৬ গোল হজমের শাস্তি! ভক্তদের পাথরবৃষ্টিতে ছারখার হয়ে গিয়েছিল ফুটবলাররা...
1982 World Cup Football: খেলার পরে যখন ট্রফি দেওয়া হলো, তখন ওলন্দাজ খেলোয়াড়েরা আরহেন্তিনার সামরিক প্রধানকে সেলাম করতে অস্বীকার করে।
১৯৭৮-এর বিশ্বকাপ
গুবরে পোকার মতো দেখতে জার্মানির আম-আদমির গাড়ি, ফোক্সভাগেনের ‘বিটল’-এর দিন ফুরলো; ইংল্যান্ডে ভূমিষ্ঠ হলো প্রথম নলজাতক; ইতালিতে গর্ভপাত আইনসিদ্ধ হল। মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রথমবার একজন এইডসে মারা যাচ্ছিল, তখনও অবিশ্যি রোগটার এমন নামকরণ শোনা যায়নি। ইতালির পাঁচবারের প্রধানমন্ত্রী আলডো মরোকে সশস্ত্র লালফৌজ রোমের কেন্দ্রস্থলে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিল; বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে পানামার কাছ থেকে চুরি করে নেওয়া পানামা খালটা মার্কিন সরকার পানামাকে ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিল। মিয়ামির সর্বজ্ঞ মাতব্বররা বলে বেড়াচ্ছিল খুব শিগগিরই নাকি ফিদেল কাস্ত্রোর পতন অনিবার্য। আর সেরেফ কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা শুধু! নিকারাগুয়ায় সোমোসা সাম্রাজ্য থরথরিয়ে কাঁপছিল, ইরানে শাহ সাম্রাজ্যও টলমল করছিল, গুয়াতেমালার সামরিক বাহিনী প্যানসোস শহরে চাষাভুসো জনতার ভিড়ে নির্বিচারে মেশিনগান চালাল। বলিভিয়ার লোহার খনি এলাকার চারজন মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে দমিতিলা বারিয়োস দেশের সামরিক অপশাসনের বিরুদ্ধে অনশন শুরু করলেন, অচিরেই গোটা বলিভিয়া জুড়ে অনশন আন্দোলন এমন ছড়িয়ে পড়ল যে মিলিটারি স্বৈরশাসনের ভিত গেল কেঁপে। যদিও আরহেন্তিনার মিলিটারি স্বৈরশাসন বহাল তবিয়তে ছিল এবং সুস্বাস্থ্যের নজির পেশ করতে তারাই ১৯৭৮-এ বিশ্বকাপের একাদশতম সংস্করণ আয়োজন করল।
ইওরোপের দশটা দেশ, আমেরিকার চারটে, ইরান আর তিউনিশিয়া ’৭৮-এর বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছিল। মহামহিম পোপ রোম থেকে তাঁর আশীর্বাণী পাঠালেন। বুয়েনস আইরেসের মনুমেন্তাল স্টেডিয়ামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সামরিক বাহিনীর তুমুল কুচকাওয়াজ আর রণবাদ্যের মধ্যে জেনারেল বিদেলা ফিফার সর্বময় কর্তা আভেলাঞ্জির বুকে একখানা মেডেল সেঁটে দিল। স্টেডিয়াম থেকে কয়েক কদম দূরেই, আরহেন্তিনার আউশভিৎস, নেভি স্কুল অব মেকানিকসে নির্বিচারে বিরোধীদের নিকেশ করা চলছিল পুরোদমে। আবার কয়েক মাইল উপরে উড়োজাহাজ থেকে জেলখানার কয়েদিদের ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছিল সমুদ্রের নোনা জলে।
