কেন আখলাক হত্যার মামলা প্রত্যাহার চায় যোগী সরকার?

Akhlaq lynching case: যোগী প্রশাসন বলছে, গ্রামে সামাজিক শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য মামলাটি প্রত্যাহার জরুরি। সমালোচকদের মতে, এই যুক্তি বিপজ্জনক কারণ এটি ভবিষ্যতের হামলাকারীদের কাছে ভুল বার্তা ছড়াবে।

উত্তর প্রদেশের দাদরি। সালটা ২০১৫। ফ্রিজে গো-মাংস রয়েছে, এমন গুজব ছড়িয়ে পড়তেই ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা ঢুকে পড়ে বিসাহরা গ্রামের এক সাধারণ গৃহস্থ বাড়িতে। সেই রাতে গণপিটুনিতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ৫০ বছর বয়সি মোহাম্মদ আখলাককে। তাঁর ছেলে দানিশও গুরুতর আহত হন। মবলিঞ্চিং শব্দটির জাতীয় পরিচিতি তৈরি হয় এই হত্যাকাণ্ড ঘিরেই। তারপর গো-রক্ষার নামে গোবলয়ে মানুষ মারা বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। সেই আখলাক হত্যার প্রায় এক দশক পর এখন নতুন বিতর্ক, এই ভয়াবহ মামলার বিচার শেষ পর্যন্ত থেমে যাবে?

অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চলমান ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহারের অনুমতি চেয়ে গ্রেটার নয়ডার একটি আদালতে আবেদন করেছে উত্তর প্রদেশ সরকার। সরকারি আবেদনে যুক্তি দেওয়া হয়েছে— সাক্ষ্যে অসঙ্গতি, অস্ত্র উদ্ধার না হওয়া এবং সামাজিক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, আখলাক কি ন্যায়বিচার পেলেন? এই সিদ্ধান্তে আখলাক পরিবারের নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হবে না?

২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১০টা। স্থানীয় এক মন্দির থেকে ঘোষণা করা হয়,

“গো-হত্যা হয়েছে, গো-মাংস খাওয়া হয়েছে।”

ঘোষণার পরই লাঠি, লোহার রড, তলোয়ার ও পিস্তল হাতে একদল মানুষ হানা দেয় মোহাম্মদ আখলাকের বাড়িতে। পরিবারের বয়ান অনুযায়ী, হামলাকারীরা আখলাক ও তাঁর ছেলে দানিশকে টেনে বারান্দায় নিয়ে এসে গো-মাংস খাওয়া ও গরু জবাইয়ের অভিযোগে মারধর শুরু করে। মারধরের ফলে আখলাক ঘটনাস্থলেই মারা যান। দানিশ গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন। ফ্রিজে রাখা মাংসকে গরুর মাংস বলে দাবি করে হামলাকারীরা। যদিও, আখলাক পরিবার জানিয়েছিল সেটি ছিল খাসির মাংস।

ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই সারাদেশে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়। কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপি নেতৃত্ব সমালোচনার মুখে পড়ে। বিজেপির কয়েকজন নেতা মন্তব্য করে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কেউ বলেছিলেন, “এটা দুর্ঘটনা”। আবার কেউ বলেছিলেন, “গো-মাংস খাওয়া গ্রহণযোগ্য নয়”। এই নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়, বাধ্য হয়ে কয়েকজন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়।

আরও পড়ুন

কোটি টাকার সম্পত্তি, লাখ টাকার বন্দুক! আদিত্যনাথের সম্পদের বিবরণ চমকে দেবে

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রথম চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। তাতে ১৫ জনের নাম ছিল; এর মধ্যে এক নাবালক এবং এক স্থানীয় বিজেপি নেতার ছেলের নামও ছিল। পরে অভিযুক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯।

২০১৬ সালে অভিযুক্ত রবিন সিসোদিয়া জেলে অসুস্থ হয়ে মারা গেলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। গ্রামে তাঁকে 'শহিদ' ঘোষণা করায়, এতে আরও উত্তেজনা ছড়ায়। তাঁর মরদেহ জাতীয় পতাকায় মোড়ানো হয়। সরকারের ক্ষতিপূরণের আশ্বাসের পর দাহ সম্পন্ন হয়। মামলার বিচার শুরু হয় ২০২১ সালে। কিন্তু নিয়মিত শুনানি, সাক্ষীর নিরাপত্তা, রাজনৈতিক চাপ এই সব মিলিয়ে বিচারপ্রক্রিয়া ধীর ও জটিল হয়ে ওঠে।

