'চোর চোর' রব ঢাকতে পুজোয় কল্পতরু || খড়্গ হাতে উন্নয়ন কোথায় দাঁড়িয়ে?
চারদিকে 'চোর চোর চোর’ রব, লাউডস্পিকারে কান বিদীর্ণ হওয়ার মতো এই আওয়াজের দমক কমাতেই কি দিদির সরকারের এই দান-খয়রাতি?
'ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ'। যার অর্থ, ঋণ করে হলেও ঘি খাও, যত দিন বাঁচো সুখে বাঁচো।
জড়বাদী চার্বাক দর্শনের এই কথাটি বেশ প্রচলিত। এই দর্শনে ধার করে ঘি খাওয়ায় উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, মানুষ মরে গেলে, তার আর দেনা শোধের দায় নেই। এই কথা রাজ্যের ক্ষেত্রে খাটে না। কারণ সরকার বদলালেও ঋণের বোঝা বয়ে নিয়ে যেতে হয় রাজ্যবাসীকে। বাম আমলের ঋণ নিয়ে বারবার কাঁদুনি গাইতে শোনা গেছে তৃণমূল সরকারকে। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র একসময়ে এমনও বলেছিলেন, এই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েই রাজ্যের উন্নয়ন করেছে তৃণমূল সরকার। পরিসংখ্যান কিন্তু অন্য ছবি তুলে ধরছে। দেনার দায়ে ডুবে রয়েছে রাজ্য। ঋণ শোধ করতে ঋণ নেওয়া। বকেয়া মেটানোর দাবি নিয়ে দিল্লি দৌড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। (অবশ্য এর পিছনে অন্য কারণ অনুসন্ধান করেছেন নিন্দুকরা)। বকেয়া ডিএ নিয়ে হা হা রব। এরপরেও মুড়িমুড়কির মতো পুজোর জন্য ক্লাবগুলোকে আরও বেশি টাকা বিলোচ্ছে রাজ্য। রাজ্যের এই গৌরী সেন ভাবমূর্তির কারণ কী? শুধুই কি ঔদার্য প্রদর্শন? বোধহয় না। কারণ সদ্য দুর্নীতির পচা শামুকে পা কেটেছে রাজ্যের। রক্তপাত হয়েই চলেছে।
রাজ্য সরকারের আর্থিক অবস্থা যে বর্তমানে খুব একটা ভালো নয়, তা নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছেন, 'ভাঁড়ার শূন্য'। তবু বাঙালির প্রিয় দুর্গোৎসবের জন্য ক্লাবগুলোকে যে অনুদান দেওয়া হয়, তার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন মমতা। আগে দেওয়া হতো ক্লাবপিছু ৫০ হাজার টাকা করে। এই বছর তা আরও ১০ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৬০ হাজার টাকা করা হয়েছে। রাজ্যে মোট ৪০ হাজার ৯২টি ক্লাবকে অনুদান দেওয়া হয়। হিসেবমতো, এই সব ক্লাবকে অনুদান দিতে গেলে মোট যা খরচ পড়বে, তা হল ২৪০ কোটি ৫৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। পরিসংখ্যান বলছে, যে পরিমাণ টাকা পুজোয় স্রেফ অনুদান হিসেবে বিলি করছে রাজ্য সরকার, তা ২০২২-'২৩ অর্থবর্ষে রাজ্য সরকারের বাজেট বিবৃতিতে একাধিক ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত আর্থিক বরাদ্দর তুলনায় অনেকটা বেশি। চারদিকে 'চোর চোর চোর’ রব, লাউডস্পিকারে কান বিদীর্ণ হওয়ার মতো এই আওয়াজের দমক কমাতেই কি দিদির সরকারের এই দান-খয়রাতি? এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কারণ আক্ষরিক অর্থেই অর্থনীতির গ্রাফ নিম্নমুখী। অক্সিজেন জোগাতে ভরসা ধার করা। বছরের শুরুতে ধার করেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন: এভাবে দিনদুপুরে চুরি হয়েছিল এসএসসি-র নম্বর! বড় গরমিল এখন প্রকাশ্যে
কোথায় দাঁড়িয়ে রাজ্যের ঋণের বোঝা
বাম আমলের ঋণের বোঝা বাইপাস হয়ে চলে এসেছে তৃণমূল সরকারের ঘাড়ে। সেই বোঝা নিয়েই নাকি উন্নয়ন জারি রেখেছে সরকার। এ-প্রসঙ্গে বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্যর করা একটা ট্যুইট একটু উল্লেখ করা যাক। তিনি একসময় বলেছিলেন, "৩৪ বছরের কমিউনিস্ট শাসন পশ্চিমবঙ্গর মতো রাজ্যকে ঋণের বোঝায় ডুবিয়ে দিয়েছে। ২০১১ সালে ১.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা ঋণের বোঝা চাপিয়ে গিয়েছিল। আর পিসির সরকার এসে সেই রাজ্যকে আরও দেনার দায়ে ডুবিয়ে দিল। এখন ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪.৭৫ লক্ষ কোটি। ৯ বছরে ১৫৫ শতাংশ বেড়েছে। এটাই কি মমতা মডেল?'' (তখন সরকারের বয়স ছিল ৯ বছর)। এখন ছবিটা কীরকম?