"অবশেষে দুনিয়ার মানুষ আরহেন্তিনার প্রকৃত চেহারাটা দেখতে পেল," ফিফার সভাপতি অহংকারে মটমট করতে করতে টিভি ক্যামেরার সামনে বলে গেল। বিশেষ অতিথি হেনরি কিসিংগার ভবিষ্যতবাণী করে গেল: "এই দেশ, আরহেন্তিনা, আগামী দিনে সব দিক দিয়ে এগিয়ে যাবে।" সেবার বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে সবার আগে পায়ে বল ঠেকায় জার্মান ফুটবল দলের অধিনায়ক বার্টি ফোগটস। সে আবার কয়েকদিন বাদে ঘোষণা করে বসল, "আরহেন্তিনায় সব কিছু অসামান্য শৃঙ্খলায় চলে। আমি এদেশে কোনও রাজনৈতিক বন্দি দেখিনি।"
আরহেন্তিনা বেশ কয়েকটা ম্যাচ জিতলেও ইতালির কাছে হারল এবং ব্রাজ়িলের সঙ্গে ম্যাচ অমীমাংসিতভাবে শেষ হল। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে আরহেন্তিনা যদি পেরুকে গোলের বন্যায় ভাসিয়ে দেয় তবেই তারা ফাইনালে পৌঁছবে। অবিশ্যি যতগুলো গোল প্রয়োজন ছিল তার থেকে বেশ খানিকটা এগিয়েই তারা শেষ করল। কিন্তু ৬-০ তো ঠিক সাধারণ ফলাফল নয়, পেরুর পক্ষে বিপর্যয় বলা যায়। এমন বিপর্যয়ে সন্দিগ্ধচিত্ত এবং উদার, দু'ধরনের ভক্তেরই ভুরু কুঁচকে গেল। পেরুর খেলোয়াড়রা লিমায় পৌঁছে দেশের ফুটবল ভক্তদের পাথরবৃষ্টির মুখোমুখি হলো।
আরহেন্তিনা আর হল্যান্ডের মধ্যে ফাইনালে ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হলো অতিরিক্ত সময়ে। আরহেন্তিনা ৩-১ গোলে জিতল ঠিকই, তবে ওদের নতমস্তকে ধন্যবাদ জানানো উচিত দেশপ্রেমিক বারপোস্টকে। হল্যান্ডের একটা শট খেলার নির্ধারিত সময়ের একেবারে শেষ মুহূর্তে বারপোস্টে লেগে ফিরে না-এলে অতিরিক্ত সময়ে যাওয়ার দরকারই হতো না। রেনসেনব্রিঙ্কের গোলার মতো শট ঠেকিয়ে দেওয়ার পরও বারপোস্ট যে সামরিক সরকারের কাছ থেকে কোনও সম্মান বা পদক পেল না, তা সেরেফ মানবজাতির চিরকালের অকৃতজ্ঞ স্বভাবের জন্য। যাইহোক, বারপোস্টের চেয়েও বেশি নজর কাড়ল মারিয়ো কেম্পেসের গোল। বিশ্বকাপ জুড়ে কেম্পেস বাতাসে লম্বা চুল উড়িয়ে দর্শকদের ছুঁড়ে দেওয়া কাগজের টুকরোয় সাদা বরফের মতো দেখতে ঘাসের ওপর দিয়ে ঘোড়ার মতো দৌড়চ্ছিল।
খেলার পরে যখন ট্রফি দেওয়া হলো, তখন ওলন্দাজ খেলোয়াড়েরা আরহেন্তিনার সামরিক প্রধানকে সেলাম করতে অস্বীকার করে। এই বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থান পায় ব্রাজ়িল, ইতালি চতুর্থ।
কেম্পেস জনতার রায়ে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হলো, সেইসঙ্গে ছ'টা গোলের সুবাদে সর্বোচ্চ গোলদাতাও হল। পাঁচটা করে গোল করে তার পিছনে ছিল পেরুর কুবিয়াস আর হল্যান্ডের রেনসেনব্রিঙ্ক।
আরও পড়ুন- “জয় অথবা মৃত্যু”! বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ফুটবলারদের টেলিগ্রাম করলেন মুসোলিনি
আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে!
