শীত শীত ভাব, দেদার চুমুক কফিতে, অজান্তেই ডেকে আনছেন না তো ভয়ানক বিপদ?
Winter : কফি পানের উপকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
সুমনের গানে ‘এক কাপ চা’ নিয়ে অনেক কিছু চাওয়া পাওয়ার হিসেব মেলে নিরন্তর, কিন্তু চায়ের ঘোরতর প্রতিযোগি কফি নিয়ে সেরকম কোনও পরিচিত হিসেবের তর্জমা নেই বাংলায়! যদিও তাতে কফিপ্রেমী বাঙালির কিছুই যায় আসে না। আজকাল কলকাতা, এমনকী শহরতলির অলিতে গলিতে ‘ক্যাফে’। ব্যস্ত জীবনের অবসরটুকু সেখানেই দেদার বিকোচ্ছে রোজ। পাড়ার মোড়ের ছোট ঘুমটি দোকানে দশ কুড়ি টাকাতে কফি মিললেও, ক্যাফের ছাদের নিচে গেলে নিদেনপক্ষে শ’খানেক টাকা খসবেই। দাম বাড়তে বাড়তে হাজার ছুঁলেও সন্ধ্যেটা জাঁকিয়ে বসেন কাপ ভর্তি কফিই।
কফি নিয়ে গান নেই বললে বুঝি মান্না দে এক্ষুনি রেগেমেগে চড়াও হতে পারেন। তার বন্ধু নিখিলেশ অথবা মইদুলও শুনতে পেলে এক হাত নেবেন আশা করি। কফির আড্ডার কথা সেই কবে থেকেই চর্চিত। আজও কলেজস্ট্রিটে ঢুঁ মারলে চোখে পড়ে সেই সেকেলে বাড়িটা। তক্ষুনি বুঝি মান্না বাবু টাইম ট্রাভেল করে এসে কানে কানে মনে করিয়ে যান সেই না থাকা আড্ডাটার কথা। তবুও কথা হয়, হেঁশেল থেকে আসে কফির গন্ধ। ইনফিউশানে ফুঁ দিতে দিতেই শুরু হয়ে যায় কথোপকথন।
আরও পড়ুন - কাপেই নয় শুধু, তুফান উঠুক চিন্তায়ও- আলোআঁধারির কফিহাউজ
রাস্তা হোক, বা বাড়ি শীতের সন্ধ্যেটা জুড়ে বসে কফি কাপ। বিয়েবাড়ির হাজার সুস্বাদু খাবারের ভিড়েও জেল্লা হারায় না কাগজের কাপে রাখা কফিটি। মুদিখানার দোকানের হিসেবের খাতাটায় উঁকি মারলেও মেলে জনপ্রিয়তার হদিশ। বিভিন্ন ধরনের কফির চল রয়েছে বাংলায়। যেমন- অ্যামেরিকানো, এসপ্রেসো, ক্যপাচিনো কফি, ল্যাটে কফি, আইরিশ কফি, মকা চিনো কফি অথবা ডায়েট যুগের ব্ল্যাক কফি ইত্যাদি। যদিও বাংলার ঘরে ঘরে এখনও সাবেক আমলের দুধ, চিনি দিয়ে ফুটিয়ে কফিয়ে খাওয়ার রেওয়াজই বেশি।
কফির উৎপত্তি নিয়ে অনেক মত থাকলেও, এর সূচনা ১৩শ শতাব্দীতে ইথিওপিয়ায়। তবে কফি পানের প্রথম দৃঢ় প্রমাণ পাওয়া যায়, ১৫ শতকের মাঝামাঝি ইয়েমেনের সুফি মঠে। ১৬ শতকের মধ্যে এটি মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার বাকি অংশে পৌঁছায়। যদিও ভারতে আগমন হয় বেশ কিছুটা পরে। ১৬৭০ সালে। ভারতে চায়ের আগমন টা ব্রিটিশদের হাত ধরে হলেও কফির আগমন কিন্তু তাদের হাত ধরে আসেনি। বাবাবুদান নামের একজন ভারতীয় সাধু প্রথম কফির বীজ নিয়ে আসেন দক্ষিণ ভারতে। সেখান থেকেই তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। তবে এখনও দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতেই বেশি ফলন হতে দেখা যায় কফির। যদিও এই সব হিসেব দেখে কফিতে চুমুক দেন না কেউই। সুখ চুমুকে এসব বিশেষ লাগেও না। কিন্তু উপকার, অপকারের বিধানটুকু না জানলে তো সমূহ বিপদ। তাই আসুন জেনে নেওয়া যাক, যা খাচ্ছেন তাতে কী কী উপকার হচ্ছে শরীরে, অপকারই কী কী ডেকে আনছেন অজান্তেই।
কফি পানের উপকারিতা
