শরীরে সমস্যা থাকেই, তবু লড়ে যায় নারী
সপ্তাহের প্রথমদিন | অফিস কামাই করার কোনও উপায় নেই | কামাই করলে বসের চিমটি কাটা মন্তব্য তো আছেই, তার ওপর কাস্টমাররা আছে | ফোনে ফোনে উত্যক্ত করবে | অনেকগুলো Car Insuarance Premium -এর চেক কালেকশন হয়ে গেছে কী না! ইন্সিওরেন্স পলিসিগুলো চটপট রিনিউ করতে হবে | এই সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই সেগুলো Expire করে যাবে | পলিসি ডকুমেন্টগুলো রেডি করতে হবে | তাই নিমরাজি হয়েই শ্যামবাজার স্ট্রিটের ভাড়া বাড়ি থেকে হাঁটুর কাছাকাছি জমা জল ভাঙতে ভাঙতে সকাল ৯:৩০ নাগাদ পারমিতা এসে উপস্থিত হল শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে | ফোনে কথাবার্তা বলা ছিল, তাই তরুণও বাসস্টপে এসে হাজির | তরুণ বয়সে পারমিতার থেকে বছর তিনেকের ছোট | মহম্মদ আলি পার্কার কাছে একটা অটোমোবাইল কোম্পানিতে দুজনে চাকরি করে| থার্টি এ রুটের একটা বাস ধরে মহম্মদ আলি পার্কের স্টপেজে নামল| রাতভর নিম্নচাপের বৃষ্টিতে সেখানে তখন হাঁটু-ডোবা জল| বাস থেকে নামামাত্রই দুজনের প্যান্ট গেল ভিজে| পারমিতার তখন করুণ অবস্থা| মাথার ওপর ধরা ছাতা সামলাবে না কাঁধের ব্যাগ আর পরনের প্যান্ট ও কুর্তা! তরুনের অবস্থা তথৈবচ! শরীর মনের অস্বস্তি চাপতে না পেরে পারমিতা বলে উঠল- "পোড়া কপাল আর কী! একে একবিংশ শতাব্দী, তায় একবিংশ বর্ষা | গ্রামগঞ্জের কথা দূরে থাক, খাস কলকাতা শহরে বর্ষার দিনে মেয়েদের নিদারুন অবস্থা দেখ! কী প্রগতিটাই না হয়েছে! মেয়েদের দুর্ভোগ কোনদিন যাবে?" শুনে তরুণ বলল - "তুমি শুধু তোমাদের মেয়েদের কোথায় ভাবলে? আমরা ছেলেরা কী কষ্টভোগ করছি না?" তরুণকে পারমিতা ভাইয়ের মতো স্নেহ করে| ওকে কী করে সব কথা খুলে বলে? দুজনে ফুটপাথে উঠল, সেখানে জল অনেকটা কম| অফিসের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পারমিতা প্রশ্ন করল তরুণকে- "তোর একে চন্দ্র মনে আছে? প্রশ্ন শুনে তরুণ চমকে গেল| খানিক হেসে ফেলে বলল- "কেন মনে থাকবে না? একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ, তিনি নেত্র, চারে বেদ, পাঁচে পঞ্চবাণ, ছয়ে ঋতু... তরুণকে থামিয়ে দেয় পারমিতা- " থাম, থাম, ছয়ে ঋতু আর সকলের জন্য| মেয়েদের জন্য একটা ঋতু বেশি। পারমিতার ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে তরুনের চোখ মুখ রক্তিম হয়ে উঠল, গম্ভীর হয়ে গেল| তরুণের ভাব দেখে পারমিতার মনে হল, তার এতটা প্রকাশ করা ঠিক হল না| কিন্তু, সে যে আর ধৈর্য্য রাখতে পারছে না! অফিসে ঢুকেই তাকে ওয়াশরুমে যেতে হবে, চেঞ্জ করতে হবে...
