সংসার, মূল্যবোধ আর সহজ ভালবাসার গল্প বলে গেছেন তরুণ মজুমদার

সেসব ছবি হয়তো কখনও কান, ভেনিস-বার্লিনের লাল গালিচায় হাঁটবেন না, হাঁটবে উত্তর কলকাতার এঁদো গলি দিয়ে, হাঁটবে মেঠো পথজোড়া লাল মাটির বুকে, হাঁটবে মানুষের মনে কেদার, আলো, সরস্বতী হয়ে, হাঁটবে টালিগঞ্জের সিনেমাপাড়া দিয়ে।

পর্দায় যাঁকে দেখা যায় না, তাঁর জন্য আবেগ সাধারণত আমাদের একটু কমই হয়। যিনি তাঁর নিজের রঙে চরিত্রদের সৃষ্টি করেন, তাঁর আত্মজ সেই রংবাহারি চরিত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে আমাদের হৃদয় যতটা উছলিয়ে ওঠে, ততটা কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ক্ষেত্রে ওঠে না। আমাদের এই কল্পনাশ্রিত চরিত্রদের যাপনকে কেন্দ্র করে আমাদের মননে যে পৃথিবীর অস্তিত্ব, তার কখনও মৃত্যু হয় না। কেবল আবছা হতে থাকে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে।

মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহীদের কাছে 'তরুণ মজুমদার' নামটা যত না পরিচিত, তার চেয়ে বেশি পরিচিত 'ফুলেশ্বরী', 'সংসার সীমান্তে', 'দাদার কীর্তি', 'ভালোবাসা ভালোবাসা', 'কুহেলী', 'বালিকা বধূ', 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ', 'আলো', 'চাঁদের বাড়ি' ইত্যাদি সিনেমার নামগুলো এবং এগুলির সঙ্গে জুড়ে থাকা প্রতিটা চরিত্র। এই মুখগুলো দেখতে দেখতে আমরা হেসেছি, আমরা কেঁদেছি, আমরা মিশিয়ে দিয়েছি আমাদের ব্যক্তিগত যন্ত্রণা আর ভালবাসার দিন একসঙ্গে, একই ছবি বারবার দেখার পর।

alo poster

মনে আছে, ছোটবেলায় মা দেখতে নিয়ে গিয়েছিল 'আলো'। সিনেমা শেষ হওয়ার পর দুই মহিলা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদছিলেন। হল থেকে বেরতে পারছিলেন না কোনওভাবে। মা বাড়িতে 'দাদার কীর্তি' দেখার পর প্রতিবার নিয়ম করে তাপস পালের জন্য কাঁদে। মহুয়ার জন্য কাঁদে, বলে, "মেয়েটা বেঁচে থাকলে আর কেউ জায়গা পেত না!" কতজনের যে দেখা হরর ছবি 'কুহেলী'। রাতবিরেতে নুপূরের আওয়াজ আর 'আসছে, সে আসছে' গানটি শুনলেই অনেকেরই গা ছমছম করত। ছোটবেলায় প্রতি রবিবার ঘুরিয়েফিরিয়ে হয় 'ফুলেশ্বরী' না হয় 'চাওয়া পাওয়া' দেওয়া হতো। তখনও জানতাম না, সিনেমায় পরিচালকের ভূমিকা কী! তখনও জানতাম না, ফুলেশ্বরী ছবির 'শুনো শুনো মহাশয়' গানটা নাকি সিনেমাবোদ্ধাদের কাছেও প্রভূত প্রশংসিত হয় অহরহ! তখনও জানতাম না, কতখানি ধুলোবালি-মাখা মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়ালে লেখা যায় এমন লাইন,

ফেলিনি-গোদার-ত্রুফো-সত্যজিৎ রায়
ইহাদের সকলেরে রাখি গো মাথায়

আরও পড়ুন: যুগের সমাপ্তি: প্রয়াত তরুণ মজুমদার, প্রচারবিমুখ পরিচালক ছিলেন বাংলা সিনেমার অভিভাবক

