল গান্ধীকে হাজিরা দিতে হবে তারও আগে, এমন কথা ছিল। কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভি একটি সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়েছেন, সোনিয়া গান্ধী এই শমনের ভিত্তিতে হাজিরা দিতে যথাসময়ে পৌঁছবেন, কিন্তু রাহুল গান্ধী যদি দেশে থাকেন, তাহলে তিনি যেতে পারবেন, নতুবা নয়। ইডি আদতে রাহুল গান্ধীকে তলব করেছিল ২ জুন। কিন্তু বিদেশে থাকায় রাহুল যাননি। এরপর বিদেশ সফরের কথা উল্লেখ করে নতুন তারিখ চান রাহুল। এবার ইডির তরফে বলা হয়, ১৩ জুন রাহুলকে ইডির আধিকারিকদের সামনে হাজির হয়ে তাঁর বক্তব্য রেকর্ড করতে হবে। অন্যদিকে, আগামী ৮ জুন সোনিয়া গান্ধীকে এই মামলায় ডাকা হলেও সোনিয়া গান্ধী করোনা-আক্রান্ত হন ২ জুন। তাই সোনিয়া গান্ধীর ইডি অফিসে হাজির হওয়ার তারিখও পিছিয়ে দিচ্ছে ইডি।

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে খবর, ন্যাশনাল হেরাল্ড সংবাদপত্রের মালিকানা কাদের কাছে ছিল এবং এই সংস্থার আর্থিক অংশীদারিত্ব কত টাকার, সেই নিয়েই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে গান্ধী পরিবারের সদস্যদের। ২০১৩ সালে বিজেপি নেতা সুব্রামনিয়ম স্বামীর অভিযোগের পরেই এই ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলা সর্বসমক্ষে আসে। অভিযোগ ওঠে, ন্যাশনাল হেরাল্ড সংবাদপত্রটি অধিগ্রহণের সময় ঘুরপথে সামান্য টাকার বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা সম্পত্তির মালিকানা গিয়েছে গান্ধী পরিবারের কাছে। আর সেই মালিকানার কিছু অংশীদারিত্ব কংগ্রেসের প্রথম সারির কিছু নেতার কাছেও নাকি রয়েছে। সেই সঙ্গেই কংগ্রেসের দলীয় তহবিলের টাকাও ঘুরপথে নাকি গান্ধী পরিবারের অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে। কিন্তু কী ছিল এই ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলা? কীভাবেই বা এই মামলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন শীর্ষস্থানীয় কংগ্রেস নেতারা? এই প্রশ্নের উত্তর এখনও অনেকের কাছেই অধরা।

ন্যাশনাল হেরাল্ড কী?
ন্যাশনাল হেরাল্ড স্বাধীনতার আগে জওহরলাল নেহেরু এবং অন্যান্য নেতাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি সংবাদপত্র। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে কংগ্রেসের মুখপত্র হিসেবে দীর্ঘদিন এই সংবাদপত্রটি কাজ করে চলেছে। এই সংবাদপত্রটি কিন্তু সরাসরি জওহরলাল নেহেরু কিংবা কংগ্রেসের তরফ থেকে প্রকাশিত হতো না, বরং এই সংবাদপত্র প্রকাশনার দায়িত্বে ছিল 'অ্যাসোসিয়েট জার্নালস লিমিটেড' নামের একটি সংস্থা, বা AJL। এই সংস্থার নির্দিষ্ট কোনও মালিক ছিল না। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় প্রায় ৫,০০০ স্বাধীনতা সংগ্রামীকে এই সংস্থার শেয়ারহোল্ডার বানিয়েছিলেন পণ্ডিত নেহরু। ২০০৮ সাল পর্যন্ত এই অ্যাসোসিয়েট জার্নালস লিমিটেড বা AJL কাজ করেছিল এবং ততদিন পর্যন্ত ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো। এছাড়াও এই সংস্থাটি নবজীবন এবং কোয়াম-এ -আওয়াজ নামের আরও দু'টি সংবাদপত্র প্রকাশ করত। কিন্তু, ২০০৮ সালের পরে এই সংস্থাকে আর কোনও সংবাদপত্র প্রকাশ করতে দেখা যায়নি।

