নতুন প্রোটিনের ঠিকুজিকুষ্ঠি বাতলে দেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই, রসায়নে নোবেল এনে দিল যে আবিষ্কার

2024 Nobel Prize in Chemistry: নোবেল পুরস্কারের একাংশ পেলেন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের গবেষক ও অধ্যক্ষ ডঃ ডেভিড বেকার। আর এই পুরস্কারের বাকি অংশ যৌথ ভাবে পেলেন গুগল ডিপমাইন্ডে কর্মরত ডেমিস হাসাবিস ও জন জাম্পার।

কোন প্রোটিন কী ভাবে কাজ করে, তারা রোগের কারণ কিংবা রোগের নিরাময়ের উপায় কীভাবে হয়ে দাঁড়াতে পারে, সেটা বোঝার আগে প্রোটিনের গঠন ভালো করে জানা খুব জরুরি। “আর চলতি বছরে রসায়নে নোবেল পুরস্কার সেই নিয়েই”, বললেন রসায়ন বিভাগের নোবেল কমিটির সদস্য জোহান অ্যাকিভিস্ট।

২০২৪ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কারের একাংশ পেলেন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের গবেষক ও অধ্যক্ষ ডঃ ডেভিড বেকার। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল কম্পিউটেশনাল প্রোটিন ডিজাইন। আর এই পুরস্কারের বাকি অংশ যৌথ ভাবে পেলেন গুগল ডিপমাইন্ডে কর্মরত ডেমিস হাসাবিস ও জন জাম্পার। এই দুই গবেষকের কাজ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্যে কোনও প্রোটিনের গঠন কেমন হতে পারে, তার পূর্বাভাস দেওয়া।

জীবন কাকে বলে কিংবা বেঁচে থাকা কাকে বলে – এই প্রশ্নগুলি যদি বিজ্ঞানের লেন্স থেকে করা হয়, তাহলে বলবো তার উত্তর কিন্তু এখনও কেউ দিতে পারেনি। উত্তর পাওয়ার চেষ্টা অনবরত চলেছে। চলছেও। তবে এর বেশ খানিকটা উত্তর কিন্তু লুকিয়ে আছে প্রোটিনের গঠনের মধ্যে। কিন্তু প্রোটিনের গঠন বোঝা এত সহজ নয়। কাজেই একটি জীবন্ত কোষ বা একটি জীব কীভাবে কাজ করে, তার সম্পূর্ণ ধারণা পাওয়াও মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। তবে প্রোটিনের গঠন বোঝা বা আন্দাজ করতে একটা অনবদ্য হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে এই তিন বিজ্ঞানীর গবেষণা।

আরও পড়ুন: মেশিন লার্নিং নিয়ে দুর্ধর্ষ আবিষ্কার! নোবেলের মঞ্চে স্বীকৃতি বিজ্ঞানীদ্বয়কে

অ্যামাইনো অ্যাসিড হল প্রোটিনের গঠনগত একক। এক-একটি প্রোটিনে কুড়িটি অ্যামাইনো অ্যাসিড একটি সারি দিয়ে মালার মতো সাজানো থাকে। এই কুড়িটি অ্যামাইনো অ্যাসিডকে কিন্তু নানান রকম ক্রমে সাজানো হয়। আর তাতেই এক-একটি প্রোটিনের প্রাথমিক গঠন বদলে বদলে যাবে। এক-একটি জীবের কোষে যে আলাদা আলাদা রকম গঠনের ডিএনএ রয়েছে, সেখানেই কিন্তু লুকিয়ে রয়েছে কী কী অ্যামাইনো অ্যাসিড কোন ক্রমে সাজানো থাকবে একটি জীবের শরীরে। যদিও বহুদিন পর্যন্ত ধারণা ছিল, এ তথ্য জানা কোনওদিনই সম্ভব হবে না। কিন্তু ২০২০ সালে হ্যাসাবিদ ও জাম্পার বসে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে কাজে লাগিয়ে পরিচিত কিছু প্রোটিনে আলাদা-আলাদা অ্যামাইনো অ্যাসিডের অণু কী কী ক্রমে সাজানো রয়েছে, তার জট খুলে ফেললেন। গুগল ডিপমাইন্ডে বসে তাঁরা বানালেন আলফাফোল্ড টু নামের একটি সফটওয়্যার।

