অর্ধেক আকাশের স্বপ্ন থেকে আজও বহু দূরে ভূস্বর্গের মেয়েবেলা
Womenhood in Kashmir: বুঝলাম কিছুটা হলেও বদলেছে পরিস্থিতি। তবে মেয়েদের জীবনে যে সামান্য পরিবর্তন এসেছে তার সঙ্গে ৩৭০ ধারা বিলোপের কোনও সম্পর্ক নেই।
নির্বাচন, গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় মহোৎসব। যে মহৎসব এখন চলছে ভারতের একেবারে উত্তরপ্রান্তে। আরজি কর নিয়ে আন্দোলনের মেজাজ, শরতের আগমন, উৎসবের গড়িয়াহাট, সব ছেড়ে প্রত্যক্ষ করতে গিয়েছিলাম সেই গণতন্ত্রের মহোৎসব। দেখতে গিয়েছিলাম, দশ বছর পর জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা নির্বাচন। আর তারই ফাঁকে খোঁজ নিয়ে এলাম কাশ্মীরের মেয়েদের সম্পর্কে।
স্বাধীনতা বলতে আপনি কী বোঝেন?
পরাধীনতা থেকে মুক্তি? যা ইচ্ছে করার, যা খুশি পছন্দের স্বাধীনতা?
তবে পরাধীনতার মানে কী?
ঠিক এখানেই উত্তরটা আলাদা হয়ে গিয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশে।
সাতচল্লিশের এক মধ্যরাত্রে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু স্বাধীনতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে উচ্চারণ করলেন, 'নিয়তির প্রতিশ্রুতি'। সেই নিয়তির নাম কি শুধুই একটা ভেঙে যাওয়া মানচিত্র? নাকি এই নিয়তির নামই আদতে পরাধীনতা? যে নিয়তির ফস্কা গেরোয় কৃষক তাঁর ফসলের দাম পেলেন না, শ্রমিক তাঁর সঠিক মজুরি পেলেন না, মইদুল মিদ্দা চাকরি চেয়ে প্রাণ দিলেন শহরের রাজপথে, বিচার পেলেন না বিলকিস বানু, সরকারি হাসপাতালে মধ্যরাত্রে কর্তব্যরত অবস্থায় প্রাণ দিলেন আমার সহনাগরিক। এখনও বিচার পেল না আরজি কর।
খোঁজ করতে গিয়েছিলাম সেই 'স্বাধীনতার'। গুজরাটে যে স্বাধীনতা পাননি বিলকিস বানু, উত্তরপ্রদেশে যে স্বাধীনতা পাননি হাথরাসের বোন, আমার শহর কলকাতায় যা পাননি তিলোত্তমা। অঞ্জন দত্ত যতই গেয়ে থাকুন, 'হয়তো কেরালার আকাশ আর একটু বেশি নীল' তবু সে আকাশেও পরাধীন থেকেছে এক পাঁচ বছরের শিশু। যার জন্য কেরল পুলিশকে টুইট করতে হয়েছে, 'সরি ডটার'।
আরও পড়ুন: বেহেশতের এই উপত্যকায় কে শোনে ‘মন কি বাত’!
স্বাধীনতার সাতাত্তরের মাথায় আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় কলম ধরলাম, 'আমরা কি সত্যিই স্বাধীন?' জাস্টিস চাইলাম সেই কর্তব্যরত চিকিৎসকের জন্যে। কিন্তু ওই যে বললাম "ফস্কা গেরো"। সেই গেরোর কবলে পড়েই কি আমরা বলতে ভয় পেলাম 'এই জাস্টিস ঠিক কার থেকে চাইছি?'
৩৭০ ধারার উচ্ছেদ, পুলওয়ামা, ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত রাজনীতির চিত্রনাট্যের পর 'নিয়তির প্রতিশ্রুতির' সাতাত্তর বছর পেরিয়ে ঠিক কতদূর স্বাধীনতা পেল ভূস্বর্গের মেয়েরা? পরাধীনতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কতদূর এগোতে পারল আশিয়া জিলানী, কান্তা ওয়াজীরের পরবর্তী প্রজন্ম?
ন্যাশনাল ফ্যমিলি হেলথ সার্ভের সর্বশেষ রিপোর্ট বলছে, জম্মু-কাশ্মীরের এখনও ৬০ শতাংশ মেয়েই ঋতুমতী হলে স্যানিটারি ন্যাপকিন নয়, বরং কাপড় ব্যবহার করেন। মাত্র ২১.৯ শতাংশ মহিলা সে রাজ্যে কর্মক্ষেত্রে নিযুক্তা। এই ইন্টারনেটের জমানাতেও ৬৪ শতাংশ মুসলিম মহিলা বোরখা পরে ঘোরেন জম্মু-কাশ্মীরে। তাঁরা মুখ দেখাতে ভয় পান, লজ্জা পান, মেনে চলেন ধর্মীয় রীতি।
সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে বোঝা গেল, কোনও মহিলাই ক্যামেরার সামনে কথা বলতে চান না। এই যন্ত্রটিকে ভীষণভাবে এড়িয়ে চলেন। রীতিমত ভয় পান। ফেসবুকের প্রোফাইল ছবিতে এখনও গোলাপ ফুল, পায়রা কিংবা নবীজির ছবি। পাছে তাঁর ছবি বাইরে চলে যায়, পাছে অচেনা পুরুষ সেই ছবি দেখে ফেলেন। পাছে পাড়ায় কানাঘুষো হয় সেসব নিয়ে! এ ব্যাপারে পরাধীন থাকতেই পছন্দ করেন ভূস্বর্গের মেয়েরা। সত্যিই করেন? নাকি ধর্ম-সমাজ একজোট করে তাদের সেলফি তুলতে বাধা দিচ্ছে? স্মার্ট ফোন হাতে দিয়ে শুধু দেখতে বলছে, 'দেখাতে নয়'।
অথচ জম্মু ও কাশ্মীরের শেষ এবং একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মেহেবুবা মুফতি। যিনি বোরখা পরেন না, তবে হিজাব পরেন। তাঁর ছবিও ছাপা হয় সংবাদপত্রে। মেহেবুবা মুফতির ছবি খবরের কাগজে, সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখে তাঁর কেন্দ্রের মহিলা ভোটাররা ভোট দিলেও, আজও নিজের ছবিকে সমাজমাধ্যমে আনতে ভয় পান তাঁরা। তবুও কয়েকজন মুখ না-দেখিয়েই কথা বলতে রাজি হলেন। ২০২৪ সালের মধ্যভাগে এসে এই ঘটনা ইন্টারনেটে যখন পড়ছেন আপনি, তখন ব্যাপারটা খুব সাধারণ হলেও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে ভীষণই অবাক করা কাণ্ড। গত দু'বছর আগেও এগুলো ভাবে যেত না! হাতে বুম-ক্যামেরার সমন্বয় দেখলে কেউ ধারে কাছেই আসতে দিত না।
‘৩৭০ ধারা উচ্ছেদের পর কি কিছুটা হলেও বদলেছে পরিস্থিতি?‘, কথা বলছিলাম কাশ্মীরের প্রত্যন্ত গ্রামের কয়েক জন মেয়ের সাথে।
— টুরিস্ট একটু বেশি আসছে।
আর কিছু?
— পাথর ছোড়া বন্ধ হয়েছে।
বুঝলাম কিছুটা হলেও বদলেছে পরিস্থিতি। তবে মেয়েদের জীবনে যে সামান্য পরিবর্তন এসেছে তার সঙ্গে ৩৭০ ধারা বিলোপের কোনও সম্পর্ক নেই। এ বদল শুরু হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। এ বদলের কান্ডারী শিক্ষা, মেয়েদের পড়াশোনা শেখার জায়গাটুকু। সম্ভবত সেই কারণেই কাশ্মীরের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মেয়েরাও আজ শ্রীনগরে ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান। আলেয়া বেগম খেতের কাজ করতে করতে জানান, তিনি গ্রামের কলেজের লাইব্রেরীতে কাজ করেন। ডাল লেকের রাবেয়া বিবি হাউজ বোটের ব্যবসা চালান অনলাইন সাইটের মাধ্যমে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার সময় পান না। বাজারঘাট করতে হয় নিজেকেই। বিস্তীর্ণ চারণভূমিতে খেতের রাজমা তুলতে তুলতে হুদা বলে, সে বড় হয়ে ডাক্তার হতে চায়। এক আপাদমস্তক কালো বোরখা পরা তরুণী জানান, তিনি উকিল হতে চান। ক্যামেরার সামনে বাড়ির লোকের ভয়ে কথা বলতে না চাইলেও হলেও নিজের প্রাত্যহিক সমস্যার কথা জানাতে ভোলেন না তিনি। তাঁর থেকেই জানতে পারি, রাস্তাঘাটে মেয়েদের সবথেকে বড় সমস্যা, তাঁদের জন্য কোনও সুলভ শৌচালয় নেই। ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম শ্রীনগর শহর ৭৫টি সুলভ শৌচালয়ের মধ্যে মাত্র ১১টিতে মহিলাদের জায়গা দিয়েছে। শ্রীনগর ছাড়া গোটা রাজ্যে সেই অর্থে কোথাও মহিলাদের জন্য একটিও সুলভ শৌচালয় বানিয়ে দিতে পারেনি প্রশাসন।
জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্ব মিলিয়ে মোট ৩৪ জন প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ১ জন মহিলা। মেহবুবা মুফতির কন্যা ইলতিজা মুফতি। তাঁদের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে দেখলাম সুলভ শৌচালয়ের কথা রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে আরও বেশ কিছু প্রকল্পের ঘোষণা, যা রয়েছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ম্যানিফেস্টোতেও। তবে ভোটের পরে সেসব কতটা কার্যকরী হয়, সেটাই প্রশ্ন।
যে কমিউনিস্ট পার্টি সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখায়, ১৯৯৬ সাল থেকে সেই কমিউনিস্টদের জেতা একমাত্র কাশ্মীরি আসন কুলগাম। সেই কুলগামে যখন মহম্মদ ইউসুফ তারিগামির মিছিলে যাই, সেখানে চোখে পড়ে মাত্র একজন মহিলা। সত্তর পেরিয়েছে তাঁর বয়স। বাকি সকলেই পুরুষ। দলীয় অফিসেও কোনও মেয়ে নেই, আমি এবং দু'জন সাংবাদিক ছাড়া। বুঝলাম, কাশ্মীরের মেয়েরা এখনও অর্ধেক আকাশ দখলের দৌড় থেকে বিস্তর দূরে।
টানা দশ বছর কাশ্মীরের মানুষ ভোট দিতে পারেননি। ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছিল এক বছরের বেশি সময় ধরে। গত ৪৫ বছরে বেকারত্বে হার সর্বাধিক যে রাজ্যটায়, সেখানকার মানুষ ভোট নিয়ে নিরুত্তাপ। তবে কি গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন মানুষ? যে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা যখন-তখন পিএসএ (জম্মু-কাশ্মীর জননিরাপত্তা আইন,১৯৭৮) দেখিয়ে তুলে নিয়ে যায় গ্রামের ছেলেদের। কারও বাড়িতে জোর করে দুষ্কৃতী প্রবেশ করলে, বাচ্চা-বুড়ো-মহিলা সমেত সেই বাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। নয়তো সন্দেহের বশে বাড়ি-জমি ছাড়া করে গোটা পরিবারকে।
আরও পড়ুন: ৩৭০ ধারা বিলোপের পর প্রথম বিধানসভা ভোটে কী চাইছেন কাশ্মীরের আমজনতা?
প্রশ্ন অনেক। পহেলগাম থেকে ঘোড়ার পিঠে চেপে বেতাব ভ্যালি দেখতে দেখতে এর উত্তর মেলা কঠিন। কখনও আফগান, কখনও শিখ-ব্রিটিশ-কংগ্রেস বা বিজেপির রাজনীতিই হয়তো কাশ্মীরে সেই উত্তর দিতে পারবে। আর পারবে ধর্ম নামক এক অদৃশ্য বেড়াজাল, যে বেড়াজাল একদিন কাদম্বিনী গাঙ্গুলিকে আটকে রাখতে পারেনি। পারেনি আশিয়া জিলানীকে। হয়তো ভবিষ্যতেও পারবে না। পরাধীনতার জাল ছেঁড়াই সময়ের দাবি। কিন্তু সে সময়কে ত্বরান্বিত করতে পারেন তাঁরা, যাঁরা দেশ চালান। পার্লামেন্টের মুরুব্বিরা চাইলে অনেক কিছুই সম্ভব। তবু মেয়েদেরকে একটু বোকা বানিয়ে, চুলোর আগুনের সামনে পরাধীন করে রাখার যে উষুম-কুসুম রাজনৈতিক স্বার্থ, সেই আগুনে রুটি-বেগুন ভাজার আনন্দ কেই-বা ছাড়তে চায়!
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন—
গাড়ি বারান্দার তলা থেকে ধুলো মাখা তিনটে বাচ্চা ছুটে এসে বলবে
ওগো, আমরা বাসি রুটি চাই না, পাঁচ নয়া চাই না
আমাদের ছাই রঙের হাফ প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরিয়ে
চুল আঁচড়ে দাও
আমাদের গাল টিপে দিয়ে বলল, সাবধানে—
আমরাও ইস্কুলে যাবো !
একমাত্র এই 'ইস্কুল'-ই পারবে কাশ্মীরের মেয়েদের এটা বোঝাতে যে এই আকাশের অর্ধেকটা তাদের জন্যেও বরাদ্দ। যাদের দিদা-ঠাম্মারা নিজের নামটুকু লিখতে পারতেন না, তাদের মায়েরা স্কুলের চৌকাঠ পেরিয়েছেন। মেয়েদের শ্রীনগর পড়তে পাঠিয়েছেন। সমাজের গোঁড়ামি বুঝতে শিখেছেন কিন্তু এখনও লড়ার সাহস জুগিয়ে উঠতে পারেননি। বোধ করি খুব শীঘ্রই পারবেন। তবে ভয় একটাই। যে মেয়েরা স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি অবধি পৌঁছেছে, বেকারত্ব যেন তাদের আবার শুধু খেতমুখী না করে দেয়। গত সাত বছর ধরে চাকরিহীনতায় ভুগছে কাশ্মীর। আগামী কয়েক বছরে এর সুরাহা না মিললে, এত বছরে যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে, কাশ্মীরের মেয়েদের তা আরো দশ পা পিছিয়ে দেবে।