সারা দুনিয়া থেকে বাছাই করা পাঁচ হাজার সাংবাদিক, রাজকীয় মিডিয়া সেন্টারে এলাহি ব্যবস্থা, অত্যাধুনিক স্টেডিয়াম, নতুন বিমানবন্দর : চতুর্দিকে আরহেন্তিনীয়দের কর্মদক্ষতার বোলবোলাও। একজন প্রবীণ জার্মান সাংবাদিক স্বীকার করে নিলেন, ’৭৮-এর বিশ্বকাপের জাঁকজমক এক্কেবারে ১৯৩৬-এর বার্লিন অলিম্পিকের সঙ্গে তুলনা করার মতো। সেবারের অলিম্পিকে হিটলার রাজকোষের ভাঁড়ার খালি করে সবকিছু ধাঁ-চকচকে করে গড়েছিল।
যদিও ’৭৮-এর বিশ্বকাপ আয়োজনে আরহেন্তিনার কত খরচ হয়েছিল তা গোপন রাষ্ট্রীয় তথ্য হিসেবে চেপে রাখা হয়েছিল। বহু কোটি ডলার ব্যয় হয়েছিল, সেইসঙ্গে চুরি-বাটপাড়িও হয়েছে এন্তার, কত কোটি তা কেউ জানে না! সামরিক স্বৈরশাসনের অভিভাবকত্বে দেশের আকাশে-বাতাসে খুশির হিল্লোল বইছে, এই কথাটি পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ-পুব-পশ্চিম- সব দিকে ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল লক্ষ্য। ওদিকে বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটির হোমড়াচোমড়ারা নিকেশ করার তত্ত্বে অবিচল ছিল, তা সে যুদ্ধের দোহাই দিয়েই হোক বা নেহাতই সন্দেহ নিরসন করে নিশ্চিত হতে। তারা এটাকে বলত ‘চূড়ান্ত মীমাংসা’, না-হোক কয়েক হাজার আরহেন্তিনীয়কে তারা কচুকাটা করেছিল। তাদের কোনও চিহ্ন পর্যন্ত রাখেনি! ঠিক কত জন তা কেউ জানে না; কেউ জানার চেষ্টা করলে তাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দিত। বিরুদ্ধ মত বা প্রশ্ন করার স্পর্ধার মতোই কৌতূহলও তাদের চোখে ভয়ংকর অপরাধ ছিল। আরহেন্তিনার গ্রামীণ পরিষদের সভাপতি সেলেদোনিয়ো পেরেদা ফুটবলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বড়াই করে বলেছিল, "আজ আর একথা বলে কারও মানহানি করা যাবে না যে, আরহেন্তিনার কিছু বিখ্যাত লোক দিনে ডাকাতি আর মুক্তিপণের টাকায় ভর করে পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমের দৌলতে লাভের গুড় খেয়ে গেছে।" সংবাদমাধ্যমে আরহেন্তিনার জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের সমালোচনা করা নিষিদ্ধ ছিল। কোচেরও সমালোচনা করা চলত না। এই বিশ্বকাপে আরহেন্তিনা বেশ কয়েকবার হোঁচট খেয়েছে। কিন্তু স্থানীয় ধারাভাষ্যকাররা খেলোয়াড়দের শুধুই প্রশংসা করতে বাধ্য ছিল।
বিশ্বের কাছে নিজের ছবি উজ্জ্বল করতে মিলিটারি স্বৈরশাসক মার্কিন দেশের একটি জনসংযোগ সংস্থার সঙ্গে পাঁচ লক্ষ ডলারের চুক্তি করেছিল। বারসন-মারস্টেলার কোম্পানির বিশেষজ্ঞদের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, "কোনও পণ্যের ক্ষেত্রে যা সত্য, একটি দেশের জন্যও তা-ই সত্য।" বিশ্বকাপের হর্তাকর্তাদের একজন, অ্যাডমিরাল কার্লোস আলবের্তো লাকোহ্ত্তে, এক সাক্ষাৎকারে বলেছিল, "যদি আমি ইওরোপ কিংবা মার্কিন দেশে যাই তাহলে কী আমার চোখ টানবে, আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করবে কী? কোনও সন্দেহই নেই, বিশাল ইমারত, পেল্লাই বিমানবন্দর, চোখ ধাঁধানো গাড়ি, সুখাদ্য…।"
