হিডমার মৃত্যুতে ভারতে সশস্ত্র মাওবাদী আন্দোলনের ইতি?

Madvi Hidma: ২০১০ সালে দান্তেওয়াড়ায় যে হামলাতে ৭৬জন সিআরপিএফ সদস্য নিহত হন কিংবা ২০১৩ সালে ঝিরামঘাটিতে যে হামলায় ছত্তিশগড়ের প্রায় পুরো কংগ্রেস নেতৃত্বই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

ভারতে দীর্ঘদিন ধরে চলা মাওবাদী বা নকশাল সশস্ত্র আন্দোলন কি শেষের পথে? সাম্প্রতিক ঘটনার পর বিশেষজ্ঞদের বড় অংশ বলছেন, এই আন্দোলন ভেঙে পড়ার সবচেয়ে বড় দিক এখন স্পষ্ট। মাওবাদী কমান্ডার মাদভি হিডমার মৃত্যু, ক্রমবর্ধমান আত্মসমর্পণ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযান— সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এক নতুন মোড়ে দাঁড়িয়েছে। কেন এ কথা বলা হচ্ছে? কে এই মাদভি হিডমা?

সাল ২০২১। ছত্তিশগড়ে ভয়াবহ গেরিলা হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর ২২জন সদস্য নিহত হন। এর আগে এবং পরে বাস্তার জুড়ে মাওবাদীদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন আরও বহুজনই। সরকারি নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে বাস্তার এক আতঙ্কেরই নাম! এই অঞ্চল মাওবাদীদের গড়। বহু মাওবাদী নেতাকেই পুলিশ গ্রেফতার করেছে, নির্যাতন করেছে। তবু অধরা রয়ে গিয়েছিলেন একজন। এই ভয়াবহ আক্রমণগুলির নীল নকশা আঁকতেন তিনিই। মাওবাদী কমান্ডার হিডমা, মাদভি হিডমা। ২০১০ সালে দান্তেওয়াড়ায় যে হামলাতে ৭৬জন সিআরপিএফ সদস্য নিহত হন কিংবা ২০১৩ সালে ঝিরামঘাটিতে যে হামলায় ছত্তিশগড়ের প্রায় পুরো কংগ্রেস নেতৃত্বই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, সেই দুই হামলাতেও হিডমা নিজে আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। আদিবাসী কমান্ডার হিডমা গত দু'দশকে এই অঞ্চলে প্রায় তিরিশের কাছাকাছি বড় হামলায় যুক্ত ছিলেন। তবু তাঁর নাগাল মিলছিল না।

হিডমাকে ধরতে পারার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণাও হয়েছে। কখনও হিডমার মাথার দাম ৭ লক্ষ, কখনও ৪০ লক্ষ! তবু, হিডমাকে পাওয়া যায়নি। পিপলস লিবারেশেন গেরিলা আর্মির এক নম্বর ব্যাটেলিয়নের কমান্ডার মাদভি হিডমা বা 'হিডমালু'-কে ধরতে যে সমস্ত ফাঁদ পাতা হয়েছিল, দেখা গেছে তাতে আখেরে প্রাণ গিয়েছে ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর কর্মীদেরই। ভুল তথ্য ছড়িয়ে একাধিকবার নিরাপত্তা বাহিনীকে বিভ্রান্ত করে পালিয়েও গেছেন। অনেকে এমনও মনে করেন যে, হিডমা আসলে একটি 'মিথ'! এই নামে কেউ নেই, কেউ ছিলও না! তবে মাদভি হিডমাকে ঘিরে ছত্তিশগড়ে প্রচলিত এমন সব জনশ্রুতির সবটাই যে বিশ্বাসযোগ্য, তা নয়। তবে অবশেষে নিরাপত্তা বাহিনীর সাম্প্রতিক এক বড়সড় অভিযানে তাঁর মৃত্যু হয়। হিডমার পাশাপাশি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী রাজে (রাজাক্কা)ও এদিন নিহত হয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন 'স্ট্রাটেজিক ব্রেকডাউন' অর্থাৎ শীর্ষ নেতৃত্ব হারিয়ে নকশাল নেটওয়ার্কের সংগঠিত কাঠামো ভেঙে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন- অর্ধেক মাওনেতা নিকেশ! বাস্তারের মাওবাদী আন্দোলন শেষের মুখে?

পুলিশ ও নিরাপত্তারক্ষীবাহিনীর কাছে হিডমা ছিল নিষ্ঠুরতার অন্য নাম। জানা যায়, ১৮০ থেকে ২৫০জন বিশ্বাসী ও অনুগত নকশাল গেরিলার সুরক্ষা বলয় হিডমাকে সব সময় ঘিরে থাকত। এই দলের মধ্যে বহু মহিলাও আছেন। বলা হয়, হিডমা সাধারণত সব বড় হামলাই চালাতেন জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে। এই সময় গভীর জঙ্গলে গাছের পাতা ঝরে যায় এবং আড়াল থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর গতিবিধি নজর করা ও সেনাকর্মীদের নিশানা করা অনেক সহজ হয়।

ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ সুকমা জেলার পুর্ভাতি গ্রামের আদিবাসী সন্তান মাদভি হিডমা আঠারো-উনিশ বছর বয়সেই মাওবাদীদের সঙ্গে জুড়ে যান। ২০০৪ চার সালে একটি বড় হামলায় নেতৃত্ব দিয়ে তিনি প্রথম নজরে আসেন।