আরও পড়ুন: আড়াআড়ি ভাঙবে কংগ্রেস? যে কারণে এই আশঙ্কা দানা বাঁধছে

অ্যাসোসিয়েট জার্নালস লিমিটেড বা AJL আসলে কী?
১৯৩৭ সালে পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু ৫,০০০ স্বাধীনতা সংগ্রামীকে নিয়ে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে লেখা প্রকাশ করার জন্য তৈরি করেছিলেন এই অ্যাসোসিয়েট জার্নালস লিমিটেড। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ছাড়া বাকি স্বাধীনতা সংগ্রামীরাও ছিলেন এই ন্যাশনাল হেরাল্ড সংবাদপত্রের অন্যতম অংশীদার। ২০১০ সালে এই সংস্থার শেয়ারহোল্ডারদের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ১,০৫৭-তে। নতুন দিল্লির আইটিও-তে এই সংস্থার রেজিস্ট্রার অফিস ছিল। সেখান থেকেই ইংরেজি ন্যাশনাল হেরাল্ড, হিন্দি নবজীবন এবং উর্দু কোয়াম-এ-আওয়াজ নামে তিনটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো ২০০৮ সাল পর্যন্ত। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের একটি রিপোর্ট অনুসারে, একটা সময় এমন ছিল, যখন এই সংস্থার মাথায় ৯০ কোটি টাকার ঋণ চেপে গিয়েছিল। তারপর বাধ্য হয়ে এই সংস্থাকে নিজেদের অপারেশন বন্ধ করতে হয়। ২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি পুনরায় এই তিনটি সংবাদপত্র প্রকাশ করার চিন্তাভাবনা গ্রহণ করে অ্যাসোসিয়েট জার্নালস লিমিটেড।

ইয়ং ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড কী?
এই ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় ইয়ং ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড নামক কোম্পানিটির যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা রয়েছে। সংস্থাটি আদতে একটি বেসরকারি সংস্থা এবং ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে এই সংস্থাটি স্থাপন করা হয়। এই সংস্থাটির ডিরেক্টর হলেন তৎকালীন কংগ্রেস দলের সাধারণ সম্পাদক রাহুল গান্ধী। সোনিয়া গান্ধী এবং রাহুল গান্ধী- এই দু'জনের এই কোম্পানিতে সর্বমোট ৭৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। এছাড়া বাকি ২৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে পরলোকগত কংগ্রেস নেতা মতিলাল ভোরা এবং অস্কার ফার্নান্ডেজের হাতে।

এই মামলার সঙ্গে কীভাবে জড়িত কংগ্রেস?
যখন ২০০৮ সালে নিজেদের সমস্তরকম অপারেশন বন্ধ করে দিল ন্যাশনাল হেরাল্ড, সেই সময় অনুমান করা হয়েছিল, এই কোম্পানির কাছে দিল্লি, লখনউ ও মুম্বই মিলিয়ে ২,০০০ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। ২০১২ সালে আদালতের কাছে দায়ের করা একটি মামলায় বিজেপি সাংসদ সুব্রামনিয়ম স্বামী দাবি করেছিলেন, ন্যাশনাল হেরাল্ড এবং অ্যাসোসিয়েট জার্নালস লিমিটেড নিয়ে বিস্তর কারচুপি করেছে কংগ্রেস। জালিয়াতি থেকে শুরু করে আর্থিক তছরুপ, সবকিছুর সঙ্গেই জড়িত কংগ্রেসের ফার্স্ট ফ্যামিলি। সেই সময় যখন অ্যাসোসিয়েট জার্নালস লিমিটেড তাদের শেয়ার ধীরে ধীরে ছাড়তে শুরু করেছে, সেখানেই এই জালিয়াতি শুরু হয়। স্বামীর অভিযোগ ছিল, ন্যাশনাল হেরাল্ডের সমস্ত অংশীদারিত্ব এবং তাদের সমস্ত সম্পত্তি আত্মসাৎ করে নিয়েছিল রাহুল গান্ধী পরিচালিত ইয়ং ইন্ডিয়া লিমিটেড।

