অভিজিৎ-ছোঁয়ায় মুশকিল আসান হবে ডিএ সমস্যার? যে আশায় বুক বাঁধছেন সরকারি কর্মীরা
DA Hike Demand: অভিজিৎ-ছোঁয়ায় মহার্ঘ ভাতার সমস্যা কি মিটবে?
পুলিশ তুমি যতই মারো, মাইনে তোমার ১১২! বহুদিন পর ফের বাংলার রাজপথে শোনা গিয়েছিল এই স্লোগান। চাকরিপ্রার্থীদের কামড়ানো থেকে সরকারি কর্মীদের তলপেটে ঘুষি! কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে নয়া অভিযোগ-রেকর্ডে অবাক হয়েছে রাজ্য।
কিন্তু! গতকাল অর্থাৎ বুধবার যে পুলিশ মারল, যে পুলিশ আটকে দিল বারবার তাঁরাও তো সরকারি কর্মচারী! আর এখানেই উঠেছে প্রশ্ন, যে ইস্যুতে আদতে উত্তাল হল বিধানসভা চত্ত্বর, সেই মহার্ঘ্যভাতা অর্থাৎ ডিএ বিতর্কে তো জড়িয়ে এই পুলিশও!
বুধবার দুপুর। ২৭টি কর্মচারী সংগঠনের ডাকে বকেয়া ডিএ-র দাবিতে আন্দোলনে উত্তাল হয় কলকাতার প্রাণকেন্দ্র। রানি রাসমণি রোড থেকে শুরু করে রাজ্য বিধানসভার দু'নম্বর গেট, আকাশবাণী ভবন ছাড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের অধীনে কাজ করা কর্মীদের বিক্ষোভে উত্তাল হয় এলাকা। পুলিশের সঙ্গে খন্ডযুদ্ধ, গ্রেফতারি বরণও করেন কেউ কেউ। এরপরই প্রশ্ন ওঠে ফের। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে সরব হন বহু। আর এই প্রেক্ষাপটেই বৃহস্পতিবার গ্রেফতার হওয়া সরকারি কর্মীদের নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। এসএসসি সংক্রান্ত একটি মামলার শুনানি চলাকালীন স্বতঃপ্রণোদিত মন্তব্য করেন তিনি। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ''ডিএ চাইতে গিয়ে গ্রেফতারি দুর্ভাগ্যজনক!''
আরও পড়ুন: বড় ভোটে মোদি, ছোট ভোটে মিঠুন! এবারে কার্যসিদ্ধি হবে, না কি খালি হাতেই ফিরতে হবে
আর এখানেই বেড়েছে জল্পনা। ফের একাধিক অস্বস্তির পরেও রাজ্যের শিয়রে ডিএ-বিপদ ঘনিয়ে আসতে চলেছে, এমন আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ। বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশের দাবি, ''হঠাৎ করে বিচারপতির এই তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য ডিএ-ইস্যুতে ফের বিপদ বাড়াতে পারে রাজ্যের সরকারের।'' কারণ হিসেবে ওই অংশেরই দাবি, ''একাধারে ডিএ মামলায় ফেঁসে রয়েছে রাজ্য। মামলা গড়িয়েছে দেশের শীর্ষ আদালতের দরবারে। আবার কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ বিক্ষোভে, টাকা না পাওয়ায় অভিযোগে অতিষ্ঠ হচ্ছে সরকার। সব মিলিয়ে এই বিক্ষোভ এবং রাজ্যের জনপ্রিয় বিচারপতির এই যেচে মন্তব্য ফের ঝড় তুলতে পারে নবান্নে।''
কিন্তু কেন? রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা নিয়ে বিক্ষোভ, আন্দোলন এবং অভিজিৎ-মন্তব্য নিয়ে ফের কেন প্রশ্নের অবতারণা! কেন তৈরি হচ্ছে বিতর্কও? একাধিক জল্পনা আর প্রশ্নের আমেজে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
বঙ্গের ডিএ বিতর্ক
২০০৯ সাল। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রণজিৎ কুমার বাগের বেঞ্চ নির্দেশ দেয় আগামী ৬ মাসের মধ্যে রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া মহার্ঘ্যভাতা মিটিয়ে দেওয়ার জন্য। ঠিক এই বছরেই পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনিক ট্রাইবুন্যালের (SAT) তরফেও নির্দেশ দেওয়া হয় বকেয়া ভাতা মিটিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু এই নির্দেশের পরেই রাজ্যের তরফে ফের রিভিউ পিটিশন জারি করা হয়। বেশকিছু দিন মামলা চলার পরে ২০ মে, ২০২২-এ এসে কলকাতা হাইকোর্টের তরফে আসে ঐতিহাসিক রায়।
বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন আর বিচারপতি রবীন্দ্রনাথ সামন্তের ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, তিন মাসের মধ্যে ২০০৯ সাল থেকে বাকি থাকা মহার্ঘ্যভাতা এরিয়ার-সহ মিটিয়ে দিতে হবে রাজ্যের সরকারকে। এই রায়ের পরেই অস্বস্তিতে পড়ে সরকার।
১৯ আগস্ট, ২০২২। ডিএ মেটানোর সময়সীমা শেষ হলেও রাজ্যের তরফে সেইভাবে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উপরন্তু রিভিউ পিটিশন দাখিল করে সরকার। সেই আবেদন খারিজ হতেই শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয় রাজ্য। বিশেষ ছাড়ের জন্য পিটিশন দাখিল করে সরকার। সেই আবেদনে ত্রুটি থাকায় ফের সংশোধিত পিটিশন জমা দিয়েছে সরকার। আগামী সপ্তাহেই সেই আবেদনের শুনানি হওয়ার কথা সুপ্রিম কোর্টে।
কত বাকি ডিএ?
