জরায়ু বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছেন ভারতীয় মহিলাদের একাংশ, যে ভয়াবহ পরিণাম হতে পারে

সাম্প্রতিককালে জরায়ু বাদ দেওয়ার রীতি যেভাবে বাড়ছে, তা অত্যন্ত চিন্তার। তাঁদের শারিরীক ক্ষতিও হচ্ছে ব্যাপকভাবে। মহিলারা যত না বেশি স্বেচ্ছায় জরায়ু বাদ দিচ্ছেন, তার থেকেও বেশি তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন জরায়ু বাদ দিতে।

ভারতে বড় অংশের মহিলারা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জরায়ু বাদ দিচ্ছেন নিজেদের, যাঁদের অধিকাংশরই বয়স পনেরো থেকে উনপঞ্চাশের মধ্যে। জরায়ু বাদ দেওয়ার এই পদ্ধতিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে হিস্টেরেক্টোমি। জরায়ু বাদ দিতে চাওয়ার মূল কারণ, ঋতুস্রাব বন্ধ করতে চান তাঁরা। কারণ ঋতুস্রাবের সময় অনেক মহিলাই অসহ্য পেটের যন্ত্রণায় ভোগেন, একাধিক শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি শারীরিক দুর্বলতাও দেখা যায়, ফলে কাজের জায়গায় তাঁদের অসুবিধে হয়।

এই সমস্ত মহিলাদের অনেকেই দিনমজুর। কেউ বা কোনও মালিকের অধীনে চাষের জমিতে কাজ করে জীবিকানির্বাহ করেন। ভারী জিনিস বইতে হয় তাঁদের রোজই। ঋতুস্রাবের ওই দিনগুলোতেও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। সংসার টানতেই তাঁরা মূলত এই পথে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

দেখা যাচ্ছে, এই ধরনের ঘটনায় এগিয়ে রয়েছে মহারাষ্ট্র এবং রাজস্থান। মহারাষ্ট্রর বিড জেলায় বিপুল পরিমাণে আখের চাষ হয়। এই অঞ্চলে জলাভাবের কারণে চাষবাসের ক্ষতিও হয় যথেষ্ঠ। তার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের অভাবে এখানকার বেশিরভাগ মানুষকে চাষবাস করেই জীবিকানির্বাহ করতে হয়। তবে চাষের জমিগুলি ধনী মালিকদের কুক্ষিগত। মহিলাদের কাজে নেওয়ার আগে জমির মালিকরা নিশ্চিত হতে চান, সেই মহিলারা জরায়ু বাদ দিয়েছেন কি না। কারণ জমিতে কাজ করা খেটে খাওয়া মহিলাদের ছুটি তাঁরা দেবেন না, এমনকী ঋতুস্রাবের সময়েও না।

আরও পড়ুন: যৌনাঙ্গে নৃশংস কোপ, তবু যেভাবে বেঁচে থাকে নারীর কামনা

ঋতুস্রাবের কয়েক দিন তাঁরা ছুটি পান না। অনেক মহিলাই অতিরিক্ত রক্তপাতের সম্মুখীন হন ঋতুস্রাবের সময়। সঙ্গী হয় অসহ্য যন্ত্রণা, গা-হাতে-পায়ে ব্যথা, বমি-বমি ভাব। পেটে অসহ্য যন্ত্রণা, শারীরিক কষ্ট নিয়েই তাঁরা কাজ করতে বাধ্য হন। এদিকে শৌচালয় ব্যবহার করতেও মহিলাদের অনেকটা দূরে হেঁটে যেতে হয়, ফিরতে সামান্য দেরি হলেও মালিকরা বেতন কাটতে পিছপা হন না। তাই যদি জমিতে কাজ করতেই হয়, আগে বাদ দিতে হবে জরায়ু।

চাষের কাজে সেই মহিলাদেরই নেওয়া হয়, যারা অস্ত্রোপচার করে জরায়ু বাদ দিয়েছেন। আর দরিদ্র মহিলারাও কর্মসংস্থানের অভাবে বাধ্য হন সেইসব মালিকদের অধীনে কাজ করতে। আর্থসামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা মহিলারা তাই নিজেদের কর্মক্ষমতা এবং আয় বাড়াতে মনে করেন, জরায়ু কেটে বাদ দেওয়াই একমাত্র সমাধান। এই মহিলাদের মধ্যে অশিক্ষার হার বেশি, স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা বোঝেন না জরায়ু বাদ দেওয়ার দীর্ঘস্থায়ী কুফল কী কী হতে পারে।

জরায়ু বাদ দেওয়ার পর প্রাথমিক ফল হিসেবে ঋতুস্রাব বন্ধ হয় এবং একাধিক হরমোনের পরিমাণ ও কাজের মধ্যে অসামঞ্জস্য দেখা যায়। পাশাপাশি ত্বরান্বিত হয় বার্ধক্য। কিন্তু তার থেকেও বেশি ক্ষতি হয়, যখন খুব অল্প বয়সেই ডায়াবেটিস মেলিটাস, অস্টিওপোরোসিস, অস্টিওআর্থ্রাইটিস, হৃদরোগের মতো একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাঁদের।

অস্টিওপোরোসিস মূলত দেখা যায় মেনোপজে়র পর, অর্থাৎ, যখন ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায় একটা বয়সের পর। হাড়ে ক্যালশিয়ামের ঘনত্ব কমে, হাড়ের ক্ষয় শুরু হয়। ফলে ছিদ্র তৈরি হয় হাড়ে, একেই বলে অস্টিওপোরোসিস। এর ফলে খুব সহজেই হাড় ভেঙে যেতে পারে, হাড়ে ফাটল ধরতে পারে। পাশাপাশি হাড়ে ক্যালশিয়ামের ঘনত্ব কমায় হাড়ে ব্যথা শুরু হয়, যাকে বলে অস্টিওআর্থ্রাইটিস। এছাড়াও দু'টি হাড়ের সংযোগস্থল ক্ষয়প্রাপ্ত হতে শুরু করে।