কেন হিডমাকে ধরা কঠিন ছিল? হিডমা দেখতে কেমন, জানতই না ভারতের রক্ষীবাহিনীর নেতৃত্ব! তাঁদের কাছে হিডমার কোনো সাম্প্রতিক ছবিও নেই। কেবল স্থানীয় বাসিন্দা এবং হিডমার সঙ্গে কাজ করা ব্যক্তিদের স্মৃতি থেকে আঁকা স্কেচ থেকে হিডমালুর উচ্চতা এবং আকার সম্পর্কে অনুমান করা হত। AK-47 হাতে হিডমার একটি ছবি এবং একটি ক্লোজ শট রয়েছে ঠিকই, তবে সেটি হিডমার ছোটবেলার।

হিডমা ছিলেন রাভুলা শ্রীনিবাস ওরফে রামান্নার ঘনিষ্ঠ। এই শ্রীনিবাসের বিরুদ্ধে ১৯৮৯ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বাস্তারে ১৫০ জনেরও বেশি নিরাপত্তা কর্মীকে হত্যার অভিযোগ ছিল। ২০১৯ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। রামান্নার মৃত্যুর পর, হিডমাকে সিপিআই (মাওবাদী) সংগঠনের কার্যকলাপের, বিশেষ করে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়। দণ্ডকারণ্য স্পেশাল জোনাল কমিটির (ডিকেএসজেডসি) প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন হিডমা।

আরও পড়ুন- বিপ্লবী ছাত্র থেকে সশস্ত্র মাওবাদী কমান্ডো! কেন কেশব রাওয়ের মৃত্যু মাওবাদীদের জন্যে বড় ধাক্কা?

হিডমাকে গ্রেফতার করা আরও কঠিন হয়ে যেত তাঁর চারপাশে ৫ কিলোমিটার জুড়ে থাকা নিরাপত্তা বলয়ের জন্য। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে হিডমার নেটওয়ার্ক ছিল প্রবল শক্তিশালী। হিডমা ছিলেন এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা এবং জঙ্গল সম্পর্কে জানতেন। উপরন্তু বহু-স্তরীয় নিরাপত্তা বলয় ছিল তাঁর যার কমান্ডোরা সকলেই খুব সুপ্রশিক্ষিত এবং আধুনিক অস্ত্র, গ্রেনেড মজুত ছিল তাঁদের কাছে। সমস্ত গ্রামেই হিডমার বিশ্বস্ত মানুষ ছিলেন যাঁরা নিরাপত্তা বাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে তাঁর সহযোগীদের কাছে তথ্য পৌঁছে দিতেন। হিডমা নিজে সাধারণত গ্রামে আসতেন না। হিডমা জঙ্গল যুদ্ধে প্রশিক্ষিত ছিলেন। হিডমা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে তাঁর নাম সিপিআই (মাওবাদী) সাধারণ সম্পাদক বাসভরাজু এবং অন্যান্যদের মতো কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের থেকেও বেশিই শোনা যায়।

সুকমা, বিজাউর এবং দান্তেওয়াড়ার জঙ্গলের অনেক জায়গায় ফোন নেটওয়ার্কের অভাবকে হিডমা দুর্দান্তভাবে ব্যবহার করেন। একবার পুলিশ হিডমার কাছাকাছি আসতে পেরেছিল। ২০১৭ সালের জুন মাসে। ভেজ্জি এবং বুরকাপালে পরপর দু'টি বড় হামলায় ৩৮ জন জওয়ান নিহত হন। নিরাপত্তা বাহিনী তখন অপারেশন প্রহার নামে একটি বিশাল যৌথ অভিযান শুরু করে। তখন প্রায় ১৮জন মাওবাদী নিহত হন। হিডমা নাকি তখন গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন। তখন এমনটাও রটে যায় যে হিডমা মারা গিয়েছেন। সম্প্রতি সুকমাতে হিডমাকে ধরার জন্য আবারও মরিয়া হয়ে পড়ে নিরাপত্তাবাহিনী। সমস্ত বলয় দিয়েই হিডমাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা চলে।

গত কয়েক বছর ধরে ছত্তিশগড়, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রের মাওবাদী অঞ্চলে লাগাতার আত্মসমর্পণ বাড়ছে। সেনা, CRPF ও রাজ্য পুলিশ– তিন দফায় সমন্বিতভাবে অপারেশন চালাচ্ছে। ড্রোন নজরদারি, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং ঘনঘন কম্বিং অপারেশনের কারণে লাল এলাকা আর আগের মতো সুরক্ষিত নেই। শীর্ষ পর্যায়ের বহু নেতা ইতিমধ্যেই নিহত বা ধরা পড়েছেন। যারা আছে, তারা ছোট ছোট স্প্লিন্টার গ্রুপে ভাগ হয়ে কাজ করছেন। এই ভাঙন পুরো আন্দোলনকে দুর্বল করে দিয়েছে।

ওয়াকিবহাল মহলের মতে, কিষেণজির মৃত্যুর পর নকশাল দলে সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী মুখ হিসেবে উঠে এসেছিল মাদভি হিডমা। তাঁর মাথার দাম ঘোষণা করা হয়েছিল ৪৫ লক্ষ টাকা। সংগঠনের ভেতরেও তাকে বলা হত সবচেয়ে ‘অপারেশনাল’ নেতা। হি়ডমা নিজে জঙ্গলে থেকে বাহিনীকে পরিচালনা করতেন এবং বড় বড় হামলার নেতৃত্ব দিতেন। তার মৃত্যু তাই নকশাল বাহিনীর কৌশলগত শক্তিতে বড় ধাক্কা দিয়েছে বলে মনে করছে নিরাপত্তা প্রশাসন।

More Articles