অত্যন্ত গর্হিতভাবে এই আর্থিক তছরুপ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছিলেন স্বামী। তাঁর অভিযোগ ছিল, কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে শেয়ারের অধিগ্রহণ নিয়মমাফিক হয়নি। ঘুরপথে মাত্র ৫০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে অ্যাসোসিয়েট জার্নালস লিমিটেডের প্রায় ২,০০০ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হয়ে গিয়েছে কংগ্রেস পরিচালিত ইয়ং ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড। আয়কর আইন অনুসারে, কোনও তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে কোনওভাবেই রাজনৈতিক পরিচয় কাজে লাগিয়ে কোনওরকম টাকার লেনদেন করা যায় না। কিন্তু ন্যাশনাল হেরাল্ডের অংশীদারিত্ব হস্তান্তরের সময় কাজে লাগানো হয়েছিল রাজনৈতিক প্রভাব।

ন্যাশনাল হেরাল্ড সংবাদপত্রকে আবার পুনরুজ্জীবিত করতে কংগ্রেসের তরফে তাদের দলীয় তহবিল থেকে সুদবিহীন ৯০.২ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। ২০১০ সালে স্বামী অভিযোগ করেন, মাত্র ৫০ লক্ষ টাকা দিয়ে ৯০.২ কোটি টাকা তুলে নিয়েছিল কংগ্রেস। এছাড়াও তাঁর অভিযোগ ছিল, দলীয় তহবিল থেকে যে টাকা অ্যাসোসিয়েট জার্নালস লিমিটেডকে পাঠানো হয়েছিল, তাও সম্পূর্ণরূপে বেআইনি। অ্যাসোসিয়েট জার্নালস লিমিটেডের প্রাক্তন শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে কয়েকজন এই বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছিলেন পরবর্তীতে। প্রথমদিকে স্বামীর অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন হলেও, পরবর্তীতে অ্যাসোসিয়েট জার্নালস লিমিটেডের প্রাক্তন শেয়ারহোল্ডার ভারতের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী শান্তি ভূষণ এবং এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজুর অভিযোগের পর নড়েচড়ে বসে আদালত। এই দুই শেয়ারহোল্ডার অভিযোগ করেছিলেন, তাদের অজান্তেই, তাদের অংশীভূত অ্যাসোসিয়েট জার্নালস লিমিটেড সংস্থার শেয়ার হস্তান্তর হয়েছিল ইয়ং ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের কাছে।

'দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস'-এর একটি রিপোর্ট থেকে উঠে আসে, শেয়ার হস্তান্তরের সময় ৬৮ লক্ষ টাকার পরিবর্তে ১৫৪ কোটি টাকা ইয়ং ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে আত্মসাৎ করে নিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। আয়কর দপ্তরের তরফ থেকেও কংগ্রেসকে নোটিস পাঠানো হয়। ইতিমধ্যেই কংগ্রেসের কাছ থেকে এই ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় ২০১১-'১২ অর্থবর্ষে ২৪৯.১৫ কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার আদেশ জারি করেছিল আয়কর দপ্তর। যদিও কংগ্রেসের তরফ থেকে এই টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে কি না, সেই ব্যাপারে সম্পূর্ণ তথ্য আপাতত নেই।

কীসের ভিত্তিতে অভিযোগ?
২০১১ সালে ইয়ং ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড AJL-এর কাছ থেকে মাত্র ৫০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ন্যাশনাল হেরাল্ড কিনে নিয়েছিল। সেই সময় সংস্থার মাথায় ছিল প্রায় ৯০ কোটি টাকার ঋণ। সেই ঋণের অধিকাংশ ফেরত দেওয়া হয়েছিল কংগ্রেসের দলীয় তহবিল থেকে। ফলে সংস্থাটি অধিগ্রহণের পর এই ঋণের ভার চলে আসে রাহুল এবং সোনিয়া গান্ধীর ইয়ং ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের ওপর। এর এক বছর পরে ন্যাশনাল হেরাল্ডের ঋণ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয় বলে ঘোষণা করে দিয়েছিল ইয়ং ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড। কংগ্রেস নিজের প্রাপ্য সমস্ত টাকা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তৎক্ষণাৎ।

