কেন গ্রেফতার করা হলো ব্রাজিলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বলসোনারোকে?
Jair Bolsonaro: গৃহবন্দির এই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল কারণ আদালতের মতে, বলসোনারোর সমর্থকরা শক্তিশালী এবং যে কোনো সময় আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ব্রাজিলে ফের রাজনৈতিক অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো। গৃহবন্দি অবস্থায় আদালতের চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় থাকলেও হঠাৎ এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা বিচারব্যবস্থাকে আরও কঠোর ও সতর্ক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে। ফেডারেল পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছে। এটি ব্রাজিলের রাজনীতির অভ্যন্তরে চলা ক্ষমতার সংঘাত, প্রতিষ্ঠানিক টানাপোড়েন ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর সংকটকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে। আদালতের মতে, বলসোনারোর আচরণে পালানোর আশঙ্কা এবং আইন ভঙ্গের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে; অন্যদিকে সমর্থকদের মতে, এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসারই আরেক উদাহরণ। ফলে এই গ্রেফতারকে ঘিরে বিতর্ক আরও তীব্র হচ্ছে এবং ব্রাজিলের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিবেশ কোন দিকে গড়াবে— তা নিয়েও তৈরি হয়েছে নতুন প্রশ্ন।
গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় বলসোনারোর পায়ে একটি ইলেকট্রনিক নজরদারি যন্ত্র বা ankle monitor লাগানো ছিল। এই যন্ত্রের সাহায্যে পুলিশ জানতে পারে তিনি কোথায় আছেন। হঠাৎ একসময় মনিটরিং সিস্টেমে দেখা যায়, যন্ত্রটির সংকেত অস্বাভাবিক। পরে পরীক্ষা করে দেখা যায়, যন্ত্রটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, প্লাস্টিকের অংশ, ব্যাটারি পুড়ে গিয়েছে। পুলিশের আশঙ্কা, যন্ত্রটিকে ইচ্ছাকৃতভাবে নষ্ট করা হয়েছে। আর এ জন্যই আদালত মনে করে, এটি পালানোর প্রস্তুতি বা চেষ্টা হতে পারে।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আলেকজান্দ্রে দে মোরায়েস স্পষ্ট ভাষায় বলেন, গৃহবন্দি একজন অভিযুক্ত যদি নজরদারি যন্ত্র নষ্ট করেন, তবে তিনি নিশ্চয়ই পালানোর পরিকল্পনা করছিলেন। তিনি জানিয়ে দেন, ঘটনাটি মোটেও সাধারণ নয়। বলসোনারো পালিয়ে যেতে পারেন, তাই তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া প্রয়োজন ছিল। বিচারপতির আরও যুক্তি, বলসোনারোর বাড়ি যুক্তরাষ্ট্র ও আর্জেন্টিনার দূতাবাসের খুব কাছে চাইলে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে গ্রেফতারই একমাত্র উপায়।
আরও পড়ুন
ব্রাজিলের গদি উল্টোনো কতটা বাঁচাবে পৃথিবীর ফুসফুস আমাজনকে
বলসোনারোর গ্রেফতারের আগেই তাঁর সমর্থকরা তাঁর বাসার সামনে একটি বড় প্রার্থনা সমাবেশ আয়োজনের পরিকল্পনা করছিলেন। বিচারপতির মতে, এই সমাবেশ আইনশৃঙ্খলায় সমস্যা তৈরি করতে পারে এবং তাঁর পালানোর সুযোগও বাড়াতে পারে। এজন্য আদালত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়।
