ট্রেন চালাতে চান না! হাজারে হাজারে মহিলা লোকো পাইলট কেন চিঠি দিচ্ছেন রেলকে?

Woman Loco Pilots: বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ২,০০০ মহিলা লোকো পাইলট কাজ করছেন এবং তাদের মধ্যে প্রায় ১,৫০০ জন কাজ বদলাতে চেয়ে ওই চিঠিতে সই করেছেন।

কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের নিরাপত্তার দাবি নিয়ে হইহই আন্দোলনকে অনেকেই ‘নাটক’ বলে, ‘অযৌক্তিক’ বলে মনে করেছেন, আগামীতেও করবেন। এমনিতেই 'মেয়েরাও তো আজকাল গাড়ি চালাচ্ছে, প্লেন চালাচ্ছে, মহাকাশে যাচ্ছে’ বলে অনেকেই প্রমাণ করে দেন আসলে মেয়েদের এগুলো করার কথাই ছিল না। করছে মানেই সমস্ত ক্ষমতায়ন ঘটে গেছে। মেয়েরা এসব কাজ কোন পরিস্থিতিতে করছে? কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা তো দূর অস্ত সামান্য স্বাস্থ্যকর অবস্থাও কি মহিলারা পান? ধরা যাক ভারতীয় রেলের কথা। মহিলাচালক দেখলেই সোশ্যাল মিডিয়া উপচে পড়ে লাগাতার পোস্টে। রেলের সেই মহিলা লোকো পাইলটরাই ভারতীয় রেলকে চিঠি দিয়েছেন যাতে তারা চাইছেন তাঁদের লোকো পাইলট বাদে অন্য দায়িত্ব দেওয়া হোক! কেন?

চিঠিতে অল ইন্ডিয়া রেলওয়েম্যান ফেডারেশনের মহিলা লোকো পাইলটরা উল্লেখ করেছেন, তাঁদের চাকরিতে স্বাস্থ্য সমস্যা ভয়াবহ, কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা, নিরাপত্তার ভয় তো আছেই। এত ভয়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সামলানোর পর আবার সংসারের দায়িত্বও তো মেয়েদের ঘাড়েই চাপিয়ে দেয় পরিবার। চিঠিতে তারা দাবি জানিয়েছেন, মহিলা লোকো পাইলটদের 'ক্যাডার চেঞ্জ' হোক, অর্থাৎ লোকো পাইলট ছাড়া অন্য ভূমিকা দেওয়া হোক তাঁদের। উল্লেখ্য, বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ২,০০০ মহিলা লোকো পাইলট কাজ করছেন এবং তাদের মধ্যে প্রায় ১,৫০০ জন কাজ বদলাতে চেয়ে ওই চিঠিতে সই করেছেন। এই প্রথম যে মহিলা ট্রেনচালকরা এমন চিঠি দিলেন তা নয়। ২০১৮ সাল থেকে রেলের সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা চলছে। রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মহিলাচালকদের ভূমিকা পরিবর্তনের সম্ভাবনা বিবেচনা করার কথা জানালেও কোনও কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি বলেই জানিয়েছেন তারা।

আরও পড়ুন- রাতের পর রাত ঘুম নেই! কেমন জীবন বাঁচেন রেলচালকেরা?

স্ক্রোল ডট ইনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মধ্যপ্রদেশের এক সহকারী লোকো পাইলট জানিয়েছেন, ২০২১ সালের মে মাসে তাঁর তীব্র পেটে ব্যথা আর জ্বর হয়। রেলের হাসপাতাল তাকে ব্যথানাশক ওষুধ দেয়, সোনোগ্রাফি করতে বলে। ওই মহিলা চালক ভেবেছিলেন অনিয়মের জন্য হয়তো বা গ্যাস হয়েছে, অথবা মূত্রনালীর সংক্রমণ। আগেও হয়েছে এমন। কিন্তু সেবার তাঁর কিডনির টিস্যুতে পুঁজ জমে যায়। সময়ে চিকিৎসা করিয়ে বেঁচে যান তিনি। মূত্রনালীর সংক্রমণ থেকেই এই মারাত্মক রোগ হয়েছিল তাঁর। মালগাড়ির লোকো পাইলট এই মহিলা ১২ ঘণ্টার শিফটে কাজ করতেন। এই সময়ে বাথরুম যেতে পারেন না তারা, কম জল খান। প্রস্রাব পেলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেপে রাখতে বাধ্য হন। ফলে এমন মারাত্মক রোগ ঘটতে বাধ্য!

