লাস্য, যৌনতা আর ৫০ হাজার মৃত্যুর দায়! বিশ্বের ভয়াবহ এই গুপ্তচরের গল্প হার মানায় সিনেমাকেও
World's Dangerous Spy Mata Hari: ১৯১৭ সালে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয় মাতা হারিকে। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার পরেও মাতা হারির মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাঁর মাথাও গুলি দিয়ে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়।
আমরা সবাই কম বেশি স্পাই বা গুপ্তচর সম্বন্ধে পড়েছি বা সিনেমা দেখেছি। স্পাই বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে জেমস বন্ডের ছবি। কিন্তু কোনও মহিলা গুপ্তচর সাধারণত দেখা যায় না কল্পকাহিনি বা সিনেমায়। তবে আজ এমন এক মহিলার কথা আলোচনায় আসবে যিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক স্পাই। ‘মারাত্মক’ শব্দটা একেবারে আক্ষরিক অর্থেই! এই মহিলার উপর ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষের মৃত্যুর অভিযোগ! বলা হতো, কোনও পুরুষের চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁর হৃদয়ের কথা বুঝে যেতে পারতেন এই গুপ্তচর। শত্রুপক্ষের শিবিরে এমন কোনও উচ্চপদস্থ অফিসার বাকি ছিলেন না যার সঙ্গে একান্তে রাত কাটাননি এই স্পাই। কথা হচ্ছে মার্গারেটা গিয়ারট্রুডা ম্যাকলয়েডের, যাঁকে গোটা বিশ্ব চেনে মাতা হারি নামে।
মার্গারেটার জন্ম ১৮৭৬ সালে নেদারল্যান্ডসের লিউওয়াডেন শহরে। ছোট থেকেই অসম্ভব সুন্দরী ছিলেন তিনি। শৈশবে দিনের অনেকটা সময়ই সাজগোজ করতে ব্যয় করতেন মার্গারেটা। অনেকেই মনে করেন, সেই সময় যদি মিস ইউনিভার্স বলে কোনও প্রতিযোগিতা হতো তাহলে নিঃসন্দেহে জিতে যেতেন মার্গারেটা। প্রসাধনের পাশাপাশি তাঁর আরেকটি শখ ছিল। বিশ্ব ভ্রমণের শখ। ছোট থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াবেন। সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মালেও মার্গারেটার জীবন ঘুরে যায় ১৩ বছর বয়সে। তাঁর বাবা তাঁকে এবং তাঁর মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন এবং অন্য এক মহিলাকে বিয়ে করে নতুন সংসার পাতেন। এর দু'বছর পর বিনা চিকিৎসায় মারা যান মার্গারেটার মা। এই সময় তাঁর সম্পর্ক হয় এক বছর চল্লিশের উচ্চপদস্থ ডাচ অফিসারের সঙ্গে। কয়েকদিনের সম্পর্কেই রুডলফ ম্যাকলয়েডকে বিয়ে করেন মার্গারেটা। সেনাবাহিনীর উচ্চ পদে থাকার দরুণ অর্থের কোনও অভাব হলো না তাঁর। কিন্তু বদলে জুটল লম্পট স্বামীর অকথ্য অত্যাচার। বিয়ের আগের আর বিয়ের পরের মানুষের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ দেখতে পেলেন তিনি। শোনা যায় মার্গারেটা এবং রুডলফের একটি পুত্র সন্তান হয়েছিল। তবে দুই বছর বয়সে মারা যায় সে। এরপর মার্গারেটার আর স্বভাবতই কোনও পিছুটান ছিল না ম্যাকলয়েড পরিবারের প্রতি। অবশেষে বছর পাঁচেকের মধ্যেই স্বামীকে ছেড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন মার্গারেটা ম্যাকলয়েড।
আরও পড়ুন- মগজাস্ত্র ক্ষুরধার, ফোনে ফোনে বানচাল করেন আক্রমণ! ভারতের প্রকৃত জেমস বন্ড অজিত ডোভাল
