দুর্গ, ইতিহাস আর বিলাস যেখানে মাখামাখি, এই শীতে ছুটির গন্তব্য হোক নীল শহর
Jodhpur Travel: রামায়ণে রাবণের স্ত্রী মন্দোদরীর বাবার বাড়ির এলাকা, অর্থাৎ রাবণের শ্বশুরবাড়ির এলাকা হল মান্দোর।
জাদুর শহর যোধপুর। জয়পুর থেকে ৩৫০ কিমি দূরত্বে অবস্থিত এই শহর অমোঘ এক হাতছানির নাম ভ্রমণপ্রিয় মানুষের কাছে। শোনা যায়, এক সময় বর্ণভেদ প্রথার কারণে এই শহরের সব বাড়ি নীল রঙে সজ্জিত হয়েছিল, তাই একে আজও নীল শহর বলেই ডাকা হয়। ইতিহাস অনুযায়ী, প্রাচীন মারওয়াড় রাজ্যের রাজধানী ছিল এই যোধপুর। আর এখন রাজস্থানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। বলা হয়, মরু দেশে প্রবেশের দরজাও এই শহরের মধ্যেই। রাঠোর বংশের রাজপুত প্রধান রাও যোধা ১৪৫৯ সালে এই শহর প্রতিষ্ঠা করেন। শীত পড়ে গেছে বেশ, ছুটির মরশুম সমাগত। স্কুলের ছুটি, অফিসের কম কাজ সামলে যদি মন ইতিহাসের নীল গন্ধ পেতে চায় তাহলে স্থাপত্যের গাম্ভীর্যে আর নিরিবিলিতে অনেকটা সময় কাটাতে হলে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন যোধপুরের দিকে। জাদুর এই শহর চোখ আর মন দুই জুড়িয়ে দিতে বাধ্য।
১. মেহেরানগড় ফোর্ট
যোধপুরের মেহেরানগড় দুর্গ ১৫ শতকের ভারতীয় স্থাপত্যের নিদর্শন। প্রাচীন এই দুর্গটি রাজপুত রাজা রাও যোধার আমলে ব্লু সিটির মানুষদের রক্ষা করার জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। দুর্গের প্রবেশদ্বারে ৭ টি দরজা আছে– বিজয় গেট, ফতেহ গেট, গোপাল গেট, ভৈরব গেট, দেধ কামরা গেট, মার্টি গেট এবং লোহা গেট। এইসব 'গেট' ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তৈরি করা হয়েছিল। গোটা দুর্গের দেওয়ালে প্রাচীন ভারতীয় শিল্পকর্ম খোদাই করা হয়েছে। প্রাসাদ, সৈন্যবাহিনী, মন্দির, ঘরবাড়ি নিয়ে একসময় জমজমাট এই দুর্গ মুঘলদের কাছেও অজেয় ছিল।
আরও পড়ুন- বিষাক্ত হ্রদ, ভুতুড়ে বাংলো, উন্মুক্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা! দার্জিলিং নয়, এবার শীতে পাড়ি দিন এই পাহাড়ে
এই দুর্গের সচেয়ে সুন্দর মহলগুলি হল– শিশমহল, যা রাজা অজিত সিং প্রায় হাজারের বেশি আয়না দিয়ে তৈরি করেছিলেন। যার একটা আয়নায় আলো পড়লেই পুরো মহল ঝলমল করে উঠত। এছাড়া রয়েছে ফুলমহল যা অজিত সিংয়ের পুত্র অভয় সিং সোনা, রূপো এবং বিভিন্ন মূল্যবান পাথর দিয়ে তৈরি ফুল দিয়ে গড়েছিলেন। চোখ ফেরানো যায় না এই মহলের কারুকার্য থেকে।
২. উমেদ ভবন প্যালেস
যোধপুরের আরেকটি আকর্ষণ হল এই প্যালেস। বিশ্বের বৃহত্তম ব্যক্তিগত বাসভবনের মধ্যে এই প্রাসাদ অন্যতম। বলা হয়, পৃথিবীতে এই একটি প্রাসাদই তৈরি হয়েছিল বিংশ শতাব্দীতে। বাকি সব প্রাসাদ তার থেকে প্রাচীন৷ যোধপুরের অন্যতম আকর্ষণ উমেদ প্যালেসের একটি অংশে পরিবার নিয়ে থাকেন মহারাজা গজ সিং দ্বিতীয়। বাকি অংশে আছে সংগ্রহশালা। এ ছাড়া বাকি অংশ এখন বিলাসবহুল হোটেল। রক্ষণাবেক্ষণ করে তাজ গ্রুপ। কথিত আছে, ১৯২৯ সালে মহারাজা উমেদ সিং খরাগ্রস্ত প্রজাদের রোজগারের সুবিধার জন্য এই প্যালেস গড়ে তোলেন। প্রায় ৩ হাজার প্রজা ১৩ বছর ধরে পরিশ্রম করে তৈরি করেন এই অভিনব প্যালেস।