পারমিতা ব্যাগে করে আর একটা সেট পোশাক নিয়ে এসেছিল| না হলে, ভেজা পোশাক পরে অফিসে কাজ করলে নির্ঘাত জ্বর আসত| জ্বর এলে তো আর এক কেলেঙ্কারি! করোনা অতিমারির দাপট কমেছে, কিন্তু যায়নি| যে কোনও সময় তেড়েফুঁড়ে আবার আক্রমণ করতে পারে| তাই সাবধানের মার নেই| হাতে বেশ করে স্যানিটাইজার মাখতে মাখতে পারমিতা অফিসে নিজের Cubical- এ এসে বসল| সামনে জানলার পর্দাটা সরিয়ে দেখল- আকাশ বেশ কালো করে আছে, আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে| দেখে পারমিতার কান্না পেল| রবিবার প্রচুর কাচাকাচি করে বারান্দায় শুকোতে দিয়েছিল| এই রকম চললে একটাও শুকোবে? ছোট মেয়েটাকে বাড়ি ফিরে কী পরতে দেবে? ওর আবার একটুতেই ঠান্ডা লেগে যায়| মানসের কাল সকাল আটটার ফ্লাইটে বেঙ্গালুরু যাওয়ার কথা| সে-ই বা কী জামাকাপড় সঙ্গে নিয়ে যাবে?
এতশত ভাবতে ভাবতে পারমিতার মাথা ধরে আসছিল| ওর মনে হল- এসব সমস্যা তো জীবনভর থাকবে আমাদের| তাই নিয়ে ভেবে ভেবে অফিসের কাজের অবহেলা করা ঠিক নয়| অফিস তো অন্ন যোগাচ্ছে| তাই কাজে মন দেওয়া যাক| কম্পিউটার চালু করল| ব্যাগের ভেতর থেকে মাস্কটা বার করে নাকের ওপর চাপানো মাত্রই দেখল সেটা ভিজে| আসলে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসার সময় পাশ দিয়ে যাওয়া এক চলন্ত গাড়ির চাকার টানে জল ছিটকে এসেছিল মাস্কটার ওপর| নিজে হাতে ব্যাগে সব কিছু গোছানোর সময় একটা বাড়তি মাস্ক তো নেওয়া হয়নি আসার সময়| আর কে-ই বা গুছিয়ে দেবে?
এখন কী করা যায়? ভিজে মাস্ক পরে থাকা তো নিয়মবিরুদ্ধ| এখন কাকে পাঠানো যায় মাস্ক কিনে আনতে? এ বস্তু তো কারও কাছে চাওয়া যায় না ! আবার জল ভেঙে বেরোতে হবে? না সেটা একেবারেই অসম্ভব| অগত্যা স্বাস্থ্য-বিধির বিরুদ্ধে গিয়ে নোংরা জলের ছিটেলাগা ভেজা মাস্ক পরেই কাজ করতে হবে| বিনা মাস্ক-এ কাজ করা অফিস অ্যালাউ করবে না| পরিস্থিতির চাপে কত কিছুই না মেনে নিতে হয়!
অস্বস্তি চেপেই পারমিতা একটানা ঘণ্টা চারেক কাজ করল| দুটোর সময় টিফিন টাইম| দীপাদি ওঁর টিফিন বাক্স নিয়ে পারমিতার Cubical -এ এসে আরেকটা চেয়ার টেনে একটু তফাতে বসলেন| দীপাদির মেয়ের এখন Work From Home চলছে মেয়ের কথায় দীপাদি বললেন, এই প্রচণ্ড বর্ষার ভরপুর জলীয় বাস্প Internet Connection কীভাবে Disturb করছে| এত বেশি Interuption হচ্ছে Network -এ যে, কাজকর্ম করা দায়| একেবারে মাথায় হাত অবস্থা| "এমনিতেই তো কাজের সময়ের কোনও ছিরিছাঁদ নেই| রাত্রির দুটো-তিনটে পর্যন্ত জেগে বসে থাকা| তার ওপর যদি Network ঠিকমতো না পায় কী করে চাকরি বজায় রাখবে মেয়েটা? শরীরের তো বারোটা বাজছেই, তার সঙ্গে সংসারেরও| আমার মেয়ের কোলে একটা তিন বছরের বাচ্চা| কেমন করে তার যত্ন করবে, কেমন করেই বা আমার জামাইয়ের? আর ভেবে পাই না বাবা! মেয়েদের শতেক জ্বালা| জগ পাল্টালে কী হবে? মেয়েদের সমস্যা যেন নিত্যনতুন চেহারা নিয়ে আসছে"- বললেন দীপাদি পারমিতাকে| বর্ষার ধূসর মেঘ যেন ওঁর মুখের ওপর ভর করেছে |
সময় যায়, শরীরের সমস্যার শেষ হয় না। তা কেবল বাড়তেই থাকে। তার মধ্যেই লড়ে যায় পারমিতা বা দীপাদির মতো নারীরা।