ব্রেকফাস্টে খেতেন নেতাদের, জ্যোতি বসু বলতেন 'পাগলা কুকুর'! কে ছিলেন আসলে টি এন শেষণ?

T. N. Seshan: প্রচণ্ড বিরক্ত হন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। প্রকাশ্যেই তিনি টি এন শেষণকে ‘পাগলা কুকুর’ বলে বসেন।

১৯৬২-র গ্রীষ্মের এক দুপুর। মাদ্রাজ স্টেট ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টের অফিসে তুমুল ব্যস্ততা। ডিপার্টমেন্টের বড়বাবু নিজে গিয়ে সব বাস ড্রাইভারদের ‘ক্লাস’ নিচ্ছেন। এই বছর তিরিশের তরুণ নবনিযুক্ত ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টরটি বড় কড়া ট্রাফিক নিয়ম নিয়ে। বাস ড্রাইভাররা অত্যন্ত বিরক্ত তাঁর ওপর। বাধ্য হয়ে একজন নেতা গোছের ড্রাইভার এসে বড়বাবুকে বলেই দিলেন, “আপনি আদৌ বাস চালাতে জানেন? ইঞ্জিন দেখেছেন কোনওদিন! বড় বড় কথা শোনাচ্ছেন যে! আগে নিজে আমাদের জায়গায় এসে দাঁড়ান, তাহলে আমাদের সমস্যা বুঝতে পারবেন।” এই ঘটনার একমাস পর দেখা যায় এক বিরল দৃশ্য। বাস চালাচ্ছেন মাদ্রাজ স্টেট ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর স্বয়ং! সেদিনই মাদ্রাজের বাস ড্রাইভাররা বুঝতে পেরেছিলেন কেমন একরোখা তাদের এই বড়বাবু। ৩০ বছর পর গোটা দেশ দেখেছিল তাঁর জেদ। কথা হচ্ছে ভারতের দশম ইলেকশন কমিশনার তিরুনেল্লাই নারায়ন আইয়ার শেষণ বা টি এন শেষণেএর। তিনি ভারতের এমন একজন প্রশাসক ছিলেন যিনি নেতাদের থেকেও বেশি বিখ্যাত হয়েছিলেন। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ভারতের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক ছিলেন তিনি। জ্যোতি বসু তাঁকে ‘পাগলা কুকুর’ বলেছিলেন, আবার লালু প্রসাদ যাদব বলেছিলেন, “শেষণকে মোষের ওপর বসিয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেব।” তবে শেষণ নিজের সম্বন্ধে বলতেন, “I eat politicians in breakfast”।

১৯৩২ সালে তামিলনাড়ুর তিরুনেলভেলিতে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হয় টি এন শেষণের। চেন্নাইয়ের লয়োলা কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন তিনি। এরপর ১৯৫৪ সালে ইউপিএসসি উত্তীর্ণ হন শেষণ। তারপর তিনি তামিলনাড়ু ক্যাডারে আইএএস হিসেবে যোগ দেন। ঘটনাচক্রে মেট্রোম্যান ই. শ্রীধরনও লয়োলা কলেজে শেষণের ব্যাচমেট ছিলেন। ১৯৬২ সালে শেষণকে মাদ্রাজ স্টেট ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর পদে নিযুক্ত করা হয়। এর দু'বছর পর তিনি মাদুরাইয়ের কালেক্টর হন। ১৯৬৬ সালে চাকরি ছেড়ে শেষণ হাভার্ড ইউনিভার্সিটি যান পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে পড়াশোনা করতে। এই সময় তাঁর আলাপ হয় সুব্রাহ্মণ্যম স্বামীর সঙ্গে। এই বন্ধুত্ব পরবর্তী সময়ে ভারতীয় রাজনীতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায় যোগ করবে। ১৯৬৯ সালে শেষণ দেশে ফিরে আসেন এবং তাঁকে অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশনের সচিব হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭২ সালে তাঁকে ডিপার্টমেন্ট অব স্পেসে যুগ্ম সচিব হিসেবে নিয়োগ করা হয়। পরবর্তীকালে ইন্দিরা গান্ধীর মিডিয়া অ্যাডভাইজার এইচ ওয়াই সারদা প্রসাদ জানিয়েছিলেন, সেই সময় এন কে শেষণ ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর পিএ। তাই কোনও ভুল বোঝাবুঝি যাতে না হয় সেই জন্য টি এন শেষণ ফোন করে বলতেন, “আমি স্পেস থেকে শেষণ বলছি।” কঠোর ব্যক্তিত্বের আড়ালে কতটা রসিক মানুষ ছিলেন তিনি তা এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায়।

আরও পড়ুন- মগজাস্ত্র ক্ষুরধার, ফোনে ফোনে বানচাল করেন আক্রমণ! ভারতের প্রকৃত জেমস বন্ড অজিত ডোভাল