এভাবে বেরিয়ে আসার ফলে ব্যাপক আর্থিক অনটনে পড়লেন তিনি। এতদিন তিনি যে জীবনযাপন করছিলেন, তা আর রক্ষা করা সম্ভব হলো না। একপ্রকার পেটের দায়েই তিনি ঠিক করলেন ডান্স বারে নাচবেন। অল্প সময়ের মধ্যেই দারুণ নাচ শিখে নেন মার্গারেটা। নাচের পারদর্শিতা দেখে তাঁর শিক্ষকই তাকে ‘মাতা হারি’ নাম দেন। মালয় ভাষায় এই নামের অর্থ হল ‘ভোরের শুরু’। এরপর নেদারল্যান্ডস থেকে ফ্রান্সের প্যারিসে চলে আসেন তিনি। অমন লাস্যময়ী নারীর আবেদনময়ী নাচ প্যারিসবাসী এর আগে দেখেনি। শোনা যায় যেখানেই তিনি নাচতেন, সেখানেই পুরুষরা মৌমাছির ঝাঁকের মতো এসে হাজির হতো। যে নাচ মাতা হারির পেট চালানোর অবলম্বন ছিল তাইই হয়ে ওঠে তাঁর মুখ্য হাতিয়ার। মাতা হারির নাচের অন্যতম অংশ স্ট্রিপ ডান্স। ফলত উচ্চপদস্থ অফিসারদের আনাগোনা লেগেই থাকতো মাতা হারির দরবারে। প্যারিসের তথাকথিত এলিট শ্রেণির পুরুষরা টাকা-পয়সা, গয়না, দামি দামি উপহারে ভরিয়ে রাখত মাতা হারিকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মাতা হারির নাম গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ফ্রান্স, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, জার্মানি সর্বত্র আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম। সব পুরুষই তাঁকে একটিবার দেখতে চায়, একটিবার ছুঁতে চায়।
১৯১৪ সালে বার্লিনে শো করতে গিয়ে আটকে পড়েন মাতা হারি। এই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় প্রায় ৬-৮ মাস সেখানেই তাঁকে থাকতে হয়। সেখানে থাকাকালীন মাতা হারির আলাপ হয় অফিসার ক্রোম্যানের সঙ্গে। ক্রোম্যান সেই সময় জার্মান ইন্টেলিজেন্সের সঙ্গে কাজ করছিলেন। মাতা হারিকে তিনি গুপ্তচরবৃত্তির প্রস্তাব দেন। কাজ একদম পরিষ্কার ছিল। প্যারিসে উপর মহলে তাঁর পরিচিতিকে ব্যবহার করে ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর গোপন তথ্য জোগাড় করা। এজন্য তাঁকে কুড়ি হাজার ফ্রা পুরস্কার দেওয়ার কথাও জানান ক্রোম্যান। সাম্প্রতিককালে সামনে আসা তথ্য থেকে জানা যায়, এই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দেন মাতা হারি। তবে সেই অর্থ তিনি ফেরত দেননি। বার্লিনে থাকাকালীন তাঁকে যে হেনস্থা পোহাতে হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিনি টাকাটি নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। এরপর ফ্রান্সে ফেরার সময় তাঁর জাহাজ আটকে দেওয়া হয় পোর্ট অফ ফোকস্টনে। এখানে সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল গুপ্তচর সন্দেহে। মাতা হারির নিউট্রাল পাসপোর্ট এবং বাচনভঙ্গির সাবলীলতা দেখে ফ্রেঞ্চ পুলিশ তাঁকে গুপ্তচর বলে সন্দেহ করে। যদিও প্রমাণের অভাবে তখনকার মতো ছেড়ে দেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু প্যারিসে মাতা হারির পিছনে লোক লাগিয়ে দেন ফ্রেঞ্চ কাউন্টারএসপায়নেজ ব্যুরোর অধিকর্তা ক্যাপ্টেন জর্জ ল্যাডোহ।
ফ্রান্সে ফিরে এসে আবার নিজের পূর্ববর্তী জীবনে ফিরে গেলেন মাতা হারি। তবে কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর জীবনে আগমন ঘটল স্বপ্নের পুরুষের। তাঁর প্রেমিক উইলিয়াম ম্যাসল্ফ ছিলেন রাশিয়ান সেনার একজন উচ্চ পদস্থ কমান্ডার। কয়েকদিনের মধ্যেই যখন উইলিয়ামকে যুদ্ধে ফেরত যেতে হলো, মাতা হারিও উইলিয়ামের সঙ্গে যেতে চাইলেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে তো সাধারণ মানুষকে আর প্রবেশ করতে দেওয়া যায় না। এই সময় নিজের পুরনো প্রেমিকের মাধ্যমে মাতা হারি যোগাযোগ করলেন ক্যাপ্টেন জর্জ ল্যাডোহ-র সঙ্গে। আর্জি একটাই, তাঁকে যেন উইলিয়ামের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে দেওয়া হয়। এই সময় ক্যাপ্টেন ল্যাডোহ মাতা হারিকে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য প্রস্তাব দেন। এতে উইলিয়ামের কাছাকাছিও থাকা যাবে, আবার বিপুল অর্থও আসবে। রাজি হয়ে যান মাতা হারি। মাতা হারির নতুন ঠিকানা হয় মাদ্রিদে। সেখানে এক জার্মান উচ্চ পদস্থ অফিসার অ্যারন কালকে নিজের প্রেমের পড়িয়ে জার্মান সেনার অনেক গোপন তথ্য জেনে নেন মাতা হারি। ক্যাপ্টেন ল্যাডোহ নির্দেশ দেন অ্যারন কালকে খেলিয়ে আরও কিছু তথ্য বার করে আনতে।