নতুন বছরের শুরুতেই ধার করে রাজ্য। চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি বাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার । রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার একটি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ওই দিন ৯টি রাজ্য বাজার থেকে মোট ১৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা ঋণ নেয় ৷ এই পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তরপ্রদেশ ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করে ঋণ নিয়েছে, যা এই ৯টি রাজ্যের মধ্যে সর্বাধিক৷ অর্থনীতিবিদদের মতে, এই ধারের নমুনা থেকে দু‘টো জিনিস পরিষ্কার। এক, আবগারি শুল্ক ছাড়া রাজস্ব আদায়ের কোনও বিকল্প ব্যবস্থা না থাকার ফলে এখন খরচ চালানোর জন্য বাজার থেকে ধার করা ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই রাজ্য সরকারের হাতে। দুই, গত দশ বছরে রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা-বহির্ভূত খরচ হু হু করে বেড়েছে। এর অন্যতম কি পুজোয় দান-খয়রাতি নয়?
২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার সময় রাজ্যের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল, ২ লক্ষ ৭ হাজার কোটি টাকা। ২০২০ সালে অর্থাৎ ন’বছর পর সেই ধারের বোঝা হয় ৪ লক্ষ ৭৪ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা। বিরোধীদের অভিযোগ, গড়ে প্রত্যেক রাজ্যবাসীর ঘাড়ে এখন ৪৭ হাজার টাকার দেনা চেপে রয়েছে। ধারের বোঝা নিয়ে অর্থ-কর্তারা অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করছেন। তাঁদের বক্তব্য, বাম জমানায় নেওয়া ঋণ এবং তার সুদ শোধ করতে গিয়েই এখন বছরে ৫০-৫১ হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ এখনও সেই ঘি খাওয়ার মাশুল!
রাজ্যের বকেয়া
কিছুদিন আগে দিল্লি গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে রাজ্যের বকেয়া তুলে ধরেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের বকেয়া বাবদ প্রায় ১ লক্ষ ৯৮৬ কোটি টাকার হিসেব লিখিত আকারে মোদিকে দিলেন মমতা। প্রধানমন্ত্রীকে তিন পাতার চিঠিতে রাজ্যের বকেয়া সমস্ত হিসেব বিস্তারিতভাবে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কোভিড, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং কেন্দ্রীয় প্রকল্প মিলিয়ে কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের বকেয়া ১ লক্ষ ৯৬৮ কোটিরও বেশি। সংবাদমাধ্যমের সামনে এসেছে মোদিকে দেওয়া মমতার সেই হিসেবের খতিয়ান। তাতে দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা বাবদই পাওনার অঙ্ক ৩৯,৩২২.৬০ কোটি টাকা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য রাজ্য পাবে ৬০,৬২৯.২৮ কোটি টাকা। এরপরও পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে অনুদান পাওয়ার কথা রাজ্যের। সব মিলিয়ে মোট প্রাপ্য ১ লক্ষ ৯৬৮.৪৪ কোটি টাকা। এই বকেয়া যাতে দ্রুত মিটিয়ে দেওয়া হয়, তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বারবার অনুরোধ জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
ডিএ বকেয়া, সমালোচনা
ক্লাবগুলিকে অনুদান দিচ্ছে, অথচ সরকার রাজ্য সরকারি কর্মীদের ডিএ দিচ্ছে না। বিরোধী থেকে বিভিন্ন সরকারি কর্মী সংগঠন সরব। ১৯ অগাস্টের মধ্যে কলকাতা হাই কোর্ট বকেয়া ডিএ মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়েছে রাজ্য সরকার। কত ডিএ মিটিয়ে দিতে হবে রাজ্য সরকারকে? কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্নমেন্টস এমপ্লয়িজের দাবি, ২০০৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৬ সালের ১ জুলাই পর্যন্ত নিয়ম মোতাবেক ডিএ পাননি রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা। কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্নমেন্টস এমপ্লয়িজের হিসাব অনুযায়ী, গ্রুপ ‘ডি’ কর্মীরা (বেতনক্রম ৬,৬০০ টাকা হলে) বকেয়া ডিএ বাবদ ২,৭৮,০০০ টাকা পাবেন। গ্রুপ 'সি' কর্মীরা (বেতনক্রম ৮,৮০০ টাকা) ৩,৭৩,০০০ টাকা পেতে পারেন। কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্নমেন্টস এমপ্লয়িজের হিসাব অনুযায়ী, আপার ডিভিশন অ্যাসিস্ট্যান্টের ক্ষেত্রে বকেয়া ডিএ-র অঙ্কটা প্রায় পাঁচ লাখ টাকা।