মোট ৩৪৭ টি ঘর আছে এই প্যালেসে। ২৬ একর জমির উপর বিস্তৃত এই প্রাসাদে রাজকীয় জীবনযাপনের সব উপকরণ মজুত। রাজ দরবার, বিশাল ভোজনকক্ষ, নাচের ঘর, পাঠাগার, একাধিক সুইমিং পুল, স্পা, বিলিয়ার্ড খেলার ঘর, টেনিস ও স্কোয়াশ খেলার কোর্ট-সহ বিলাসিতার অঢেল আয়োজন। প্রাসাদ তৈরির উপকরণ আনানোর জন্য আস্ত রেললাইনই বসিয়ে ফেলেছিলেন রাজা উমেদ সিং।
৩. যশবন্ত থাডা
ব্লু সিটির আরও একটি আকর্ষণ এই জাদুঘর যশবন্ত থাডা। ১৮৯৯ সালে মহারাজা সর্দার সিং তাঁর পিতা মহারাজা যশবন্ত সিংয়ের স্মরণে শ্বেতপাথরের এই স্মারক সৌধ নির্মাণ করেছিলেন। সৌধের ভেতরে মহারাজা যশবন্তের একটি বড় ছবি রাখা আছে। এছাড়া আছে একটি ছোট মন্দির, সাজানো বাগান এবং সৌধের প্রবেশপথে একটি সুন্দর হ্রদ। শীতকালে এখানে পরিযায়ী পাখিদের দেখা মেলে।
৪. মান্দোর গার্ডেন
কথিত আছে, রামায়ণে রাবণের স্ত্রী মন্দোদরীর বাবার বাড়ির এলাকা এই মান্দোর, অর্থাৎ রাবণের শ্বশুরবাড়ির এলাকা। বিস্তৃত মান্দোর গার্ডেনে রয়েছে উঁচু পাথরের পাহাড়ি ছাদ, যা এটিকে একটি জনপ্রিয় স্থানীয় আকর্ষণ করে তুলেছে। যোধপুরের প্রাক্তন শাসকদের স্মৃতিসৌধও এখানে দেখা যায়। এই সৌধগুলি লাল বেলেপাথর দিয়ে নির্মিত। মান্দোর গার্ডেনে ‘দ্য শ্রাইন অফ থ্রি হান্ড্রেড মিলিয়ন’ নামে বড় হলঘর আছে। মান্দোর গার্ডেনে একটি সরকারি জাদুঘরও রয়েছে যা বিগত যুগের বিভিন্ন নিদর্শনগুলির একটি চমৎকার সমাহার। কাছাকাছি পাহাড়ে উঠলে, প্রাসাদ এবং মান্দোর দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। রাবণ মন্দিরও মান্দোরের অন্যতম আকর্ষণ।
৫. বলসামন্দ লেক
যোধপুরের একটি জনপ্রিয় পিকনিক স্পট বলসামন্দ লেক। ১১৫৯ সালে বালাক রাও পারিহার যোধপুরের তৎকালীন রাজধানী মান্দোরে জল সরবরাহের জন্য এই জলাধার নির্মাণ করেছিলেন। প্রকৃতির অনন্য সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে এখানে আসতেই হবে। বর্ষাকালে ময়ূরের নাচ এই হ্রদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
৬. মহামন্দির
যোধপুরের বিখ্যাত মন্দিরগুলির মধ্যে মহামন্দির অন্যতম। ১৮১২ সালে তৈরি এই মন্দির ৮৪ টি স্তম্ভ দ্বারা সমর্থিত। এইসব স্তম্ভে যোগ ভঙ্গি, ফুলের নকশা এবং বিভিন্ন মূর্তি খোদাই করা আছে। বলা হয়, মহাদেবের উপাসনাকারী প্রধান মন্দিরের মধ্যে এটি একটি। প্রাচীন দ্রাবিড়ীয় শৈলীতে নির্মিত এই মন্দির তার চমৎকার গঠন এবং অনবদ্য সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। মন্দিরের ভেতরের দেওয়ালগুলি বিভিন্ন ম্যুরাল দিয়ে সজ্জিত।
৭. চামুণ্ডা মাতা মন্দির
মেহেরানগড় দুর্গের শেষ প্রান্তে অবস্থিত চামুণ্ডা মাতা মন্দির যোধপুরের প্রাচীনতম এবং সবথেকে সম্মানিত মন্দির। চামুণ্ডাকে যোধপুরের বাসিন্দাদের প্রধান দেবতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং রাজপরিবারের ইষ্ট দেবতা হিসেবেও দেবী প্রাধান্য পান। দশেরা এবং নবরাত্রির সময় এই মন্দিরে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। বলা হয়, চামুণ্ডা রাঠোর রাজপুত রাও যোধার প্রিয় দেবতা ছিলেন এই কারণে ১৪৬০ সালে সম্পূর্ণ ধর্মীয় রীতি মেনে চামুণ্ডা দেবীকে মেহেরানগড় দুর্গে স্থাপন করা হয়েছিল। এই মন্দির ভক্তদের পাশাপাশি ঐতিহাসিক এবং শিল্পপ্রেমীদের কাছেও আকর্ষণের বিষয়।
