রানের ঝড়, তবু কেন উপেক্ষিত সরফরাজ
Sarfaraz Khan: ভারতীয় ক্রিকেটে এক অদ্ভুত প্রবণতা দেখা গেছে 'consistent performer syndrome'। যাঁরা ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত সফল, তাঁদের অনেক সময় আন্তর্জাতিক দলে জায়গা পেতে বছর লেগে যায়।
রানের যন্ত্র, সরফরাজ খান। রঞ্জি ট্রফিতে তিনি ধারাবাহিকভাবে রানের যে ফোয়ারা ছুটিয়েছেন, তা ভারতীয় ঘরোয়া ক্রিকেটে বিরল। তবু জাতীয় দলে তাঁর জায়গা এবার অধরাই। সংখ্যার চূড়া ছুঁয়েও ভাগ্য বারবার পিছনে ঘুরেছে। প্রতিবার ভারতের দল ঘোষণা হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় ওঠে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে গড় প্রায় ৭০, শতরান ডজনখানেক, রঞ্জি ট্রফিতে রানের পাহাড়, তবুও এবার জাতীয় দলের দরজা তাঁর জন্য খোলেনি।
সরফরাজ খানের গল্প শুরু মুম্বইয়ের কুর্লাতে। বাবা নওশাদ খান ছিলেন স্থানীয় ক্রিকেট কোচ। ছেলেকে বানিয়েছিলেন 'প্রজেক্ট সরফরাজ'। বয়স মাত্র ১২ বছর, আর ততদিনেই হ্যারিস শিল্ড টুর্নামেন্টে ৪৩৯ রানের ইনিংস! চাইল্ড প্রডিজি। আল জাজিরা লিখেছিল, তিনি ব্যাট হাতেই জন্মেছিলেন। তারপর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বিরাট কোহলিদের উত্তরসূরি হওয়ার ইঙ্গিত। কিন্তু সিনিয়র ক্রিকেটের পথে পা রাখতেই গল্পের স্ক্রিপ্ট পালটে যায়।

সরফরাজ খান
রঞ্জি ট্রফির মাঠে সরফরাজের ধারাবাহিকতা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ২০১৯-২০ মরশুম থেকে ২০২৩ পর্যন্ত রঞ্জি ট্রফিতে সরফরাজের গড় ১০০ ছুঁইছুঁই। তিন বছরে প্রায় আড়াই হাজার রান, একাধিক দ্বিশত রান। ২০২২ সালে মধ্যপ্রদেশের বিরুদ্ধে ২৭৫ রানের ইনিংস খেলেছিলেন ভারতের সম্ভাব্য পরবর্তী মিডল-অর্ডার সেনা। রঞ্জি ফাইনালে তাঁর শতরান মুম্বইকে এনে দেয় জয়ের স্বাদ। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্টে অভিষেক। প্রথম ইনিংসেই ৬২ রান, দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৬। বিদেশের মাটিতেও মানিয়ে দেখিয়েছেন তাঁর ক্ষমতা। ক্যান্টারবেরিতে ইংল্যান্ড লায়ন্সের বিরুদ্ধে ১১৯ বলে ৯২ রান , ইনট্রাস্ক্যাড ম্যাচে ১০২ অপরাজিত। তবু নির্বাচকের তালিকায় নাম নেই। তাঁর পিছনে বাবার ত্যাগ যেন এক উপন্যাস। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, "আমি যেটা পারিনি, ছেলেকে সেই ক্রিকেটার বানানোই আমার স্বপ্ন ছিল। মনে হচ্ছিল, ওর জায়গায় আমিই টেস্টের টুপি পেয়েছি। ছোটবেলা থেকে কঠোর ভাবে মানুষ করেছি। কোনও দিন ঘুড়ি ওড়ায়নি। বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করতে যায়নি। ভোরবেলা উঠে অনুশীলন, বিকেলে আবার অনুশীলন। অনেক রাতেই খাবার না খেয়ে শুতে গিয়েছে। তাকে বোঝাতে চাইতাম কী ভাবে হাজার হাজার মানুষ রাতের অন্ধকারে ফুটপাতে ঘুমায়।" নওশাদ আরও বলেন, ট্রেনে যাতায়াত করতেন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে, যাতে জীবনের বাস্তব কষ্ট বোঝে। "আমাদের গাড়ি ছিল। তবু ট্রেনে নিয়ে যেতাম, যাতে প্রতিটি রণক্ষেত্র-র মূল্য বোঝে।"
আরও পড়ুন- ফাতিমা সানা: পুরুষতান্ত্রিক পাকিস্তানে মহিলা ক্রিকেট বিপ্লবী