এমনিতেই ঋতুস্রাব পাকাপাকিভাবে বন্ধ হওয়ার পর অস্টিওপোরোসিস এবং অস্টিওআর্থ্রাইটিসের মতো অসুখের কবলে পড়েন অনেক মহিলাই। ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে এই রোগে জর্জরিত হওয়ার প্রবণতা বেশি। কারণ গ্রাম ও শহর নির্বিশেষে সব বয়সের ভারতীয় মহিলাদের শরীরে ভিটামিন ডি ও ক্যালশিয়ামের অভাব চোখে পড়ে।

২০২১ সালে ফ্রন্টিয়ার্স ইন এন্ডোক্রাইনোলজি জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পঁচাশি শতাংশ ভারতীয়র মধ্যে ক্যালশিয়াম ও ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় এই বছরেই প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাহাত্তর শতাংশ ভারতীয় মহিলার শরীরে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি রয়েছে। এই রকম অবস্থায় জরায়ু বাদ দিলে অসুস্থতার হার আরও বাড়বে মহিলাদের মধ্যে, সম্মুখীন হতে হবে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার।

জরায়ু বাদ দিলে দেখা যায় নানা রকম মানসিক অসুস্থতা। যার মধ্যে অন্যতম অবসাদ বা ডিপ্রেশন, দুশ্চিন্তা এবং রাগের প্রবণতা। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মানসিক অবসাদে ভোগার প্রবণতা অনেক বেশি। যার মূল কারণ হরমোন এবং বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটারের আদান-প্রদান। কিন্তু তার পাশাপাশি আর্থসামাজিক, পারিবারিক, এমনকী, সাংস্কৃতিক কারণও ভূমিকা পালন করে।

প্রত্যন্ত গ্রামে আর্থসামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মহিলারা যখন মালিকদের হাতে অত্যাচারিত হন, উদয়াস্ত খেটেও যখন দিনে কোনওমতে দুশো টাকা রোজগার করেন, পাশাপাশি সংসারের কাজও করতে বাধ্য হন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের মধ্যে মানসিক অবসাদের শিকার হওয়ার প্রবণতা বেশি হবে। মানসিক অবসাদ, হতাশা, দুশ্চিন্তাকে 'বড়লোকি অসুখ' বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু বিভিন্ন কারণেই এই সমস্যাগুলিতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ জর্জরিত হয়। সচেতনতার অভাবে সমাজের তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের মধ্যে অধিকাংশরই মানসিক রোগ সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। সেখানে প্রত্যন্ত গ্রামের গরিব মহিলাদের মধ্যে সেই বিষয়ে শিক্ষা ও সচেতনতা থাকবে, তা আশা করা অন্যায়।

সমস্যা কেবল এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। জরায়ু বাদ দেওয়ার ফলে যখন ইস্ট্রোজেন হরমোনের ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটে তখন ঘুমের ব্যঘাত ঘটা, অতিরিক্ত গরম লাগা, ঘাম হওয়া, মূত্রত্যাগে সমস্যাও দেখা যায়। এছাড়াও বিঘ্নিত হয় স্বাভাবিক যৌনজীবন। যৌন ইচ্ছা কমে যাওয়ার পাশাপাশি, যৌন মিলনের সময় অকথ্য পেটে ব্যথার শিকার হন মহিলারা।

জরায়ু বাদ দেওয়ার যে প্রচলন নজরে পড়ছে বিগত কয়েক বছরে, সেখানে কিন্তু ইন্ধন জুগিয়েছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ক্রম-উত্থান। সরকারি হাসপাতালে খুব সহজে জরায়ু বাদ দেওয়ার অস্ত্রোপচার করা যায় না, বেসরকারি হাসপাতালে সে সমস্যা একেবারেই নেই। যে-সমস্ত মহিলারা ঋতুস্রাবের সময় অতিরিক্ত যন্ত্রণা বা অতিরিক্ত রক্তপাতের সম্মুখীন হন, বেসরকারি হাসপাতালে গেলে তাঁদের নানা অজুহাত দেখিয়ে বোঝানো হয়, জরায়ু কেটে দেওয়াই একমাত্র সমাধান। বেসরকারি হাসপাতালে এই অস্ত্রোপচার করাতে গেলে খরচ পড়ে কমপক্ষে তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশহাজার। ফলে অর্থের লোভেই সেখানকার ডাক্তাররা গ্রামের মহিলাদের ক্যান্সার ও অন্যান্য জটিল রোগের ভয় দেখিয়ে জরায়ু বাদ দিতে বাধ্য করেন।

সাম্প্রতিককালে জরায়ু বাদ দেওয়ার রীতি যেভাবে বাড়ছে, তা অত্যন্ত চিন্তার। তাঁদের শারিরীক ক্ষতিও হচ্ছে ব্যাপকভাবে। মহিলারা যত না বেশি স্বেচ্ছায় জরায়ু বাদ দিচ্ছেন, তার থেকেও বেশি তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন জরায়ু বাদ দিতে। সমাজকর্মীদের মতে, এটি একপ্রকার দাসত্ব। এতে মহিলারা নিজের অজান্তেই শোষণ এবং বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।

 

More Articles