আর সেখান থেকে আরও গভীরে গিয়ে ধারণা করা যেতে পারে, প্রোটিনটির কাজ কী কী হতে পারে। সে কোনো রোগের কারণ হতে পারে কি-না কিংবা তাকে কাজে লাগিয়ে কোনো রোগের চিকিৎসা করা যাবে কি-না। তবে এই প্রোটিনগুলি যে কেবলই একটা মালার মতো সাজানো থাকে, তা কিন্তু নয়। এই সাধারণ মালাগুলো নানান রকম ভাবে ভাঁজ খেয়ে বা বেঁকে গিয়ে মজার মজার গঠন তৈরি করতে পারে। কখনও আবার থ্রি-ডায়মেনশনাল গঠনও তৈরি করে। হ্যাসাবিদ ও জাম্পারের তৈরি সফটওয়্যার একটি প্রোটিনের থ্রি-ডায়মেনশনাল গঠন কেমন হবে, তা-ও আন্দাজ করতে পারে।

তবে এসবের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের উদ্দ্যেশ্য ছিল নতুন ধরণের প্রোটিন তৈরি করা, যেগুলি আদতে মানুষ এবং জীবকূলের কল্যাণে লাগবে। আর এই সমস্যাটাই ২০০৩ সালে সমাধান করলেন ডেভিড বেকার। তিনি কম্পিউটেশনাল প্রোটিন ডিজাইনিং-এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন প্রোটিনের নকশা তৈরিতে সাহায্য করলেন। সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা যেমন একটি নতুন বাড়ির নকশা বানিয়ে নিতে পারেন জটিল অঙ্ক কষে, তারপর বাস্তবে সেই বাড়িটি বানান, ঠিক তেমনই নতুন প্রোটিনের নকশা নানান জটিল হিসেব-নিকেশ মাথায় রেখে বানানোর পরে, সেই প্রোটিন আবার ল্যাবরেটরিতে বানানো হয়।

ডঃ বেকার ও তাঁর সহকর্মীরা রোজেটা নামে একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামও তৈরি করেন। যার সাহায্যে অ্যামাইনো অ্যাসিডের এমন কিছু ‘সিকোয়েন্স’ বা ক্রমবিন্যাস খুঁজে পাওয়া যাবে, যেগুলি থেকে সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রোটিন তৈরি করা যাবে।

ডেভিড বেকারের গবেষণা যেন নতুন একটা দিক খুলে দিয়েছিল। নভেল করোনা ভাইরাসের বাইরের আবরণের প্রোটিনের গঠন, সেই প্রোটিনের প্রতিরোধী প্রোটিন অর্থাৎ ‘ইনহিবিটর’-কে দেখতে কেমন, এগুলি জানা কিন্তু সম্ভব হয়েছিল রোজেটার জন্যেই। ভ্যাক্সিন তৈরি থেকে শুরু করে নানান জটিল রোগের চিকিৎসার জন্যে ‘ডিজাইন’ করা ন্যানো-মেডিসিন, সবেতেই কিন্তু ডঃ বেকারের এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের চিহ্ন রয়ে গেছে।

আরও পড়ুন: জিনঘটিত রোগের মুশকিল আসান! যে আবিষ্কার নোবেল এনে দিল বিজ্ঞানীদের

নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে আয়োজন করা একটি ছোটো সাক্ষাৎকারে হ্যাসাবিস জানিয়েছেন, “আমার ধারণা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স পৃথিবীর নানান রহস্য উন্মোচন করতে বিজ্ঞানীদের সাহায্য করতে পারে। আলফা ফোল্ড সেরকমই একটি উদাহরণ মাত্র”। হ্যাসাবিসের মতে “এই ধরণের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স টুল লক্ষ লক্ষ ডেটাকে খতিয়ে দেখা, সেই ডেটা থেকে একটি প্যাটার্ন বা ধাঁচ খুঁজে পাওয়ার জন্যে বিজ্ঞানীদের সাহায্য করতে পারে। আর আমার মতে, তাকলাগানো সব কাজ করতে বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীরা এই ধরণের টুলকেই হাতিয়ার বানায়।” আর এবার এমনই আবিষ্কারকে সম্মান জানালো ২০২৪ নোবেলের মঞ্চ।

More Articles