দূষণের সেকাল-একাল, নগরজীবনের আপাত সমাধান ব্যাটারিযুক্ত গাড়ি

সুসেন: আধুনিক বিশ্বের সব থেকে বড় সমস্যা নিঃসন্দেহে দূষণ। জল থেকে বায়ু— সব ক্ষেত্রেই দূষণের প্রভাব থেকে রেহাই নেই। কিন্তু দুষণ কি শুধু আজকের সমস্যা? না কী এর শুরু বহু যুগ আ্রগে? উত্তর খুঁজতে গিয়ে স্তম্ভিত বিজ্ঞানীরা। তাঁরা দেখেছেন, মানুষের পরিবেশ দূষণের অভ্যাস অতি প্রাচীন। প্রায় ৮ হাজার বছর আগেও যে মানুষ পরিবেশ দূষিত করত, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক মিচিগানে ধাতব দূষণের সন্ধান পেয়েছেন, যা কিনা প্রায় ৮ হাজার বছরের প্রাচীন। মূলত খোলা মুখ খনি থেকে ওই ধাতব দূষণের সূত্রপাত। দ্য নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণাধর্মী প্রতিবেদন অনুযায়ী, আঠেরোশো শতকেও এই অঞ্চলে খোঁজখবর চালিয়ে প্রাগৈতিহাসিক দূষণের সন্ধান পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা দেখেছেন খনি থেকে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তামা উত্তোলনের সময় দূষণের শুরু।

একইরকম দূষণের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে দক্ষিণ আমেরিকায় সতেরশো শতকে।

সতেরশো শতাব্দীতে স্প্যানিশরা দক্ষিণ আমেরিকা জয়ের পর ইনকাদের খনি দখল করে নেয়। আর মুনাফা দেশে পাঠানোর তাগিদে শুরু করে খনি থেকে উত্তোলন। যার ফলে গোটা আন্দিজের উপর যেন সীসার গুঁড়োর মেঘের আস্তরণ তৈরি হয়ে যায়। বিজয়ীদের দেশে পাঠানো বিপুল পরিমাণ রুপো স্প্যানিশদের হয়তো ধনী করে তোলে। কিন্তু তাদের ছড়িয়ে দেওয়া বিশ্বের প্রথম শিল্প- যুক্ত বিষাক্ত ধাতুর অবশেষ গোটা আন্দিজ অঞ্চলকেই আদিমতম বায়ু দূষণের অভিজ্ঞতা দিল। জানাচ্ছেন বিশিষ্ট গবেষক পাওলো গাব্রিয়েলি। টাইম মেসিনে চড়ে সেই সময়টাই পৌঁছানো গেলে আমাদের পক্ষে সেই মুহূর্তের পরিস্থিতিটা পুনর্বিবেচনা করা সম্ভব হত। যখন থেকে মানুষ সত্যিই পরিবেশের পরিবর্তন করতে শুরু করে এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধে তাঁর জঘন্যতম অপরাধের সুচনা ঘটায়।

ওহিয়ো স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক গাব্রিয়েলি জানিয়েছেন, যদিও শিল্পযুগে দূষণ সম্পর্কে বিশ্বজুড়ে প্রচুর তথ্য আছে, কিন্তু প্রাক-শিল্প যুগে দূষণের বিস্তারিত তথ্য বড় একটা পাওয়া যায় না। এজন্য ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামে প্রকাশিত তাঁর ওই গবেষণামূলক প্রতিবেদনে এই পরিবেশবিদের পরামর্শ, আমাদের পৃথিবীতে এমন বিশেষ জায়গাগুলির দিকে নজর দিতে হবে যেখানে বায়ুমণ্ডলীয় রাসায়নিকগুলি সময়ের ধারা মেনে সংরক্ষিত থাকত, যেমন হ্রদের একেবারে নীচের স্তর বা বরফের গায়ে জমে থাকা তুষারের অস্তিত্ব। উদাহরণ হিসাবে তিনি জানিয়েছেন, পেরুর কোয়েলকায়া আইস ক্যাপের একটি বরফাস্তীর্ণ অংশে দক্ষিণ আমেরিকার বায়ুমণ্ডলের মানুষের তৈরি দূষণের প্রমাণ পাওয়া গেছিল, যা শিল্প বিপ্লবের প্রায় ২৪০ বছর আগের ঘটনা।

ফিরে আসা যাক আজকে দিনে। ভুবনডাঙার বেশির ভাগ মানুষ এখন এমন জায়গায় বাস করছেন, যেখানে বায়ুদূষণের মাত্রা সহনসীমার অনেক উপরে। বিশেষ করে শহরে। অন্যান্য ধরণের দূষণের পাশাপাশি নগরজীবনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলছে যানবাহনজনিত বায়ুদূষণ।
শহরাঞ্চলে এই যানবাহনজনিত বায়ুদূষণ কমানোর উপায় — ১) গণপরিবহণ ব্যবস্থার সুযোগ বাড়ানো; ২) ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমানো; আর ৩) পেট্রল ও ডিজ়েল গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে ব্যাটারিচালিত বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বহুগুণ বাড়ানো। বিশিষ্ট পালমনোলজিস্ট পার্থসারথি ভট্টাচার্য মনে করেন এক্ষেত্রে শেষের বিষয়টি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে সড়ক পরিবহণই মূলত যাতায়াতের মাধ্যম। এর মধ্যে বড় গাড়ির পাশাপাশি ব্যক্তিগত গাড়ি, ট্যাক্সিতে যাতায়াত করা মানুষের সংখ্যাও যথেষ্ট বাড়ছে। কিন্তু বায়ুদূষণকে নিয়ন্ত্রণে আনতে গেলে পেট্রল বা ডিজ়েলচালিত গাড়ির ব্যবহার অবিলম্বে কমানো দরকার।

ইন্ডিয়ান ইনস্টটিউট অফ কেমিক্যাল বায়োলজির গবেষক সোহম সেনগুপ্ত জানাচ্ছেন, পেট্রল বা ডিজ়েল গাড়ি চলে ইন্টারনাল কমবাসচন ইঞ্জিনে। তেল বা গ্যাসের দহনে তৈরি হওয়া এনার্জির সাহায্যে গাড়িটি চলে। কিন্তু তার ফলে যে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয়, তা ধোঁয়ার আকারে বেরিয়ে বাতাসে মেশে। এতে কঠিন ভাসমান কণা, তরল ড্রপলেট ও কিছু দূষিত গ্যাস থাকে, যেগুলো বায়ুদূষণ ঘটায়। অন্য দিকে, বৈদ্যুতিক গাড়ি চলে মোটরের সাহায্যে, এই মোটর বিদ্যুৎশক্তি পায় রিচার্জেবল ব্যাটারি থেকে। তাই বৈদ্যুতিক গাড়িতে বায়ুদূষণের সম্ভাবনা নেই।

দেশেএখন বাণিজ্যিক ভাবে তিন রকমের বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি হচ্ছে— চার চাকার গাড়ি, যেমন বাস; তিন চাকার অটো বা ই-রিকশা; এবং দু’চাকা স্কুটার। আর কয়েকটি শহরের মতো কলকাতা শহরেও বৈদ্যুতিক বাস পরীক্ষামূলক ভাবে চলছে। সামনে থেকে এই বাস দেখলে সাধারণ বাসের সঙ্গে কোনও তফাত নেই। কিন্তু পিছন থেকে দেখলে অবাক হতে হয়।। বাস চলছে, অথচ কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে না। শহরের মানুষের কাছে বিলক্ষণ এটা নতুন অভিজ্ঞতা।

ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনের সল্ট লেক ডিপোর আধিকারিক ভাস্কর সরকারের সংযোজন, কলকাতায় প্রতি দিন যে পরিমাণ ডিজ়েল বাস রাস্তায় নামে— বৈদ্যুতিক বাসের সংখ্যা সেই তুলনায় কম হলেও নিঃসন্দেহে শুভ সূচনা। আর বৈদ্যুতিক বাসের দাম সাধারণ বাসের তুলনায় কিছুটা বেশি। তবে এই বাসের জ্বালানি বাঁচানোর ক্ষমতা ডিজ়েল বাসের তুলনায় আবার অনেক বেশি, এবং যে হেতু এক ইউনিট বিদ্যুতের দাম এক লিটার ডিজ়েলে চেয়ে অনেকটাই কম, তাই বৈদ্যুতিক বাস চালানোর দৈনন্দিন খরচও ডিজ়েল বাসের তুলনায় কম। বিশ্ব ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী, কলকাতায় বৈদ্যুতিক বাস চালানোর খরচ কিলোমিটার প্রতি যতটা সেখানে ডিজ়েল বাস চালানোর খরচ কিলোমিটারে আড়াই গুন বেশি।

তিনচাকা বৈদ্যুতিক গাড়ির কথা বললে প্রথমেই টোটো-র কথা মনে হয়। আমাদের দেশে ই-রিকশা বলে যে গাড়ি এখন চলছে, সেগুলি ছোট শহরে যাত্রী পরিবহণে খুবই উপযোগী এবং বায়ুদূষণ মুক্ত। কিন্তু কলকাতার মতো বড় শহরে মূল রাস্তায় চলার উপযোগী নয়। মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ডঃ সুমন মিত্র। তাঁর কথায়, মূল সমস্যা হল, এই গাড়ির সর্বাধিক গতিবেগ ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটারের বেশি নয়। আর অভিজ্ঞতা বলছে, কোনও ব্যস্ত রাস্তায় অন্যান্য গাড়ির সঙ্গে যদি একটি কম গতিবেগসম্পন্ন গাড়িকে চলতে দেওয়া হয়, তা হলে রাস্তায় যান চলাচলের গতি সামগ্রিক ভাবেই কমে যায়। তাই তুলনায় কম গতির টোটোকে পেট্রল বা ডিজ়েলচালিত বাস, ট্যাক্সি বা প্রাইভেট গাড়ির সঙ্গে একই রাস্তায় এক সঙ্গে চলতে দিলে পেট্রল বা ডিজ়েল গাড়ি থেকে বায়ুদূষণের হার এখনকার তুলনায় আরও বাড়বে। তা ছাড়া, এই রিকশাগুলি ততটা মজবুত নয়। সমাধান কি? ডঃ মিত্র-র কথায়, কলকাতার মতো জনবহুল শহরে যেখানে অটো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন মাধ্যম। সেখানে বায়ুদূষণ কমাতে গেলে চলতি এলপিজি অটো বাতিল করে বৈদ্যুতিক অটো আনা প্রয়োজন। এজন্য আরও বেশি গতিসম্পন্ন ব্যাটারিচালিত অটোর প্রচলন জরুরি, যার সর্বাধিক গতিবেগ ঘণ্টায় অন্তত ৫০ কিলোমিটার হলে ভাল হয়।

তথ্যসূত্র- The Nature পত্রিকা, প্রতিবেদন- World Economic Forum, বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য প্রতিবেদকের নেওয়া।

More Articles