কফিতে ক্যাফেইন থাকায় তা সেবনে শরীরে এনার্জি বৃদ্ধি পায়। যদিও হৃদপিণ্ডের গতিও বাড়িয়ে দেয় কফি। কিন্তু উদ্যম ও উৎসাহ তৈরি করে বলে খেলাধুলার আগে কফি পান করলে ভালো হয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে মানসিক চাপের সময়, ২০০ মি.গ্রাম ক্যাফেইন শরীরে গেলে মনযোগ বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে এও প্রমাণ মিলেছে স্মৃতিভ্রংশ জনিত রোগের ক্ষেত্রেও বিশেষ উপকারী পদার্থ ক্যাফেইন। এছাড়াও লিভার বা যকৃতের অতিরিক্ত মেদ কমাতে সাহায্য করে কফি। পাশাপাশি টাইপ টু ডায়াবেটিস, ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগের ঝুঁকি কমাতেও দারুণ কার্যকরী কফি। তবে সব থেকে বেশি প্রমাণ মেলে যে গুণটির তা হল এর ক্লান্তি দূর করা। কফির গন্ধেই কেটে যায় বিষাদভাব। সঙ্গে সঙ্গে চাঙ্গা হয়ে যায় শরীর।
তবে চিকিৎসকদের মতে, যত ইচ্ছা কফি খাওয়া যায় না। কফির উপকারিতা পেতে, সঠিক পরিমাণে খেতে হবে। এক জন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ৪০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত কফি খেতেই পারেন। এক কাপ কফিতে প্রায় ৭০ থেকে ১৪০ মিলিগ্রাম ক্যাফিন থাকে। কফি খাওয়ার সময়ে তাই এই পরিমাণটা ভুলে গেলে চলবে না। তবে দিনে ৪-৫ কাপের বেশি কফি না খাওয়াই ভালো।
কফির পানের অপকারিতা
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে ক্যাফেইন হৃদপিণ্ডের রক্তসরবরাহকরী ধমনীতে রক্ত চলাচল ধীর করে দেয়। বিশেষ করে যখন বেশি দরকার, যেমন: ব্যায়ামের সময়। তাছাড়া বুকধড়ফড়ানি, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন বা উচ্চ রক্তচাপের জন্যেও শরীরের অতিরিক্ত ক্যাফেইন দায়ী। এছাড়াও চা বা কফি জাতীয় পানীয় সেবনের সবচাইতে পরিচিত খারাপ দিকটি হল ঘুমের ব্যাঘাত। কাজের সময় ঘুম পেলে আজকাল হামেশাই সকলে চুমুক দেন কফিতে কিন্তু তারা কি জানেন এতে ডেকে আনছে ভয়াবহ ক্ষতি?
গবেষকরা জানাচ্ছেন, যারা দিনে তিন কাপের বেশি কফি পান করেন তাদের ঘুমের পরিমাণ তলানিতে ঠেকতে পারে। আরও একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে অন্য একটি গবেষণায়। দেখা গেছে, যারা কফি খান না তাদের থেকে কফি পানকারীদের ৭৯ মিনিট কম ঘুম হয়। চিনি ছাড়া কফি তুলনায় কম ক্ষতিকর হলেও সারাদিনে অন্যান্য খাবারে চিনির পরিমাণ হিসেব করলে যদি দাঁড়ায় ১১ টেবিল-চামচের বেশি তবে কফিতে চিনি না খেয়েও বিপদ ঠেকানো যাবে না। বাড়তে পারে ওজনও। এছাড়াও ক্যাফেইন শরীরের অ্যাড্রেনালিন নামক এক ধরনের হরমোনের মাত্রা বাড়ায়। যে কারণে শরীরের উত্তেজনার মাত্রাও বেশ বেড়ে যায়, যা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিজীবনে ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। শুধু তাই নয়, চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, দৈনিক পাঁচ কাপের বেশি কফি খেলে গর্ভধারণের ক্ষমতাও কমে যেতে পারে। এমনকী গর্ভধারেণের পরও কফি বাদ দিতে বলেন ডাক্তাররা। কারণ দৈনিক ২০০ মি.গ্রাম ক্যাফেইন শরীরে গেলে গর্ভের শিশুর ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি জন্মক্রটি হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।
তাই ‘আপ রুচি খানা’ প্রবাদটি যতই জনপ্রিয় হোক না কেন কফি প্রেমে মাপঝোক করে জড়ানোই ভালো!