টি এন শেষণ

তবে দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে শেষণের নামের গুঞ্জন শুরু হয় আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে। ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধী তাঁকে পরিবেশ এবং বনমন্ত্রকের সচিব নিযুক্ত করেন। ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধী সরকার পড়ে যায় এবং প্রধানমন্ত্রী হন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং। তবে এতে বিশেষ প্রভাব পড়েনি রাজীব ঘনিষ্ঠ টি এন শেষণের। উল্টে তাঁর আরও উন্নতি হয়েছিল। ভিপি সিং সরকারে ক্যাবিনেট সেক্রেটারির পদ পান তিনি। ১৯৮৯ সালে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সৈয়দের মেয়ে রুবিয়া সৈয়দকে কাশ্মীরে জঙ্গিরা অপহরণ করে। সেই সময় ক্যাবিনেট সেক্রেটারি শেষণের আশঙ্কা ছিল টেলিফোন এক্সচেঞ্জে অনেকে জঙ্গিদের ঘনিষ্ঠ হতে পারে। তাই তিনি সেই সময় যতটা সম্ভব ফোনে তামিলে কথা বলার চেষ্টা করতেন। ১৯৯০ সালে দেশের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক হন টি এন শেষণ। শেষণের ইলেকশন কমিশনার হওয়ার পেছনে মূল হাত ছিল তাঁর হাভার্ডের বন্ধু এবং চন্দ্রশেখরের ক্যাবিনেটের বাণিজ্যমন্ত্রী সুব্রাহ্মণ্যম স্বামীর। ইলেকশন কমিশনার হওয়ার পর রাজীব গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে যান টি এন শেষণ। শোনা যায় বেরোনোর সময় শেষণকে রাজীব হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “তোমায় ইলেকশন কমিশনার বানিয়ে ওই দাড়িওয়ালা (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর) নিজেও জানে না কী ভুল করেছে।” আগামী কয়েক বছরেই গোটা দেশ বুঝতে পারে রাজীব গান্ধীর অনুমান কতটা অব্যর্থ ছিল। ৯০-এর দশকে বলা হত, নেতারা ভগবান ছাড়া একমাত্র শেষণকেই ভয় পায়।

টি এন শেষণ এবং রাজীব গান্ধী

১৯৯০ সালে মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক হয়েই নিজের কড়া মনোভাব স্পষ্ট করে দেন টি এন শেষণ। ১৯৯১ লোকসভা নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৯৬ পর্যন্ত দেশের যাবতীয় নির্বাচনে ‘শেষণ এফেক্ট’ স্পষ্ট ছিল। যেখানেই নির্বাচন হোক না কেন, যত বড় নেতাই হোক না কেন, কোনরকম ছাপ্পা ভোটের খবর এলে সেখানেই নির্বাচন থামিয়ে দিতেন শেষণ। ফের নির্বাচন করানো হত সেখানে। ১৯৯১ সালে শেষণ ঘোষণা করলেন ভোটার কার্ডে ছবি আনতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে জানানো হলো, এ অসম্ভব, এতে অনেক খরচা হবে! তৎক্ষণাৎ শেষণ দেশের সব নির্বাচন স্থগিত করে দিলেন। এই সময় হর্ষদ মেহতা স্ক্যাম সামনে আসে। ফলত ইস্তফা দিয়ে দিতে হয় তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী পি চিদম্বরমকে। এই সময় প্রধানমন্ত্রী রাও খুঁজছিলেন এমন এক নেতাকে যিনি শক্ত হাতে বাণিজ্য মন্ত্রকের হাল ধরবেন। তাঁর নজর গিয়ে পড়ে কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা এবং প্ল্যানিং কমিশনের প্রধান প্রণব মুখোপাধ্যায়ের উপর। তিনি প্রণবকেই বাণিজ্যমন্ত্রী করেন। কিন্তু প্রণব মুখোপাধ্যায় সেই সময় লোকসভা বা রাজ্যসভা, কোনও সদনেরই সদস্য ছিলেন না। ঠিক করা হয় পশ্চিমবঙ্গের কোটা থেকে রাজ্যসভায় পাঠানো হবে প্রণবকে। কিন্তু শেষণ যেহেতু সব নির্বাচন স্থগিত করে দিয়েছিলেন তাই প্রণব মুখোপাধ্যায়ের রাজ্যসভা নির্বাচনও স্থগিত হয়ে যায়। মন্ত্রিপদে শপথ নেওয়ার ৬ মাসের মধ্যে কোনও সদনের সদস্য না হতে পারায় ইস্তফা দিয়ে দিতে হয় প্রণব মুখোপাধ্যায়কে। এই ঘটনায় প্রচণ্ড বিরক্ত হন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। প্রকাশ্যেই তিনি টি এন শেষণকে ‘পাগলা কুকুর’ বলে বসেন। তাতে অবশ্য নির্বিকার ছিলেন শেষণ। তাঁর জেদের কারণেই ১৯৯৩ সালে ছবি দেওয়া ভোটার কার্ড ইস্যু করতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় সরকার।

