প্রাচীন চোখ ধাঁধানো প্রাসাদ, সাদা ময়ূর আর শীতের ছুটি! বাঙালির নয়া ঠিকানা এই শহর

Mysore Tourism: ১৮৯৭ সালে পুরনো কাঠের রাজপ্রাসাদ এক অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে রাজা চতুর্থ কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ের এই বিশাল রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন।

সুবিশাল প্রাসাদ, সুদৃশ্য বাগান, ভারতের অন্যতম পুরনো এবং বড় চিড়িয়াখানা, পাহাড়, ধর্মস্থান, বিখ্যাত একটি বাঁধ, মিষ্টি, সিল্কের শাড়ি। কর্ণাটকের মাইসুরু যেন এই সব কিছুকে একসঙ্গে বেঁধে রেখেছে। মাইসোর যার বর্তমান নাম মাইসুরু, তাকে কর্ণাটকে ঘুরতে যাওয়া বাঙালিরা বেশি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য হিসাবে গণ্য করে না। বেশিরভাগ বাঙালিই তাঁদের প্রধান গন্তব্যে যাওয়ার পথে যতটা কম সময় দেওয়া সম্ভব ঠিক ততটাই মাইসুরুর ঝুলিতে দিয়ে থাকেন। তাই এক বিশাল জগৎ তাঁদের চোখের আড়ালে থেকে যায়। এই মানসিকতার বদল ঘটিয়ে একটু পরিকল্পনা করে বেশি সময় ব্যয় করলেই আমাদের চোখের সামনে উঠে আসবে অতীতের অধ্যায় থেকে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। ভ্রমণকারীদের চোখ দিয়ে দেখলে মাইসুরুকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ এবং নানান কেনাকাটা করার জন্য এক আদর্শ স্থান।

মাইসোর প্যালেস 

সিংহ দরজা থেকে খাঁটি রুপোর দরজা, প্রকাণ্ড দালান থেকে দরবার, কামান এবং বিভিন্ন রকমের অস্ত্র থেকে সিংহাসন, রাজ পরিবার এবং সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ছবি থেকে রাজার পাওয়া বিভিন্ন উপহার সবকিছুই রয়েছে এই বিশাল রাজপ্রাসাদে। ১৮৯৭ সালে পুরনো কাঠের রাজপ্রাসাদ এক অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে রাজা চতুর্থ কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ের এই বিশাল রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। এই প্রাসাদ তৈরি করতে ১৫ বছর সময় লেগেছিল এবং সেই আমলে প্রায় ৪২ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল। রাজপ্রাসাদ ছাড়াও একটি মন্দির এবং রাজ পরিবারের আত্মীয়দের থাকার জায়গা এবং এক বিশাল বাগান এই প্রাসাদের চত্বরে রয়েছে। মাথাপিছু ১০০ টাকা মূল্যের টিকিটের বিনিময়ে এই প্রাসাদ চত্বরে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যায়। প্রধান রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করার আগে জুতো খুলে রেখে প্রবেশ করতে হয়। সেই ক্ষেত্রে মাথাপিছু ২ টাকার বিনিময়ে জুতো রাখার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। রাজপ্রাসাদের আকার এবং পরিকল্পনা মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার সঙ্গে টাইম মেশিনের মতো ইতিহাসের যাত্রাও করিয়ে আনতে পারে।

আরও পড়ুন- বিষাক্ত হ্রদ, ভুতুড়ে বাংলো, উন্মুক্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা! দার্জিলিং নয়, এবার শীতে পাড়ি দিন এই পাহাড়ে

মাইসোর চিড়িয়াখানা

ব্রাহ্মীণি চিল থেকে সাদা ময়ূর, জিরাফ থেকে বাঘ- বিভিন্ন রকমের প্রাণী দেখতে পাওয়া যায় দক্ষিণ ভারতের অন্যতম বড়, পুরনো এবং বিখ্যাত এই চিড়িয়াখানায়। এছাড়া অন্ধ্রপ্রদেশে আবিষ্কৃত জুরাসিক যুগের একটি গাছের ফসিল রাখা হয়েছে এই চিড়িয়াখানায়। ১৮৯২ সালে এই চিড়িয়াখানা স্থাপিত হয়েছিল। মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি দিনে সকাল সাড়ে আটটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা অবধি চিড়িয়াখানা জনসাধারণের জন্য খোলা থাকে। পাঁচ বছরের বেশি বয়সী যে কোনও মানুষের ক্ষেত্রে মাথাপিছু ১০০ টাকার বিনিময়ে এই চিড়িয়াখানায় প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যায়।