প্রত্যেক বছর নির্দিষ্ট সময় অন্তর খুব একটা না বাড়লেও এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩১ শতাংশ ডিএ বাকি রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের। যে বকেয়ার কবলে রয়েছেন কয়েক লক্ষ পেনশনভোগীও। এর সঙ্গে সম্প্রতি বেড়ে যাওয়া প্রায় ৪ শতাংশ ডিএ যোগ করলে সেই বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়ায় কমপক্ষে ৩৪ শতাংশ!
কেন্দ্র-রাজ্যের ডিএ ফারাক
কেন্দ্রের কর্মচারীদের বছরে কমপক্ষে দু'বার বাড়ে মহার্ঘ্যভাতা। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩৮ শতাংশ ডিএ পান তাঁরা। যা রাজ্যের তুলনায় অনেকটা কম।
কেন দেওয়া হয় ডিএ
রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের মূল বেতনের ওপর নির্ভর করে প্রত্যেক মাসেই একটি নির্দিষ্ট শতাংশ পরিমাণে টাকা অতিরিক্ত দেওয়া হয়। অর্থাৎ কারও মোট বেতনের যেটুকু অংশ মূল বেতন বা 'বেসিক স্যালারি' হিসেবে নির্ধারিত হয়, তার উপরে ওই অতিরিক্ত শতাংশ মহার্ঘ ভাতা প্রদান করা হয়। যা নির্ধারিত হয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং বাজারমূল্য অনুযায়ী। এখানেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। বহুকাল ধরে বাজারমূল্য বাড়লেও মহার্ঘ্যভাতা সেই তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে নগণ্য! উঠেছে এই অভিযোগও।
রাজ্যের ডিএ অবস্থান
রাজ্যের তরফে কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে রায়ের পরেও ডিএ মেটানো নিয়ে তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরঞ্চ আইনি পদ্ধতিতে আরও সময় চাওয়ার দিকেই এগিয়েছে সরকার। মূলত, কেন্দ্রীয় প্রকল্পে টাকা না দেওয়ার অভিযোগ এবং রাজ্যের কোষাগারের টানকে ঢাল করে সরব হয়েছেন শাসকদলের নেতারা।
সম্প্রতি, রাজ্য বিধানসভার একটি অধিবেশন চলাকালীন মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, "সরকার মহার্ঘ্য ভাতা দিতে চায়, আটকে রাখতে চাইছে না। কিন্তু একাধিক প্রকল্পের কথা, মানুষের কথা ভাবতে হয় সরকারকে। অনেকের খাবার জোটে না। সেখানে দাঁড়িয়ে তো সরকারি কর্মীদের খাবার জোগাড় হয়। অনেকে তো সেটাও পারেন না!'' যদিও এই প্রসঙ্গে বেশ কয়েক মাস আগেই বিতর্ক বাড়ান রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই। তিনি একটি অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে বলেন, ''বেশি ঘেউ ঘেউ করবেন না।'' সেই মন্তব্যে ঝড় ওঠে, বিতর্কও হয় বিস্তর।
ডিএ বিক্ষোভ
বাম কর্মচারী সংগঠন থেকে শুরু করে তৃণমূলপন্থী সরকারি কর্মচারীদের সংগঠন ছাড়া, রাজ্যের একাধিক সংগঠনের তরফে বারবার উত্তাল হয় পরিস্থিতি। বুধবারের বিক্ষোভের মতো সরকারের বিরুদ্ধে সরব হন তাঁরা। দাবি, প্রাপ্য মিটিয়ে দেওয়া। এদিকে চাকরি দুর্নীতি অন্যদিকে সেই সরকারের কর্মচারীদের ডিএ না পাওয়ার অভিযোগ থেকে এই প্রসঙ্গে আদালত অবমাননার অভিযোগ; একাধিক ক্ষেত্রে বারবার বিতর্কের কেন্দ্রে জায়গা করেছে মমতার নেতৃত্বাধীন সরকার। বামেদের সরকারি কর্মচারী সংগঠনের এক নেতার কথায়, ''সরকার এমন একটা ভাব করে যেন আমাদের টাকা দিয়ে উদ্ধার করছে। আসলে ওঁকে ভাবতে হবে, এই দাবি আমাদের অধিকার নিয়ে, প্রাপ্য সংক্রান্ত দাবিতে। এই ভাতা আটকে রাখার অন্যায় অধিকার মমতার সরকারের নেই!''
ডিএ বিতর্কে অভিজিৎ-যোগ
মহার্ঘ ভাতা নিয়ে বিক্ষোভ এবং আদালতের বেড়াজালে মধ্যেই শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির ত্রাস বিচারপতি অভিজিতের মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফের অস্বস্তিতে পড়েছে সরকার। বারবার আদালতের রায় এবং সেই সংক্রান্ত বিতর্কের মধ্যেই কেন এমন বলে দিলেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়? অনেকেই বলছেন, একাধিকবার সরকারের বিপদ বাড়ানো এই বিচারপতি সরকারি কর্মচারীদের ডিএ সংক্রান্ত মামলার অংশ না হলেও পরোক্ষে হয়তো আইনি পথে অন্য লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন তিনি। যা অচিরেই সৃষ্টি করতে পারে নতুন ইতিহাসও। আর এখানেই ফের উঠছে প্রশ্ন। তাহলে কি অভিজিৎ ছোঁয়ায় মুশকিল আসানে পা দেবে মহার্ঘ ভাতাও?