এখান থেকেই ঘুরপথে টাকা লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। বিজেপি নেতা সুব্রামনিয়ম স্বামী অভিযোগ তোলেন, প্রথমত অকেজো হলেও ইয়ং ইন্ডিয়া যখন অ্যাসোসিয়েট জার্নালকে অধিগ্রহণ করছে, সেই সময় তাঁর কাছে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। মাত্র ৫০ লক্ষ টাকা দিয়ে ইয়ং ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড সেই সম্পূর্ণ সম্পত্তির মালিক হয়ে যায়। একেবারেই নিয়মমাফিকভাবে এই কাজ হয়নি। কংগ্রেস রাজনৈতিক দল হওয়ার কারণে তাদের তহবিলের টাকা সম্পূর্ণরূপে করমুক্ত। প্রথমত, এভাবে কোনও রাজনৈতিক দল ঋণ দিতে পারে না। আর দ্বিতীয়ত, যদি কখনও ঋণ দেয়, তাহলেও কিন্তু এভাবে মকুব করা সম্ভব নয়। এভাবে ঋণ মকুব করার অর্থ দলীয় তহবিলের করমুক্ত টাকা ঘুরপথে গান্ধীদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢুকে পড়ল।

কারা কারা অভিযুক্ত এই মামলায়?
ন্যাশনাল হেরাল্ড দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছেন প্রয়াত কংগ্রেস নেতা মতিলাল ভোরা, অস্কার ফার্নান্ডেজ, সাংবাদিক সুমন দুবে এবং টেকনোক্র্যাট স্যাম পিত্রোদা। এছাড়াও কংগ্রেস প্রধান সোনিয়া গান্ধী এবং রাহুল গান্ধীর নাম প্রথম থেকেই রয়েছে এই মামলায়। এঁদেরকে বাদ দিলেও আরও একজনের নাম রয়েছে ইডি-র চার্জশিটে এবং তিনি হলেন হরিয়ানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভূপিন্দর সিং হুডা।

আদালতের কী বক্তব্য?
২০১২ সালে প্রথমবারের জন্য এই ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলা প্রকাশ্যে এলেও সেই মামলায় কোনওরকম তদন্ত হয়নি। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইডি তদন্ত শুরু করে। ২০১৪ সালে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট গোমতী মানকা ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় তলব করেন গান্ধী পরিবারকে। আদালতের বক্তব্য ছিল, অভিযোগ এবং সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এটা পরিষ্কার যে, ইয়ং ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে এই মামলায় আখের গুছিয়েছে কংগ্রেস। জনগণের টাকাকে নিজেদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেছে কংগ্রেস কর্তৃপক্ষ। ২০১৪ সালেই আদালতের তরফ থেকে আইপিসি সেকশন ৪০৩, ৪০৬ এবং ৪২০ অনুযায়ী প্রাইমা ফেসিয়া দায়ের করা হয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে।

২০১৪ সালে এই একই রায় বহাল রাখে দিল্লি হাইকোর্ট। কংগ্রেসকে জানানো হয়, এই মামলায় তাঁদের আপাতত শমন জারি করা হয়েছে, এবং তাঁরা নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করার সমস্ত সুযোগ পাবেন। তবে ২০১৬ সালে পরিবর্তিত হয়ে যায় মামলার গতিপ্রকৃতি। ২০১৫ সালে গান্ধীরা এই মামলায় আগাম জামিন পেলেও ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করে দেয়, এবারে গান্ধীদের বিরুদ্ধে আইনি কার্যক্রম শুরু করবে আদালত। শুনানি চলাকালীন অভিযুক্ত কংগ্রেস নেতাদের কাউকেই আদালতে হাজিরা দিতে হবে না, তবে এই মামলার তদন্ত চলবে। সেই বছরই নতুন করে ন্যাশনাল হেরাল্ড প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। ২০১৮ সালে অ্যাসোসিয়েট জার্নালস লিমিটেডের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। কিন্তু এক বছর পর এই সেই নির্দেশে স্থগিতাদেশ জারি করে সুপ্রিম কোর্ট।