চামুণ্ডি হিল

চামুণ্ডি পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে মাইসুরু এবং পাহাড়ের উপরে রয়েছে দেবী চামুণ্ডেশ্বরীর মন্দির। স্থানীয় লোককথা অনুযায়ী, চামুণ্ডেশ্বরী দেবী মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, অতীতে এক হাজারের বেশি সিঁড়ি চড়ে এই মন্দিরে পৌঁছতে হতো। যদিও বর্তমানে সেই পরিমাণ সিঁড়ি চড়ার দরকার পড়ে না। গাড়িতে চেপেই পাহাড়ের উপরে পৌঁছনো সম্ভব। সেখান থেকে অল্প কিছু সিঁড়ি চড়েই মন্দির চত্বরে প্রবেশ করা যায়। মন্দির সকাল সাতটা থেকে দুপুর দুটো, বিকেলে তিনটে থেকে সন্ধ্যা ছয়টা এবং সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে ন'টা অবধি ভক্তদের জন্য খোলা থাকে। চামুণ্ডি পাহাড়ে রয়েছে ১৬ ফুটের নন্দীর মূর্তি যা ভারতের অন্যতম বড় নন্দী মূর্তি। এই পাহাড় শুধুমাত্র ধর্মস্থান হিসাবেই পরিচিত নয়, পাহাড়ের একটি নির্দিষ্ট জায়গা থেকে পাহাড়ের পাদদেশে থাকা পুরো শহর দেখতে পাওয়া যায়। টিকিট কেটে দূরবীনে চোখ লাগিয়ে অথবা খালি চোখে যেই দৃশ্য উপভোগ করা যায় তা ক্যামেরার লেন্সে ধরা অথবা বলে বোঝানো খুবই কঠিন কাজ।

আরও পড়ুন- সিকিম, সিটং অনেক হল! এই শীতে হাতের নাগালেই রয়েছে ‘ভারতের স্কটল্যান্ড’

বৃন্দাবন গার্ডেন এবং কে.আর.এস বাঁধ

মাইসুরুর প্রধান শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরত্বে মাণ্ড্য জেলায় কাবেরী নদীর উপর তৈরি হয়েছিল কৃষ্ণরাজা সাগর বাঁধ। এই বাঁধের পাশেই গড়ে ওঠা সুদৃশ্য বাগানের নাম হলো বৃন্দাবন গার্ডেন। ১৯২৭ সাল থেকে এই বাগান তৈরির কাজ শুরু হয় এবং পাঁচ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৩২ সালে এই বাগান সম্পূর্ণ রূপে তৈরি হয়। রকমারি ফুলের গাছ, সুদৃশ্য ফোয়ারা এবং একটি বিশাল জলাশয়ে নৌকাবিহারের সুবিধা বাগানে রয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে সুবিশাল বাঁধ। মাথাপিছু পনেরো টাকা মূল্যের টিকিটের বিনিময়ে এই পার্কে প্রবেশ করার অনুমতি পাওয়া যায়। সন্ধ্যার পরে আলোর মালা পরে পুরো বাগান সেজে ওঠে তাই বিকেল নাগাদ এই বাগানে ঘুরতে গেলে তার দুটো রূপ লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া মাইসুরুর রেল জাদুঘরে ভারতের প্রথম দিকের তৈরি স্টিম ইঞ্জিন, সিগন্যালিং ব্যবস্থা, পুরনো স্টেশনের দরজার পাল্লা, টিকিট এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়।

মাইসোর সিল্ক এবং মাইসোর পাক 

সমগ্র কর্ণাটকের মধ্যে সবথেকে বেশি সিল্কের শাড়ি তৈরি করার জন্য মাইসুরু যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছে। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং ধনী সকলের জন্য বিভিন্ন দামে বহু দোকানে মাইসোর সিল্ক পাওয়া যায়। মাইসোর পাক মাইসুরুর অন্যতম বিখ্যাত মিষ্টি। বাঙালির কাছে যেই এলাকা টকের দেশ বলে পরিচিত সেখানকার একটি বিখ্যাত মিষ্টির স্বাদ বাঙালির পরিচিত দিলখুশের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের মাইসোর পাক পাওয়া গেলেও তাদের স্বাদের মধ্যে খুব বেশি তারতম্য লক্ষ্য করা যায় না। মাইসুরুর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তার অবস্থান। তার চমৎকার অবস্থানের কারণে তাকে কেন্দ্র করে আশেপাশের কিছু গন্তব্য ঘুরে বাঙালি একটা ছোট শীতের ছুটি কাটিয়ে আসতে পারে।

 

More Articles