এক সময় তাঁর শরীর নিয়ে কটাক্ষের ঝড় উঠেছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু সরফরাজ উত্তর দিয়েছিলেন মাঠে— ওজন কমিয়েছেন ১৭ কেজি,বাড়ালেন ইয়ো-ইয়ো টেস্ট স্কোর। বলেছিলেন, "আমার ব্যাটই আমার ফিটনেস সার্টিফিকেট।" কিন্তু সেই সার্টিফিকেট যেন নির্বাচকের কক্ষে হারিয়ে গেল। এবারও দল ঘোষণার পর নেই তাঁর নাম। যুক্তি 'দলের ভারসাম্য'। অথচ কম রান করা নামগুলো রয়ে গেছে। করুণ নায়ার ও সাই সুধর্শন সুযোগ পেলেন। ২০২৫ সালের বুচি বাবু টুর্নামেন্টে প্রথম ম্যাচে দল ছিল ৯৮/৩। তিনি নেমে ১১৪ বলে করলেন ১৩৮ রান। পরের ম্যাচে দল যখন হরিয়ানার বিরুদ্ধে ৮৪/৪, ব্যাটিংয়ে নেমে আবারও ১১১ রান, খেললেন দলকে জেতাতে। আহত শরীরেও জারি রাখলেন লড়াই।

সরফরাজ খান
বিশ্লেষক হর্ষ ভোগলে মন্তব্য করেন, যদি রানই চূড়ান্ত মাপকাঠি হয়, তাহলে ভারতীয় নির্বাচকদের ব্যর্থতা সরফরাজের নাম না রাখা। সরফরাজের লড়াই শুধুই ব্যাটের নয়। অন্যদিকে নির্বাচক আগরকর বলেন, "সরফরাজ প্রথম টেস্টে শতরান করেছেন, তারপর রান পাননি। করুণ নায়ারের ডোমেস্টিক টেস্ট ক্রিকেটে এবং দেশীয় ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা আমাদের সাহায্য করতে পারে। আমরা ১৮ জন খেলোয়াড়ই বেছে নিতে পারি না, তাই কিছু খেলোয়াড়কে বাদ পড়তেই হবে।"
সাম্প্রতিক সময়ে সরফরাজ কোয়াড্রিসেপ ইনজুরিতে ভুগছিলেন। একই সঙ্গে ঋষভ পন্থের প্রত্যাবর্তন, ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে বিতর্ক তাঁকে হয়তো দল থেকে সরিয়েছে। তিনি মাঠে আবেগে খেলেন, পরিসংখ্যানে বাঁচেন, ক্যামেরার সামনে সরলভাবে কথা বলেন। এই সরলতাই হয়তো এখন 'ঝুঁকি' হয়ে উঠছে।
আরও পড়ুন- রূপান্তরকামী মহিলারা ক্রিকেট খেললে মহিলাদের অধিকার কমে যায়?
ভারতীয় ক্রিকেটে এক অদ্ভুত প্রবণতা দেখা গেছে 'consistent performer syndrome'। যাঁরা ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত সফল, তাঁদের অনেক সময় আন্তর্জাতিক দলে জায়গা পেতে বছর লেগে যায়। আম্বাতি রায়ুডু, মনোজ তিওয়ারি, করুণ নায়ারের মতো অনেক উদাহরণ আছে, সরফরাজ সেই তালিকার নতুন অধ্যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বোর্ডের মানদণ্ড আজ শুধু 'রান' নয়— 'ইমেজ', 'ফিটনেস', 'ড্রেসিং রুম ফিট'। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, ভারতীয় ক্রিকেট কি অতিরিক্ত কর্পোরেট হয়ে পড়ছে? সরফরাজ এখন আইপিএল ও ঘরোয়া মরশুমে নতুন করে নিজেকে প্রমাণ করতে চান। তাঁর লক্ষ্য শুধু একটাই— ভারতের টেস্ট মিডল অর্ডারে স্থায়ী জায়গা। কিন্তু বোর্ড কি অবশেষে সেই ফর্মকে স্বীকৃতি দেবে, নাকি এই গল্পও ইতিহাসের আর্কাইভে হারিয়ে যাবে?
প্রতিভাকে কখনও দমিয়ে রাখা যায় না। সরফরাজ খানের ব্যাট বারবার, স্পষ্টভাবে কথা বলেছে। কিন্তু সেই শব্দ যেন নির্বাচকের ঘরে পৌঁছয় না। যে ক্রিকেটে পরিশ্রম আর ধারাবাহিকতা একদিন সম্মান পেত, সেই ক্রিকেটই হয়তো আজ তাঁকে উত্তর দেবে— সময় এখনও শেষ হয়নি। ৪৩৯ রান করা সেই ছেলেটি আজও দরজায় কড়া নাড়ছে। ফর্ম, ফিটনেস, শতরান সব আছে। তবুও ভারতীয় দলে নেই সরফরাজ। তাঁর গল্প কেবল ক্রিকেটারের নয়; সিস্টেম, পরিশ্রম এবং বিশ্বাসের গল্প।
সরফরাজ এখনও ব্যাট হাতে লিখছেন নিজের অধরা গল্প…
Whatsapp