রাজ্যে অনাহারে মৃত্যু
এখনও এই রাজ্যে অনাহারে মরতে হয় সহনাগরিকদের। আমরা মেজাজে পালন করি উৎসব। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ১৩ অগাস্ট অর্থাৎ স্বাধীনতা দিবসের দু’দিন আগে পশ্চিমবঙ্গের দুই প্রান্তিক গ্রামে অনাহারে মারা গেলেন ২ জন। পশ্চিম মেদিনীপুরের বুলাবেদা গ্রাম উন্নয়নের নিরিখে পিছিয়ে। বেশিরভাগ পরিযায়ী শ্রমিকের বাস। তাঁদের মধ্যে অনেকেই করোনাকালে কাজ হারিয়ে বেকার। এমনই একজন ছিলেন সঞ্জয় সর্দার। করোনার সময় ফিরেছিলেন গ্রামে, ধরা পড়েছিল টিবি। কিছুদিন সঞ্চয় ভাঙিয়ে খেলেও শেষ দু'তিন মাসে পাতে পড়েনি ভাত, ডাল। মৃত্যুর কারণ হিসেবে জানা গেছে, অনাহার, অপুষ্টি কেড়ে নিয়েছে প্রাণ। একই পরিণতি হয় মালবাজারের দীনেশ ওঁরাওয়ের। লোকসানে চলা চা বাগান বন্ধ করে দেন মালিক। শত চেষ্টা করেও অন্নের সংস্থান করতে পারেননি। পরিণাম মৃত্যু! অনাহার, অপুষ্টি দূর করতে বিভিন্ন রাজ্যে চালু আছে বিভিন্ন প্রকল্প। যেমন পশ্চিমবঙ্গে খাদ্যসাথী, রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনা। এসব প্রকল্প আর প্রতিশ্রুতি যে কথার কথা, তার প্রমাণ এখনও অনাহারে মৃত্যু।
এরপরেও রাজ্য মেতে ওঠে উৎসবে।
হাসপাতালের অবস্থা
রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে কম টাকায় ভালো চিকিৎসা পাওয়ার আশায় ভিড় করেন বহু মানুষ। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে হাসপাতালগুলির সুবিধা-অসুবিধার খবর রাখেন। তবুও এসএসকেএম, আরজি কর বা মেডিক্যাল কলেজের মতো হাসপাতালগুলিতে গেলেই দেখা যায় মানুষের অসহায়তার ছবি। ক্যানসার-আক্রান্তের মতো রোগীরা বেড না পেয়ে হাসপাতালের বাইরে পড়ে থাকেন। আর মানুষের সেই অসহায়তার সুযোগ নিয়েই রমরমিয়ে চলছে দালাল চক্র। অভিযোগ, মোটা টাকার বিনিময়ে বিকোচ্ছে হাসপাতালের বেড।
অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে নোংরা ঘর, তালাবন্ধ আবাসিক- কিছুদিন আগে শহরের নামী মানসিক হাসপাতাল পাভলভের এই নারকীয় ছবি সামনে আসে। অভিযোগ, অনেক সময় সরকারি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা পান না রোগীরা। দেখিয়ে দেওয়া হয় বেসরকারি হাসপাতালের পথ। সেখানে দেউলিয়া হওয়ার জোগাড়!
মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টারের কলকাতা জেলার সেক্রেটারি ডাক্তার বিপ্লব চন্দ্র বলেন, "আপত্তি আমার এই জায়গাতে যে, হাসপাতালগুলিতে ওষুধ কাটলমেন্ট হচ্ছে। এসেনশিয়াল ড্রাগ লিস্টকে ছোট করে দেওয়া হচ্ছে। যার ফলে সাধারণ মানুষ, যাঁরা হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে ওষুধ পেতেন, তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। ঢালাও মদের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে, অথচ সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের দিক উপেক্ষিত।"
এই রাজ্যে ইমাম-মোয়াজ্জিনদের ভাতা দেওয়া হয়। ক্লাবের জন্য খরচ আছে, জঙ্গলমহল-সুন্দরবনে ফুটবল প্রতিযোগিতা আছে। মাটি উৎসব আছে, বঙ্গসম্মান আছে, যুবশ্রী ভাতা- এসবে দোষ কী? এর সঙ্গে আছে পুজোয় ক্লাবগুলোকে দান-খয়রাতি, তারপরও এই রাজ্যে জন্ম নেওয়া শিশুটা প্রথম চোখ মেলে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে।