পৃথিবীর সবচেয়ে জন বিরল শহর মনওয়ি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কা প্রদেশের প্রত্যন্ত উত্তরের দক্ষিণ ডাকোটা সীমানা থেকে পাঁচ মাইল দূরে, একটি ছোট্ট শহর মনওয়ি। এখানে রয়েছে একটি পরিত্যক্ত চার্চ, যার ভেতরে এখন কেবলমাত্র টায়ারে ভরা, শহরে একটি রেস্তোরাঁ, একটি লাইব্রেরী এবং একটি থাকবার বাড়ি ছাড়া প্রায় অন্যান্য সমস্ত ঘরগুলি নিজেই ভেঙে পড়ছে দেখাশোনার অভাবে। এছাড়া কয়েকটি ভাঙা গাড়ি, ক্ষেতের পর ক্ষেত শূন্য , দেখা যাচ্ছে না মানুষ।
এমনই একটা জায়গায় ধরুন হঠাৎ একদিন আপনি পৌঁছলেন ঘুরতে ঘুরতে। রেস্তোরাঁ দেখে আপনার ইচ্ছে হল কিছু খাবার খেয়ে নিতে। তড়িঘড়ি আপনি রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করে দেখলেন রেস্তোরাঁয় আগে থেকেই লোকজন খাবার খাচ্ছেন। আপনি অপেক্ষা করলেন এবং একটু পরে একজন বৃদ্ধ মহিলা আপনার সামনে গরম গরম বার্গার পরিবেশন করলেন। আপনি জানতে পারলেন ইনিই এই রেস্তোরাঁর মালকিন, যাঁর বয়স ৮৭ বছর। আপনি খাওয়া শেষ করে, ভদ্রমহিলার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে বাইরে বেরিয়ে এলেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের পর আপনি হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলেন কয়েক পা। আপনার চোখে পড়লো একটি লাইব্রেরী, ইচ্ছে হল বই পড়তে। আপনি লাইব্রেরীতে প্রবেশ করে অপেক্ষা করতে লাগলেন। এমন সময় আপনার সামনে উপস্থিত হলেন লাইব্রেরিয়ান। আপনি এবার একটু অবাক হলেন। একটু আগেই যে মহিলা আপনাকে খাবার সার্ভ করলেন, তিনিই আবার এখানে লাইব্রেরিয়ান। খানিকক্ষণ গল্প করার পর তিনি খোলসা করে জানালেন যে তিনিই আবার এই শহরের মেয়রও। আজ্ঞে হ্যাঁ, মনওয়ি নামের এই শহরটির যাবতীয় দায়িত্ব এই মহিলা এলসি এইলারের। কারণ এই অঞ্চলের একমাত্র বাসিন্দা তিনিই, তিনি একা।
এই মনওয়ি নামক শহরটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯০২ সালে, সেই সময় এখানকার জনসংখ্যা ছিল একশোর কাছাকাছি। এরপর প্রতি দশ বছর পর পর জনগণনা হলে জনসংখ্যার তালিকা দাঁড়ায় কিছুটা এই রকম, ১৯১০ এ ১০৯, ১৯২০ তে ১০০, ১৯৩০ এ ১২৩, ১৯৪০ এ ৯৯, ১৯৫০ এ ৬৭, ১৯৬০ এ ৪০, ১৯৭০, ৮০, ৯০ এ যথাক্রমে ১৬, ১৮, ৬ এবং ২০০০ সালে ২, ২০১০ এ ১। এরমধ্যে ১৯৩৪ সালে জন্ম হয় এলসি এইলারের। মাত্র দেড় বছর বয়সে মা, বাবার সাথে এই শহরের অদূরে অন্য এক জায়গায় বাস করতে শুরু করেন স্বপরিবারে। স্কুলে পড়তে পড়তে এলসির পরিচয় হয় রুডির সাথে। মনওয়িতেই একটি ছোট্ট স্কুলে দুজন পড়াশোনা করতেন, যাতায়াত করতেন একটি বাসে। পরবর্তীকালে দুজনে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং বিয়ে করেন।
রুডি এই সময় চাকরি করতেন ফ্রান্সে, এলসিও নিজের জীবনে কিছু করে দেখানোর সিদ্ধান্ত নেন। ইতিমধ্যে মনওয়ি তে থাকা অল্প বয়সী হাতে গোনা যুবক যুবতীরা চাকরি নিয়ে চলে যেতে থাকেন অন্য শহরে, রাজ্যে। ১৯৬০ সালে এলসির পিতার মৃত্যু হলে শহরের চার্চ টি শেষবারের মতো ব্যবহৃত হয়। ১৯৬৭ সালে শেষবারের মত ব্যবহার হয় স্থানীয় পোস্ট অফিসটি এবং ১৯৭০ এর আসে পাশে বন্ধ হয়ে যায় শহরের একমাত্র স্কুল। ১৯৭১ সালে রুডি ঠিক করেন এই গ্রামে তিনি মনওয়ি ট্যাভার্ন নামক তাদের পুরোনো রেস্তোরাঁ টি কে মেরামত করবেন। ততদিনে দুই সন্তানের জন্ম দিয়েছেন রুডি ও এলসি। তাঁরা নিজেদের পড়াশোনা সম্পূর্ন করে চাকরি করতে চলে গেছেন দূরে। তৈরি হল মনওয়ি ট্যাভার্ন নামক বার কাম রেস্তোরাঁ। স্বামী স্ত্রী দুজনে চালাতে লাগলেন এই জায়গাটিকে। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসতেন জনসংখ্যা বিহীন এই শহরে, উপভোগ করতে আসতেন নিস্তব্ধতা। কিন্তু এই দুজন পরিচালকের কাছে এই নিষ্ঠুর সত্যিটা এতটা সহজ ছিল না। ১৯৩০ সালে দাঁড়িয়ে যে শহরটি রীতিমত রমরমা বাণিজ্য করেছে, ট্রেন যাতায়াত করেছে যে শহরের বুকে, দেড়শো মানুষের বসতি নিয়ে মেতে ছিল যেই শহর, সেই শহর এখন মানুষের ধ্যান আকর্ষণ করছে কিনা বিরল বসতির জন্য!
১৯৯০ এ জনসংখ্যা দাঁড়ালো ৬ এ। গ্রাম শূন্য, অধিকাংশ বাড়ি ঘর শূন্য, সরকারি দফতরে কাজ বন্ধ, মেয়র রুডি, এবং বাকি দায়িত্বে এলসি। সাল ২০০০, ইতিমধ্যে শহরের মানুষ পাড়ি দিয়েছেন নিজের নিজের জীবন সাজিয়ে নিতে, কেউ চাকরি, কেউ জনমানব শূন্য জীবনে অতিষ্ট হয়ে চলে গেছেন বাইরে। পরে রয়েছেন স্বামী, স্ত্রী। সাল ২০০৪, পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দীর্ঘদিন অসুখে ভোগার পর মৃত্যু হল রুডির। এলসি এই নির্জনতার জীবনে হয়ে গেলেন এক্কেবারে একা। সন্তানরা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন তাদের সাথে চলে যাওয়ার জন্য, কিন্তু তিনি এই জীবনটাই চেয়েছিলেন, এই শহরে, এই রেস্তোরাঁয়, নিজের জন্মস্থানে। কোনও মতেই নিয়ে যাওয়া গেল না এলসিকে।
২০১১য় কোলনের ক্যান্সার ধরা পড়লো এলসির, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ফিরে এলেন সেই সময় ৭৭ বছর বয়সী এই বৃদ্ধা। জীবন তখনও অনেক বাকি তাঁর। খবরের কাগজ, রেডিও, টেলিভিশন সমস্ত মাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে মনওয়ি, আরও বেশি নজর কেড়েছেন এলসি এইলার। একের পর এক বহু ইউটিউব ভ্লগার কে নিজের দিকে টেনে এঁনেছেন, শুনিয়েছেন নিজের গল্প। সকাল ন'টা থেকে রাত ন'টা অবধি বার টেন্ডার এবং বেয়ারা হিসেবে কাজ করেছেন মনওয়ি ট্যাভার্নে। লাইব্রেরীতে বই আদান প্রদানের কাজ করেছেন একা হাতেই। রেস্তোরাঁর জন্য কখনও কোনও দ্রব্য কেনার হলে নিজে মালিক হিসেবে অর্ডার দিয়েছেন, মেয়র হিসেবে অনুমতি দিয়েছেন সেই দ্রব্য আমদানি করার, সেই দ্রব্য তাঁর শহরে এলে প্রাপক হিসেব সংগ্রহ করেছেন, আবার কর্মী হিসেবে নিজের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। ভোট দিয়েছেন নিজেকে, শহরের চারটে ল্যাম্প পোস্টের জন্য কর দিয়েছেন আমেরিকান সরকার কে। অথচ এতো কিছু সামলে, একা একা থাকা একটা মানুষ দিব্যি চালিয়ে নিচ্ছেন নিজের প্রাত্যহিক জীবন। কোনও বিরক্তির ছাপ নেই। কেউ যদি তাঁর সাথে কথা বলতে মনওয়ি পৌঁছান, তাঁর রেস্তোরাঁয় বসে কিছু খাবার অর্ডার করেন, তাকে এলসির সাথে কথা বলতে অন্তত ঘন্টা চারেক অপেক্ষা করতে হয়। কারণ রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন মানুষের আনাগোনা থাকে, তাদের খাবার নিজে হাতে তৈরি করে এঁটো বাসন ধুয়ে তারপর এলসির ফুরসৎ হয় গল্প করার।
শুধু মাঝে মধ্যে এলসির মুখ ম্লান হয়ে আসে যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, একা একা তাঁর এখানে ভালো লাগে কি না! যে সমস্ত দিনে মানুষ আসেন না তাঁর রেস্তোরাঁয়, তাঁর মন খারাপ হয় কি না! একগাল হাসি নিয়ে ৮৭ বছর বয়সী এই মহিলা বলেন, "আমি এই জীবনটা চেয়েছিলাম, কেউ আমাকে জোর করে দেয়নি। আমি চাইলে অন্য কিছু বেছে নিতে পারতাম। কিন্তু আমি এভাবেই থাকতে চেয়েছিলাম।" কিন্তু বাদবাকি সবকিছু ছাড়িয়ে যায় গল্পের শেষে যখন আমরা খেয়াল করি যে এই সত্যিকারের গল্পে ভদ্রমহিলা গত সতেরো বছর একটা মানুষহীন শহরে একা কাটিয়ে দিয়েছেন।
Source :
- https://en.m.wikipedia.org/wiki/Monowi,_Nebraska
- https://www.bbc.com/travel/gallery/20180129-welcome-to-monowi-nebraska-population-1