একটা বিশ্বাস, অমোঘ সংসারী একটা বিশ্বাসে ভর দিয়ে শিরদাঁড়া শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বাঙালির নাম তরুণ মজুমদার। সৃজনশীল ব্যক্তি হয়ে ওঠার জন্য যে তথাকথিত বাহ্যিক উপাদানগুলো প্রয়োজন হয়, তার দরকার ছিল না! জীবনে ধুতি-পাঞ্জাবি ছাড়া কিছু পরেননি, আজীবন সবক'টা ছবির শুটিংয়ে একইভাবে জারি রেখে গিয়েছেন শৃঙ্খলাবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, সম্ভ্রম, সহনশীলতা আর সততার মতো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া আচরণগুলিকে।

তরুণ মজুমদার ওরফে তনুবাবু জানতেন আদর্শ বজায় রাখার মানে। ঘোর টালমাটালে এই সহজ সুরে পাল্টি খাওয়ার চলতি হাওয়াকে পাত্তা না দিয়ে কীভাবে অবিচল থাকতে হয় আজীবন যাপন করা রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে, তার অন্তিমতম উদাহরণগুলির মধ্যে অন্যতম তরুণ মজুমদার। আমরা তাঁর মৃত্যুতে উচ্চকিত নই, কারণ তিনি আমাদের পরিবারের মানুষের মতো। যিনি তাঁর রেখে যাওয়া প্রতিদিনের অবদান নিয়ে এতটুকু আত্ম-নিমজ্জিত নন, কখনও কোনওভাবেই চেষ্টা করেননি নিজেকে প্রচার করার। বরং চেষ্টা করে গিয়েছেন কর্মজীবনের শেষ অধ্যায় অবধি নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে খুঁজে খুঁজে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসতে। তৈরি করতে তাঁদের অভিনয়-জীবনের এক-একটি ল্যান্ডমার্ক চরিত্র।

আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রকার বলতে বাঙালি সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল সৃষ্ট ত্রিকোণমিতিকে বোঝায়, বিখ্যাত দেশি-বিদেশি ছবির তালিকাকে সামনে রেখে। তনুবাবু অনেকের কাছেই নিতান্ত মেলোড্রামাটিক এক পরিচালক ছাড়া কিছুই নন, যিনি তাঁর প্রতিটা ছবিতেই প্রায় চেষ্টা করে গেলেন পরিবারের অন্ধকারে লুকিয়ে রাখা যাবতীয় জটিলতাকে সহজ করে দেখাতে।

কিন্তু সহজ জিনিস আমাদের বেশিদিন ভালো লাগে না। যে ছবিতে সংলাপের মারপ্যাঁচ নেই, নেই শেষ দশ মিনিটে ধামাকাদার টুইস্ট, নেই আলাদা হয়ে ভালো থাকার অজুহাত, যেখানে খারাপও ভালো, চোরও সৎ, যেখানে শত্রুরাও ক্ষমা চায় ছবির শেষে, যেখানে ভালবাসা আজও হাত ছুঁতে দ্বিধা করে বারবার, সেসব ছবি হয়তো কখনও কান, ভেনিস-বার্লিনের লাল গালিচায় হাঁটবেন না, হাঁটবে উত্তর কলকাতার এঁদো গলি দিয়ে, হাঁটবে মেঠো পথজোড়া লাল মাটির বুকে, হাঁটবে মানুষের মনে কেদার, আলো, সরস্বতী হয়ে, হাঁটবে টালিগঞ্জের সিনেমাপাড়া দিয়ে।

এমন এক বটবৃক্ষের মূল্যায়ন কেবল জাতীয় পুরস্কার কিংবা ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডের সংখ্যা দিয়ে হয় না, হয় না কোনও প্রথিতযশা চিত্র সমালোচকের প্রতিবেদন দিয়েও, হয় কেবল আমার-আপনার পরিবারের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা সবক'টা নিষ্পাপ চোখের কান্না দিয়ে, যে কান্নার অনুরণন শুনলে পৃথিবীতে নতুন করে আবার একটা 'ভালবাসার বাড়ি' বানাতে ইচ্ছে করে...

 

More Articles