কিন্তু এবার একটু গণ্ডগোল হয়ে যায়। মাতা হারির এই অভিপ্রায় বুঝতে পেরে যান অ্যারন কাল। এবার জার্মানরা এমন এক খেলা খেলে যাতে চিরকালের জন্য কুপোকাত হয়ে যান মাতা হারি। তারা বিভিন্ন ফ্রেঞ্চ কোড ব্যবহার করে আইফেল টাওয়ার এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে রটিয়ে দেন যে মাতা হারি আসলে একজন ডবল এজেন্ট। এর আগে জার্মান ক্রোম্যান নামক এক ব্যক্তির থেকে কুড়ি হাজার ফ্রা নিয়েছে। মাতা হারির এই জার্মান প্রেক্ষাপট শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে ফ্রান্স। তারা ঠিক করে মাতা হারিকে গ্রেফতার করবে। দুর্ভাগ্যবশত এত কিছু যে হচ্ছিল তার কিছুই খবর পাননি মাতা হারি। মাদ্রিদে তিনি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থেকে ফের ফিরে আসেন প্যারিসে। তিনি আশা করেছিলেন প্যারিসে ফিরতেই তাঁকে উপহারে ভরিয়ে দেবে ফ্রেঞ্চ সরকার কিন্তু হল উল্টো। ১৯১৭ সালের ২৪ জুলাই প্যারিস থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মাতা হারিকে। অভিযোগ বিশ্বাসঘাতকতার!
আরও পড়ুন- নর্তকী সেজে ঘোল খাইয়েছিলেন পুলিশকে, ভারতের প্রথম মহিলা গুপ্তচর সরস্বতীকে জানুন
এগোনোর আগে এবার একটু দাঁড়ানো যাক। ২০১৭ সালে কিছু ডিক্লাসিফায়েড তথ্যাবলী থেকে এই ঘটনার আরেকটি বয়ান পাওয়া গেছে। আসলে ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে সম এবং ভেডনের যুদ্ধে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ফ্রেঞ্চ সৈনিক মারা যায়। ফলত ফ্রান্সের ৬৮টি রেজিমেন্ট একসঙ্গে বিদ্রোহ ঘোষণা করে দেয়। এদিকে ফ্রান্স সরকার বা ক্যাপ্টেন ল্যাডোহ কেউই এই ব্যর্থতার দায় নিজেদের ঘাড়ে নিতে চাইছিলেন না। সেই জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল বলির পাঁঠার। নাহলে ফ্রেঞ্চ ইন্টেলিজেন্স একটু তলিয়ে দেখলেই ধরতে পারত জার্মানির চাল। ইতিহাসবিদদের মতে, ফ্রান্সের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা সুযোগ বুঝে সব দোষ চাপিয়ে দিলেন মাতা হারির ঘাড়ে। একই সঙ্গে রটিয়ে দেওয়া হল যে মাতা হারি একজন ডবল এজেন্ট।
মাতা হারিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ফ্রান্সের সবচেয়ে কুখ্যাত কারাগার সেন্ট লেজারে। যে নারী এতদিন পর্যন্ত ওঠাবসা করেছেন ইউরোপের ক্ষমতাশীলদের সঙ্গে, তাঁর স্থান হল ফ্রান্সের এক এঁদো কারাগারে। শোনা যায় মাতা হারিকে উইলিয়াম ম্যাসল্ফ বা তাঁর উকিল কারও সঙ্গেই দেখা করতে দেওয়া হয়নি। মাস তিনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় মাতা হারিকে এবং তারপর ট্রায়ালে তোলা হয়। ট্রায়ালে তিনি বারবার বলতে থাকেন তিনি নির্দোষ। কিন্তু জুরি আগেভাগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল, ট্রায়াল ছিল তা ঘোষণা করার উপলক্ষ্য মাত্র। মাতা হারি ফ্রান্সের গোপন তথ্য জার্মানিকে দিয়েছিলেন বলেই পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের মৃত্যু হয় বলে ঘোষণা করেন বিচারকরা। বিচারে প্রাণদণ্ড হয় মাতা হারির। অবশেষে ১৫ অক্টোবর, ১৯১৭ সালে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয় মাতা হারিকে। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার পরেও মাতা হারির মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাঁর মাথাও গুলি দিয়ে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। এরপর অবশ্য পরিবারকেও তুলে দেওয়া হয়নি ওই দেহ। ইউরোপের রাজনীতির দাবা খেলায়, সামান্য এক বোরের মতো কাটা পড়ে যায় ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুপ্তচর।