গ্রেফতারের পরে বলসোনারো দাবি করেন, তিনি পালানোর চেষ্টা করেননি। কৌতূহলবশত যন্ত্রটি হাতে নিয়েছিলেন। তিনি যে ওষুধ খাচ্ছেন, তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মানসিক বিভ্রান্তি হচ্ছিল। এমনকি তিনি হ্যালুসিনেশনে দেখতেন যন্ত্রের ভেতরে নাকি গোপন ডিভাইস আছে। তাঁর কথায়, ওষুধ ও বয়স মিলিয়ে তাঁর আচরণ নিয়ন্ত্রণে ছিল না। বলসোনারোর আইনজীবীরা আদালতে আবেদন করেছেন তাঁর শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। কঠোর কারাবাস তাঁর জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তাই তাঁকে 'মানবিক বিবেচনায়' আবার গৃহবন্দি করা হোক। তবে আদালত বলছে, স্বাস্থ্যগত দাবি থাকলেও পালানোর ঝুঁকি বেশি, তাই তাঁদের পক্ষে বলসোনারোকে ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য, ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোকে গৃহবন্দি রাখা হয়েছিল মূলত ২০২২ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য অভ্যুত্থানের পরিকল্পনায় জড়িত থাকার অভিযোগে। সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে ২৭ বছরের কারাদণ্ড দেয়। তবে শাস্তি কার্যকরের আগে তিনি আপিলে ছিলেন। সেই সময় বিচারপ্রক্রিয়া নিরপেক্ষ রাখতে এবং তিনি যেন পালিয়ে যেতে না পারেন তাই আদালত তাঁকে গৃহবন্দি অবস্থায় রাখার নির্দেশ দেয়। তাঁর চলাচল নিয়ন্ত্রণে পায়ে ইলেকট্রনিক নজরদারি যন্ত্র লাগানো হয় এবং রাজনৈতিক সমাবেশ বা বিশেষ ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগেও নিষেধাজ্ঞা ছিল।
আরও পড়ুন
কেবল ব্রাজিল নয়, পৃথিবীর এই বিখ্যাত ফুটবলারের নামও ‘পেলে’! জানুন তাঁর আসল পরিচয়
গৃহবন্দির এই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল কারণ আদালতের মতে, বলসোনারোর সমর্থকরা শক্তিশালী এবং যে কোনো সময় আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া তাঁর বাড়ি যুক্তরাষ্ট্র ও আর্জেন্টিনার দূতাবাসের কাছে হওয়ায় পালানোর সম্ভাবনাও আদালত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। অন্যদিকে তাঁর আইনজীবীরা দাবি করেন, ৬৯ বছর বয়সি বলসোনারো শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন এবং মানবিক কারণে তাঁকে গৃহবন্দি রাখা উচিত। অর্থাৎ, গৃহবন্দি থাকা ছিল শুধু শাস্তির অংশ নয়, বরং বিচারব্যবস্থাকে সুরক্ষিত রাখা, তদন্ত প্রভাবমুক্ত রাখা এবং পালানোর ঝুঁকি ঠেকাতে নেওয়া একটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা।
আবার ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা বহুদিনের। ডানপন্থী পপুলিস্ট ভাবনা, অভিবাসনবিরোধী নীতি— সব ক্ষেত্রেই দু’জনের অবস্থান প্রায় একই। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও তাঁদের এই ব্যক্তিগত মিত্রতা প্রভাব ফেলেছে। ফলে বলসোনারোর বর্তমান সঙ্কটে ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠতা আবারও আলোচনায় এসেছে। তাঁকে রক্ষা করতে ট্রাম্প ব্রাজিলের উপর আরোপিত শুল্ক তুলে নিয়েছিলেন। তবে এই পদক্ষেপও তেমন কোনো বাস্তব সুফল আনতে পারেনি।
বলসোনারোর গ্রেফতার ব্রাজিলে নতুন রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি করেছে। সমর্থকদের অভিযোগ, এটি রাজনৈতিক প্রতিশোধ। বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করে তাঁকে চুপ করানো হচ্ছে। বিরোধীদের বক্তব্য, আইন ভেঙেছেন, তাই শাস্তি অবশ্যই হবে। সাবেক প্রেসিডেন্ট হলেই ছাড় দেওয়া যায় না বলে দাবি বিরোধীদের।এখন বলসোনারোর স্বাস্থ্যসংক্রান্ত দাবি বিচার প্রক্রিয়ায় একটি নতুন প্রশ্ন তুলছে, অসুস্থতা, মানসিক বিভ্রান্তি বা ওষুধের প্রভাব কতটা বিবেচনায় নেওয়া উচিত? বলসোনারোর বিরুদ্ধে ২৭ বছরের দণ্ড কার্যকর হলে এটি হবে ব্রাজিলের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা— একজন সাবেক প্রেসিডেন্টকে পালানোর আশঙ্কায় আবার গ্রেফতার করা, আদালতের কঠোর পদক্ষেপ এবং দেশজুড়ে বড় রাজনৈতিক বিভাজন। বলসোনারোর আগামী দিনের পথ আরও কঠিন হতে চলেছে।

Whatsapp