মহিলা লোকো পাইলটদের মূত্রনালীর সংক্রমণ অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। সারা দেশে মহিলা লোকো পাইলটদের বড় অংশই পরিচ্ছন্ন শৌচালয়ের অভাবে, কাজের কঠিন সময়সীমার ফলে মূত্রনালীর সংক্রমণ, জরায়ুর ফাইব্রয়েড, উচ্চ রক্তচাপ,এমনকী গর্ভপাত সহ বিভিন্ন জটিলতায় ভোগেন।

১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে, ভারতীয় রেল ট্রেনের ক্রু কেবিনে লোকো পাইলটদের জন্য টয়লেট স্থাপন করা শুরু করে। তবে খুব নগণ্য সংখ্যক লোকো পাইলটদের কেবিনেই টয়লেট রয়েছে। টয়লেট থাকলেও, বেশিরভাগ সময় ভিতরে জল থাকে না, ফলে অস্বাস্থ্যকর হয়ে থাকে জায়গাটি। মহিলা লোকো পাইলটরা এও জানিয়েছিলেন যে শৌচাগার না থাকায় মহিলারা যে অসুবিধায় পড়েন তাতে কাজে মনোনিবেশ করাও অসম্ভব হয়ে যায়। ফলে ট্রেনের নিরাপত্তাও এতে প্রভাবিত হতে পারে।

শুধু ট্রেনের ভিতরে তো সমস্যা নয়, বহু স্টেশনের লবিতেও মহিলা লোকো পাইলটদের জন্য আলাদা শৌচালয়ের ব্যবস্থা নেই। শৌচালয় ব্যবহার করার জন্য, তাদের স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে যেতে হয়, সেখানে যাওয়া আসাতেই মিনিট দশেক চলে যায়।

আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি মহিলা লোকো পাইলটরা কাজ করছেন, অথচ তাঁদের জন্য সুষ্ঠু কাজের পরিকাঠামোই নেই। মহিলা লোকো পাইলটরা জানিয়েছেন, তাদের কেবিনের সিঁড়িগুলি মাটি থেকে এতটাই উঁচু যে তাদের মধ্যে ওঠার সময় সমস্যা তো হয়ই, নামার সময়েও লাফ দিতে হয়। মূলত মালগাড়ির লোকো পাইলটদের এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় কারণ মালগাড়ি সাধারণত প্ল্যাটফর্মে থামে না। ভারতীয় মহিলাদের গড় উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট। অথচ মহিলাদের কথা মাথায় রেখে ট্রেনের কামরার সিঁড়িগুলি তৈরিই করা হয়নি। কেবিন থেকে এভাবেই লাফিয়ে নামতে গিয়ে মাটিতে পড়ে আহত হয়েছেন বহু মহিলা।

আরও পড়ুন- দামী টিকিট, রক্তঘাম করা টাকায় দেওয়া আয়কর; ভারতীয় রেলে কোথায় যাত্রীসুরক্ষা?

মহিলা লোকো পাইলটরা গর্ভধারণের সময় বিশেষ করে তীব্র সমস্যার সম্মুখীন হন। বাইরে গর্ভাবস্থায় ডিউটি করার সময় গর্ভপাত ঘটে রক্তপাত হয়েছে বহু মহিলার। সেই সময় অফিসে বসে কাজ চাওয়া হলেও সেই আবেদন মঞ্জুর হয় না অনেকের। কোনও গর্ভবতী মহিলার পক্ষেই প্রায় ৬ থেকে ১১ ঘণ্টা বিরতি ছাড়া একটানা কাজ করা সম্ভব নয়। গর্ভবতী মহিলার শারীরিক শক্তি কম, মাথা ঘোরে, মেজাজের পরিবর্তন হয়, ঘুম থেকে উঠে অসুস্থ লাগে। ট্রেন চালানোর মতো কঠিন দায়িত্বের জন্য সক্রিয় এবং শারীরিকভাবে ফিট কর্মীদের প্রয়োজন যারা তাড়াতাড়ি উপরে উঠতে পারে, লোকোমোটিভ থেকে নেমে লোকোমোটিভ চেক করতে পারে, প্রযুক্তিগত ত্রুটি হলে সামলাতে পারে, এসব কাজ একজন গর্ভবতী মহিলার পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ গর্ভবতীরা ছুটি চাইলে, বা বসে কাজ চাইলে তা মঞ্জুরও করা হয় না অনেকসময়।

কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি মহিলা লোকো পাইলটদের নিরাপত্তার আশঙ্কাও বিপুল। মাঝরাতে কোথাও ট্রেন থামানো, জঙ্গলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে একজন মহিলার শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের ভয় কাজ করেই। রাতের ডিউটিতে মহিলাদের পিক-আপের ব্যবস্থাও নেই। তারপর এত ঝক্কি সামলে রয়েছে সংসারের গুরুভার। আর সবচেয়ে মজার বিষয়, পুরুষ সহকর্মীরাই বড়াই করে বলেন, এসব চাকরি মহিলাদের জন্য নয়। অথচ মহিলাদের জন্য সুন্দর পরিবেশ গড়ার কথা তারা ভাবেন না। রেলও ভাবে না কারণ কর্মস্থলটি পুরুষ-প্রধান। মহিলা লোকো পাইলট দেখে যতটা গর্ব হয়, তাঁদের কর্মস্থলের পরিস্থিতি দেখে ততটাই করুণা হওয়ার কথা। লিঙ্গসাম্যের পক্ষে কথা বলা, নিরাপত্তার দাবিতে স্লোগান তোলা যত বাড়বে, টনক কি নড়বে পুরুষ নিয়ন্ত্রিত এই কর্মক্ষেত্রগুলির মাথাদের?

More Articles