‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দে অ্যালার্জি! কাদের, কেন?

Constitution of India: সঙ্ঘের তরফে দত্তাত্রেয় হোসাবলে বলেছেন, সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দ দু'টি জরুরি অবস্থার সময় যোগ করা হয়েছিল। তিনি দাবি করেন, বিআর অম্বেদকরের তৈরি মূল সংবিধানে এই...

ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দ দু'টির থাকা না থাকা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে দেশজুড়ে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবল এই শব্দ দু'টি নিয়ে পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব দেওয়ার পর উপ-রাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ও একই মত প্রকাশ করেছেন। বাংলার প্রাক্তন রাজ্যপাল একধাপ এগিয়ে এই শব্দ দু'টিকে ‘ঘা’ বলে অভিহিত করেছেন।

উপ-রাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় বলছেন, কোনও দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা পরিবর্তন করা যায় না। তিনি দাবি করেছেন, ভারত ছাড়া আর কোনও দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা বদলানো হয়নি। তিনি বলেন, প্রস্তাবনা সংবিধানের আত্মা। এটি পরিবর্তন করা যায় না। এটি সংবিধানের বীজ। কিন্তু ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে ভারতের প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’, ‘সমাজতান্ত্রিক’ এবং ‘অখণ্ডতা’ শব্দগুলি যোগ করা হয়। এটি সংবিধানের প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধের প্রতি অবিচার। তিনি বলেন, এই শব্দগুলো জরুরি অবস্থার সময় যোগ করা হয়েছিল, যখন নাগরিকদের মৌলিক অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ধনখড়ের মতে, এই শব্দগুলো ভারতের 'সনাতন সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়'। তিনি বলেন, "এই শব্দ যোগ করা আমাদের হাজার বছরের সভ্যতার ঐতিহ্যকে অবমাননা করার মতো।" কর্ণাটকের প্রাক্তন বিধায়ক ডি.এস. বীরাইয়ার সংকলিত ‘অম্বেদকরের বার্তা’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এই মন্তব্য করেন ধনখড়।

আরও পড়ুন- কত সিবগাতুল্লার মৃত্যু হলে বাঙালির রামনবমী পালন পূর্ণতা পাবে?

সঙ্ঘের তরফে দত্তাত্রেয় হোসাবলে দিনকয়েক আগেই বলেছিলেন, সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দ দু'টি জরুরি অবস্থার সময় যোগ করা হয়েছিল। তিনি দাবি করেন, বিআর অম্বেদকরের তৈরি মূল সংবিধানে এই শব্দ ছিল না। তিনি বলেন, জরুরি অবস্থার সময় সংসদ কাজ করেনি, বিচারব্যবস্থা অচল ছিল, মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তখনই এই শব্দ দু'টি যোগ করা হয়। এগুলো থাকা উচিত কি না, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। হোসাবলে বলেন, জরুরি অবস্থার সময় কংগ্রেস সরকারের অধীনে বহু মানুষকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছিল। তিনি কংগ্রেসের কাছে এই সময়ের জন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানান।

কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে এই মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেন, আরএসএস সবসময় দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া এবং তপশিলি জাতি-উপজাতির মানুষের বিরুদ্ধে। তারা সংবিধানের মূল মূল্যবোধের বিরোধী। তিনি বেঙ্গালুরুতে সাংবাদিকদের বলেন, হোসাবলে মনুস্মৃতির আদর্শে বিশ্বাসী। মনু চান না দরিদ্র মানুষ উন্নতি করুক। তিনি সমতা, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব এবং ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী। খাড়গে বলেন, "যদি ওরা সংবিধানের একটি শব্দও স্পর্শ করে, আমরা শেষ পর্যন্ত লড়াই করব।" তিনি আরএসএস-এর উদ্দেশে বলেন, ওরা যদি সত্যিই হিন্দুধর্মের পক্ষে কাজ করতে চায়, তাহলে প্রথমে অস্পৃশ্যতা দূর করুক। তিনি আরএসএস-এর মতাদর্শকে পশ্চাদপসরণমূলক বলেও সমালোচনা করেন।

কংগ্রেস ছাড়াও অন্যান্য বিরোধী দল এই প্রস্তাবের নিন্দা করেছে। সিপিআই(এম) বলেছে, এই শব্দ দু'টি সংবিধানের মূল মূল্যবোধের অংশ। এগুলো স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মত্যাগের প্রতীক। বামেরা বলেছে, আরএসএস-এর এই প্রস্তাব ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করার পরিকল্পনার অংশ। রাহুল গান্ধীও এই আবহে মুখ খুলেছেন। তাঁর কথায়, আরএসএস-এর মুখোশ খুলে গেছে। তারা মনুস্মৃতি চায়, সংবিধান নয়। তারা দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের অধিকার কেড়ে নিতে চায়। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন এই প্রস্তাবকে গণতন্ত্রের মূল আদর্শের ওপর আক্রমণ বলে অভিহিত করেছেন। আরজেডি নেতা লালুপ্রসাদ যাদব বলেন, আরএসএস-এর সংবিধানের দিকে কুনজর দেওয়ার সাহস নেই।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট এই শব্দ দু'টির বৈধতা নিয়ে একটি মামলার রায় দিয়েছে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না এবং বিচারপতি পি.ভি. সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চ বলে, এই শব্দগুলো জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য। এগুলো সংবিধানের মূল কাঠামোর বিরোধী নয়। আদালত বলেছে, ৪৪ বছর পর এই সংশোধনী নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও যুক্তি নেই।

আরও পড়ুন- ‘আমিত্ব’ ভারতীয় সংবিধানের মূল নয়, মনমোহনের জয় ও পরাজয় সেই মূলেই লুকিয়ে

১৯৭৬ সালে জরুরি অবস্থার সময় ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রস্তাবনায় এই শব্দগুলো যোগ করা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন সরকার এই পদক্ষেপ করে। পরবর্তী জনতা সরকার অনেক সংশোধনী বাতিল করলেও এই শব্দগুলো বহাল রাখে। এমনকী বিজেপি-নেতৃত্বাধীন বাজপেয়ী সরকারও এই শব্দগুলি স্পর্শ করেনি।

বিজেপি নেতা শিবরাজ সিং চৌহান বলেছেন, ভারতীয় সংস্কৃতির মূল হল সর্বধর্ম সম্ভাব। তাঁর মতে, ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দের প্রয়োজন নেই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং বলেছেন, "কে না চায় এই শব্দগুলো সরাতে? প্রত্যেক চিন্তাশীল নাগরিক এটি সমর্থন করবে।" বিরোধীরা বলছে, এই মনোভাব সংবিধানকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র।

একদিকে আরএসএস এবং বিজেপি নেতারা বলছেন, এই শব্দগুলো অম্বেদকরের সংবিধানের অংশ ছিল না। অন্যদিকে, বিরোধীরা বলছে, এই তৎপরতা সংবিধানের আত্মায় ধ্বংস করার চেষ্টা। সুপ্রিম কোর্টের রায় সত্ত্বেও এই আলোচনা ভবিষ্যতে আরও চড়া সুরে হতে পারে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এখন থেকেই।

More Articles