কেন মামলা প্রত্যাহারের আবেদন? সরকারের যুক্তি কী? উত্তর প্রদেশ সরকারের নতুন আবেদনে বেশ কয়েকটি কারণ দেখানো হয়েছে। সরকার বলছে, আখলাকের স্ত্রী ইকরামন ১০ জন অভিযুক্তর নাম বলেছেন। অন্যদিকে মেয়ে সাইস্তা বলেছেন ১৬ জন এবং ছেলে দানিশ বলেছেন ১৯ জন। সাক্ষ্যে অভিযুক্তের সংখ্যা পরিবর্তিত হয়েছে, এটিকেই অসঙ্গতি হিসেবে দেখাচ্ছে রাজ্য। তবে আখলাকের পরিবারের আইনজীবী মোহাম্মদ ইউসুফ সাইফি অবশ্য এটিকে অযৌক্তিক বলেছেন। তাঁর কথায়, একটি উত্তেজনাপূর্ণ রাতে প্রত্যেকে সব হামলাকারীকে দেখবে, এমনটা আশা করা যায় না; আসল প্রশ্ন হলো ঘটনাটির প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে কিনা।

অভিযোগে পিস্তল ও তলোয়ারের কথা থাকলেও পুলিশ বলেছে, কেবল পাঁচটি লাঠি, লোহার রড এবং ইট উদ্ধার হয়েছে। তলোয়ার-পিস্তল পাওয়া যায়নি। এটি মামলার পক্ষে ‘দুর্বলতা’ বলে দাবি করছে সরকার। যোগী প্রশাসন বলছে, গ্রামে সামাজিক শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য মামলাটি প্রত্যাহার জরুরি। সমালোচকদের মতে, এই যুক্তি বিপজ্জনক কারণ এটি ভবিষ্যতের হামলাকারীদের কাছে ভুল বার্তা ছড়াবে।

আখলাক পরিবার শুরু থেকেই গো-মাংস রাখার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। প্রথম ময়নাতদন্তে স্থানীয় পশুচিকিৎসক বলেছিলেন, ওই ফ্রিজে সেদিন খাসির মাংস ছিল। পরে ফরেনসিক রিপোর্টে পশুচিকিৎসকের দাবি উড়িয়ে গো-মাংস তত্ত্বকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই দু'রকম রিপোর্টের জন্য আখলাক পরিবারের বিরুদ্ধেও গো-হত্যা নিষেধাজ্ঞা আইনে মামলা করা হয়। তবে পরিবারের আইনজীবীর অভিযোগ, চাপ তৈরি করার জন্যই এই মামলা করা হয়েছে।

আখলাকের ঘটনাই প্রথম এবং শেষ ঘটনা নয়। ভারতজুড়ে গত একদশকে গো-রক্ষার নামে সহিংসতা বেড়ছে। প্রাণ গিয়েছে বহু নির্বিবাদী মানুষের। আখলাক হত্যার পর থেকে গো-রক্ষা বাহিনীর টহল, সন্দেহের ভিত্তিতে হামলা, মাংস নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে মারধর— এসব ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে।

২৭ অগাস্ট ২০২৪-এর ঘটনা এক্ষেত্রে উল্লেখ করতেই হয়। হরিয়ানার চরখি দাদরির বাধরা এলাকায় গো-রক্ষক দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এক মুসলিম যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছিল। নিহত সাবির মালিক (২৪) দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বাসিন্দা। পরিবার নিয়ে তিনি স্থানীয় একটি বস্তিতে থাকতেন এবং সাফাজকর্মীর কাজ করতেন। এই দিন গো-রক্ষার কাজে জড়িত কয়েকজন একটি পাত্রে মাংসের টুকরো দেখে সেটিকে গো-মাংস সন্দেহ করেন। অভিযোগ, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সাবিরকে ধরে নিয়ে পাশের বাসস্ট্যান্ডে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ৩১ অগাস্ট মারধরের একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়, যেখানে সাবিরকে একদল ব্যক্তি লাঠি দিয়ে আঘাত করতে দেখা যায়। হরিয়ানার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নায়াব সিং সাইনি এই ঘটনাকে 'দুর্ভাগ্যজনক' বলে মন্তব্য করলেও এটিকে ‘গণপিটুনি’ বলতে নারাজ তিনি।

নাসিকেও একই অভিযোগ। মহারাষ্ট্রের নাসিকের ইগতপুরীতে ২৮ অগাস্ট একটি ট্রেনে গো-মাংস বহনের সন্দেহে ৭০ বছরের এক মুসলিম ব্যক্তিকে মারধরের অভিযোগ ওঠে।