৮. কায়লানা লেক
কায়লানা লেক একটি কৃত্রিম হ্রদ যা যোধপুরের পশ্চিম দিকে অবস্থিত। ৮৪ বর্গকিমি জুড়ে বিস্তৃত এই হ্রদ যোধপুরের প্রত্যেক পর্যটকের জন্য দর্শনীয় স্থান। কায়লানা হ্রদ প্রতাপ সাগর নামে এক বাগানের সঙ্গে জুড়ে আছে যেখানে বিভিন্ন বিদেশি প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। যোধপুরের রাজা প্রতাপ সিং ১৮৭২ সালে এই হ্রদ নির্মাণ করেছিলেন। হ্রদের চারপাশে বন্য ভাল্লুক এবং শীতকালে সাইবেরিয়ান ক্রেনের দেখা পাওয়া যায়। এই হ্রদের সবথেকে অমূল্য আকর্ষণ সূর্যাস্ত, এইসময় পুরো আকাশই হয়ে ওঠে প্রকৃতির নিজস্ব ক্যানভাস।
৯. অর্ণা-ঝর্ণা
পাহাড়ি এলাকা, সবুজের সমাহার, সুন্দর জলপ্রপাত, পাখির কিচিরমিচির, বিভিন্ন প্রজাতির গাছ এবং মনোরম পরিবেশ। এমন জায়গা পেতে হলে যেতে হবে অর্ণা-ঝর্ণাতে। এটি যোধপুরের জ্ঞান গবেষণা এবং উন্নয়ন কেন্দ্র। প্রখ্যাত লোকশিল্পী কোমল কোঠারি এই জাদুঘর নির্মাণ করেছিলেন। এই পর্যটন স্থানটি যোধপুর থেকে ২৩ কিমি দূরে মোকালাওয়াস গ্রামের কাছে অবস্থিত। জাদুঘরটি দশ একর জমির উপর নির্মিত। কাছেই রয়েছে অর্ণেশ্বর মহাদেব মন্দির, যেখানে বর্ষাকালে একটি ঝর্ণা প্রবাহিত হয়। এর নামেই এই জাদুঘরটির নাম অর্ণা-ঝর্ণা। জাদুঘরের সীমানা প্রাচীরের কাছে একটি পুকুর আছে যা রাইমাল তালাব নামেও পরিচিত। জাদুঘরের সুন্দর ও মনোরম অবস্থান দেখে ভাবা সত্যিই কঠিন যে এই জমি একসময় পাথরের টুকরোতে পরিপূর্ণ ছিল।
আরও পড়ুন- প্রাচীন চোখ ধাঁধানো প্রাসাদ, সাদা ময়ূর আর শীতের ছুটি! বাঙালির নয়া ঠিকানা এই শহর
১০. খেজরলা দুর্গ
১৭ শতকে যোধপুরের মহারাজা প্রাচীন এই দুর্গ নির্মাণ করেন। ৪০০ বছর আগে তৈরি এই দুর্গ আজ হোটেলে রূপান্তরিত। গ্রানাইট পাথর এবং লাল বেলেপাথর দিয়ে তৈরি এই দুর্গ রাজপুত স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন।
১১. সচিয়া মাতা মন্দির
রাজস্থানের ধূ ধূ মরুভূমির মধ্যে এক চিলতে মরূদ্যান হিসেবে উঠে আসে সচিয়া মাতা মন্দির। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এই বিরল মন্দির শিল্পসৌন্দর্যের দিক থেকেও অভিনব। অষ্টম শতাব্দীতে যে উপকেশপুর ছিল জমজমাট বাণিজ্য কেন্দ্র, এমনকী মেবার রাজত্বের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলির মধ্যেও গুরুত্বপূর্ণ, সেই সমৃদ্ধ নগরীতেই গড়ে উঠছিল মন্দিরটি। ১২০০ শতাব্দীর শেষের দিকে মহম্মদ ঘোরির আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায় এই জনপদ। আজ তা মরুভূমিতে চাপা পড়া এক ধ্বংসস্তূপ মাত্র। সেই প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে কেবল রয়ে গিয়েছে আঠেরোটি মন্দির। যার মধ্যে অন্যতম সচিয়া মাতার মন্দিরও।