লালু প্রসাদ যাদব, জ্যোতি বসু এবং মুলায়ম সিং যাদব

আরও পড়ুন-লাস্য, যৌনতা আর ৫০ হাজার মৃত্যুর দায়! বিশ্বের ভয়াবহ এই গুপ্তচরের গল্প হার মানায় সিনেমাকেও

শোনা যায়, নেতারা শেষণের প্রতি এতটাই বিরক্ত ছিলেন যে তাঁকে পিছনে ‘অ্যালসেশিয়ান’ বলে ডাকতেন। ১৯৯৫ সালে বিহার বিধানসভা নির্বাচনে অনেক আসনে নির্বাচন খারিজ করে দেন শেষণ। সেগুলিতে অভিযোগ ছিল ছাপ্পা ভোটের। এরপরই লালু প্রসাদ যাদব শেষণের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া শুরু করেন, ‘Seshan Against The Nation'। ১৯৯৫ সালেই সংসদে নিন্দা প্রস্তাব আনা হয় শেষণের বিরুদ্ধে। যদিও তা খারিজ করে দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও। তাঁর মনে হয়েছিল এতে দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হবেন। তবে তার বদলে অন্য একটি পরিকল্পনা করেন তিনি। ভারতীয় সংবিধানে কোথাও লেখা নেই যে দেশে একজনই ইলেকশন কমিশনার হতে পারবেন। তাই প্রধানমন্ত্রী রাও আরও দু'জন ইলেকশন কমিশনার নিযুক্ত করেন। এম এস গিল এবং ভি কৃষ্ণমূর্তিকে মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক করা হয় শেষণের পাশাপাশি। ফলত ক্ষমতা এক-তৃতীয়াংশ হয়ে যায় টি এন শেষণের। সুপ্রিম কোর্টে গিয়েও লাভ হয়নি শেষণের। কোর্টের রায় কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের পক্ষেই ছিল। শোনা যায়, এই সময় সাংবাদিকরা তাঁকে প্রতিক্রিয়া জানার জন্য ফোন করলে তিনি নিজেই ফোন ধরে বলতেন, “Seshan is unavailable to take your calls”।

১৯৯৬ সালে ইলেকশন কমিশনার হিসেবে তাঁর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এম এস গিল-কে পরবর্তী ইলেকশন কমিশনার হিসেবে নির্বাচন করা হয়। শোনা যায় এই সময় নিজের ঘনিষ্ঠবৃত্তে শেষণ বলতেন দেশের প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছে। তিনিই হবেন দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি। কথা মতো ১৯৯৭ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেন শেষণ। তবে মাত্র ৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন তিনি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল সামনে আসতেই শেষণকে ফোন করেন এক জনপ্রিয় সংবাদপত্রের এডিটর। ফোন করা নিয়ে সমস্যা নেই, কিন্তু ফোন করার সময় নিয়ে সমস্যা আছে। ওই এডিটর রাত এগারোটার সময় ফোন করেছিলেন শেষণকে। শেষণ ফোন তৎক্ষণাৎ কেটে দেন। এরপর সারারাত ধরে ওই এডিটরকে ফোন করতে থাকেন শেষণ। এডিটর ফোন তুললেই সঙ্গে সঙ্গে কেটে দিচ্ছিলেন তিনি, তারপর আবার ফোন করছিলেন। যতদিন না ওই এডিটর ব্যক্তিগতভাবে এসে শেষণের কাছে ফোন করার জন্য ক্ষমা চান, ততদিন পর্যন্ত শেষণ এই কার্যকলাপ চালিয়ে যান। ১৯৯৯ সালে কংগ্রেসের টিকিটে গান্ধীনগর থেকে লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন শেষণ। তাঁর বিপক্ষে বিজেপির টিকিটে লড়ছিলেন লাল কৃষ্ণ আডবানী। স্বভাবতই এবারও হারের মুখ দেখতে হয় শেষণকে। শেষ জীবনে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হন শেষণ। সন্তান-সন্ততি ছিল না তাঁর, ফলত সারাজীবনে যা রোজগার করেছিলেন তা বিভিন্ন চ্যারিটিতে দান করে দিয়ে যান। মৃত্যুকালে তাঁর সম্পত্তি বলতে ছিল বই ঠাসা একটি লাইব্রেরি। ২০১৯ সালে ১০ নভেম্বর চেন্নাইয়ে প্রয়াত হন এই কড়া মেজাজের আধিকারিক। বর্তমানে বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শাসকদলের অনুগত হওয়ার অভিযোগ ওঠে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে। স্বভাবতই এহেন পরিস্থিতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন টি এন শেষণের মতো নির্বাচনী আধিকারিক, যিনি দেশকে বুঝিয়েছিলেন প্রকৃত অর্থে ‘ফেয়ার ইলেকশন’ কাকে বলে।

 

More Articles