ইডি-র তদন্তে কী কী উঠে এসেছে?
আগস্ট, ২০১৪ সালে এই বিতর্কিত মামলায় তদন্ত শুরু করে ইডি। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে কিছু টেকনিক্যাল কারণের জন্য এই মামলায় তদন্ত বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আবারও নতুন করে এই মামলায় তদন্ত শুরু করার আর্জি জানিয়ে চিঠি পাঠান বিজেপি সাংসদ সুব্রামনিয়ম স্বামী। অভিযোগ ওঠে, কংগ্রেস ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে তৎকালীন ইডি ডাইরেক্টর রাজন কতোচ এই মামলার তদন্ত বন্ধ করে দিয়েছেন। স্বামীর চিঠি পাওয়ার পর নড়েচড়ে বসে কেন্দ্রীয় সরকার। আগস্ট ২০১৫ সালে বহিস্কৃত হন কতচ এবং আবারও সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে মামলার তদন্ত শুরু করে ইডি।

২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে পাতিয়ালা হাউজ কোর্ট সোনিয়া গান্ধী এবং রাহুল গান্ধীকে এই মামলায় আগাম জামিন দেয়। ২০১৮ সালে ইডি AJL-এর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইন অনুযায়ী একটি মামলা দায়ের করেন। সেই মামলায় জড়িয়ে পড়েন হরিয়ানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং কংগ্রেস নেতা ভূপিন্দর সিং হুডা। জানা যায়, হরিয়ানার পঞ্চকুলায় AJL-কে অবৈধভাবে জমি পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ বেআইনিভাবে ব্যবহার করেছিলেন ভূপিন্দর সিং হুডা। ২০১৯ সালে ইডি মুম্বইয়ে থাকা ন্যাশনাল হেরাল্ডের ১৬.৩৮ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি উদ্ধার করে।

এই মুহূর্তে ইডি মূলত ইয়ং ইন্ডিয়া লিমিটেড এবং অ্যাসোসিয়েট জার্নালস লিমিটেডের আর্থিক লেনদেন এবং তাদের শেয়ারহোল্ডার প্যাটার্ন নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। স্বামীর অভিযোগের পর আদালতে তরফ থেকে যখন ইয়ং ইন্ডিয়া লিমিটেডের বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপের অভিযোগ নিয়ে আসা হয়, তারপর নতুন করে এই মামলায় ফেঁসে যায় কংগ্রেস। তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে আরও একটি মামলা দায়ের করার সিদ্ধান্ত নেয় ইডি। কিছুদিন আগেই এই মামলা প্রসঙ্গে ইডির জিজ্ঞাসাবাদে সম্মুখীন হয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং পবন বনসল। তাদের জবাবে যদিও খুব একটা খুশি নয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। তাই এবারে শমন পাঠানো হয়েছে কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ সোনিয়া গান্ধী এবং রাহুল গান্ধীকে।

কংগ্রেসের কী বক্তব্য ?
কংগ্রেসের তরফ থেকে সরাসরি দাবি করা হচ্ছে, শুধুমাত্র সামাজিক কাজ করার জন্যই তৈরি করা হয়েছিল ইয়ং ইন্ডিয়া লিমিটেড। কোনও লাভের জন্য এই সংস্থা তৈরি করা হয়নি। কংগ্রেস জানিয়েছে, এই সংস্থার সঙ্গে হওয়া কোন লেনদেন অর্থনৈতিক না, বরং যেটুকু হয়েছে, তার সম্পূর্ণটাই বাণিজ্যিক। কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভি জানিয়েছেন, "কোনও সম্পত্তি বা নগদ অর্থের লেনদেন হয়নি, তাহলে কীভাবে বেআইনি লেনদেন বা মানি লন্ডারিং মামলায় তাদেরকে তলব করা হলো?" ইয়ং ইন্ডিয়ান প্রাইভেট লিমিটেড থেকে যেটুকু শেয়ার ট্রান্সফার হয়েছে সেটুকু সব একেবারে নিয়ম মেনে হয়েছে। শুধু তাই নয়, ইয়ং ইন্ডিয়ান প্রাইভেট লিমিটেড একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, কোনও ব্যবসায়িক সংস্থা নয়। সুতরাং, তাদের লাভ কিংবা লোকসানের কোনও প্রশ্নই উঠছে না। বিজেপি সরকারের তরফ থেকে সস্তা 'ভেন্ডেটা' রাজনীতি করে তাদের ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। জিডিপির সমস্যা, মূল্যবৃদ্ধি এবং ভারতের অন্যান্য রাজনৈতিক সমস্যাগুলির থেকে মানুষের দৃষ্টি বিক্ষেপ করার জন্যই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে পড়েছে বিজেপি।

More Articles