চরখি দাদরির বাধরা বাসস্ট্যান্ডের পাশের মুসলিম বস্তিতে গো-মাংস খাওয়া হয়, এমন সন্দেহে গো-রক্ষকরা ২৭ অগাস্ট ঢুকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। আবারও একটি পাত্রে থাকা মাংস দেখিয়ে তারা শবরুদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে ধরে ক্যামেরার সামনে স্বীকারোক্তি আদায় করে। নিহতের পরিজন সাজাউদ্দিন সর্দারের অভিযোগ, ওইদিন সাবিরকে বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে গিয়ে চার-পাঁচজন যুবক লাঠিপেটা করে। পরে তাঁকে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই রাতে ভান্ডওয়া গ্রামের কাছে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়।

৪ নভেম্বর ২০২২, ছত্তিশগড়ের বিলাসপুর জেলায় গো-মাংস বহনের অভিযোগে দুই দলিত যুবককে অর্ধনগ্ন, রক্তাক্ত অবস্থায় স্থানীয়রা থানায় নিয়ে আসে। এর পরদিনই গণপিটুনির একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ায় ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়েছে। নরসিং রোহিদাস ও রামনিবাস মেহর নামে ওই দুই ব্যক্তিকে আহত অবস্থায় থানায় নিয়ে আসে প্রায় পঞ্চাশজনের একটি দল। অভিযোগ ছিল, তাঁরা বস্তায় ভরে মাংস নিয়ে যাচ্ছিলেন। সরকারি পরীক্ষায় তা গো-মাংস বলেই নিশ্চিত হয়। ওই রাজ্যে গো-মাংস নিষিদ্ধ। কিন্তু ওই দু’জন ব্যক্তিই দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত এবং তাঁরা চামড়া প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে যুক্ত। পুলিশ জানায়, রেললাইনে কাটা পড়া একটি বাছুরের চামড়া কাজে লাগানোর জন্য তাঁরা বস্তায় করে তা নিয়ে যাচ্ছিলেন। মৃত গরু বা বাছুর সংগ্রহ করা তাঁদের কাজের অংশ।

প্রশ্ন ওঠে, পুলিশের ভূমিকা নিয়ে। দলিত সংগঠনগুলোর অভিযোগ, অর্ধনগ্ন অবস্থায় দুই ব্যক্তিকে থানায় নিয়ে আসা এত বড় ভিড়কে সেদিনই কেন আটক করা গেল না? সংঘবদ্ধ হামলার ঘটনায় কঠোর আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি সরকার বহুবার দিলেও বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না।

আরও পড়ুন

‘ভুল করে’ ব্রাহ্মণ কিশোরকেই খুন! হাত কামড়াচ্ছে হরিয়ানার গোরক্ষক দল

তথ্য বলছে, গত কয়েক বছরে গো-মাংস ভক্ষণ বা গরু পরিবহণের অভিযোগে অন্তত ৫০ জনের বেশি মানুষ গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন, বিপুল সংখ্যক আহত। উত্তর, মধ্য ও পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন জেলায় হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত তথাকথিত ‘গো-রক্ষা বাহিনী’ সড়ক, মহাসড়ক, ট্রাকস্ট্যান্ড ও রেলস্টেশনে রাতভর টহল দেয়। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাকলেড’-এর তথ্য অনুযায়ী, গো-মাংস-সম্পর্কিত সহিংসতার সর্বাধিক শিকার মুসলিমরা। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো দেখাচ্ছে, দলিতদেরও ক্রমশ নিশানা করছে এই গোষ্ঠীগুলি।

প্রসঙ্গত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৭ সালের জুন মাসে মন্তব্য করেছিলেন, গো-রক্ষার নামে মানুষ হত্যা কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে তাঁর এই বক্তব্য প্রকাশের মাত্র ঘণ্টাখানেক পরেই গো-মাংস বহনের অভিযোগে এক মুসলিম নাগরিককে জনতা পিটিয়ে হত্যা করে। বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে উত্তেজিত জনতার হামলার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এমনকি কোথাও দুই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী দম্পতিকেও বাড়ি থেকে টেনে বের করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সামাজিক রীতি বা মূল্যবোধ রক্ষার নামে হামলা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। ইতিহাসবিদের মতে, একটি গোষ্ঠী সচেতনভাবেই আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেদের বিশ্বাসকে সঠিক মনে করছে। তাঁদের আচরণের জন্য দায়ী প্রশাসনের নীরবতা অথবা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থন। যাঁরা নিজেদের ‘রক্ষাকর্তা’ দাবি করে রাস্তায় নেমেছেন, তাঁদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করবে কে? এই গোষ্ঠীগুলিকে থামানোর দায়িত্ব আসলে কার? প্রশ্ন উঠছে, আখলাকের মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ কি আসলে আরও এক দৃষ্টান্ত স্থাপন?

More Articles