জনতার চোখে মায়ার কাজল পরিয়ে ডলার কামাতে দক্ষ ওই অ্যাডমিরাল বিশ্বকাপ আয়োজনের কার্যভার নিজের কাঁধে তুলে নেয় আগে ওই পদে আসীন আধিকারিকের রহস্যময় মৃত্যুর পর। লাকোহ্ত্তে বিপুল টাকাপয়সার ঠিকমতো দেখভাল করত না, খুব ভালো নজরদারি চালাত না ওই টাকা কীভাবে খরচ হচ্ছে সেদিকে, ফলে প্রতিশ্রুত সমস্ত বদল সে ঘটাতে পারেনি। এমনকী স্বৈরতান্ত্রিক রাজকোষের সচিব হুয়ান আলেমান, জনতার টাকার অপব্যয় নিয়ে কিছু মন্তব্য করে এবং অ্যাডমিরালকে বেশ কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন করে। কিন্তু অ্যাডমিরালের স্বভাবই ছিল হুমকি দিয়ে বেড়ানো। সচিবকে পর্যন্ত সে বলে, "পরে ওসব নিয়ে কথা বলা যাবে খন, আপনার বাড়িতে যদি কেউ বোম রেখে আসে তাহলে কিন্তু অভিযোগ করতে আসবেন না…।"
আরহেন্তিনা পেরুর বিরুদ্ধে ম্যাচে চতুর্থ গোলটা করার পর সত্যিই আলেমানের বাড়িতে বিস্ফোরণ হয়।
বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাবার পর, অ্যাডমিরাল লাকোহ্ত্তেকে কৃতজ্ঞতাবশত ফিফার সহসভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
আরও পড়ুন- শুধু পেলের খেলা দেখবে বলে যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছিল দুই দেশ!
গেমিলের গোল
১৯৭৮-এর বিশ্বকাপে দুর্দান্ত ছন্দে থাকা হল্যান্ড খেলছিল সেবারের কাপে জঘন্য খেলা স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে।
স্কটিশ খেলোয়াড় আর্চিবল্ড গেমিল স্বদেশীয় খেলোয়াড় হার্টফোর্ডের কাছ থেকে বল পেয়ে সবিনয়ে ওলন্দাজদের ব্যাগপাইপের সুরে নাচতে ডাকে। সেই প্যাঁচালো সুরে উইল্ডশুট প্রথম মাথা ঘুরে গেমিলের পায়ের কাছে গোঁত্তা খেয়ে পড়ল। তারপর সুরবিয়ারকে ধুলোয় গড়াগড়ি খেয়ে লাট্টুর মতো ঘুরতে দিয়ে গেমিল এগিয়ে গেল। ক্রোলের অবস্থা হয় সবচেয়ে শোচনীয়; গেমিল ক্রোলের দু' পায়ের ফাঁক দিয়ে বল গলিয়ে দেয়। তারপর গোলকিপার ইয়ংব্লুড তার দিকে এগিয়ে এলে গেমিল গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে লব করে গোলে বল ঢুকিয়ে দেয়।
বেতেগার গোল
সেই ’৭৮-এর বিশ্বকাপের কথাই বলছি। ইতালি আয়োজক দেশ আরহেন্তিনাকে ১-০ হারাল।
যে কৌশলে ইতালি খেলার একমাত্র গোলটা করেছিল, তা সবুজ ঘাসের বুকে যেন একটা ত্রিভুজ এঁকে এগিয়েছিল, আর সেই ত্রিভুজের মধ্যে আরহেন্তিনার রক্ষণের অসহায় খেলোয়াড়রা অনেকটা এলোপাথাড়ি গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যাওয়া অন্ধজনের মতো বেভুল চলাফেরা করছিল। বেতেগার দিকে বলটা ঠেলে দিল আন্তোনিয়োনি, বেতেগা পায়ের পাতার আলতো চাপড়ে তাকে পাঠাল রোসির দিকে। রোসি তখন বেতেগার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়েছিল। সে একটুও না ঘুরে গোড়ালি ছুঁইয়ে চমৎকার ব্যাকহিল করল। ততক্ষণে বেতেগা পেনাল্টি বক্সে অনুপ্রবেশ করেছে। সে বলটা ধরে দু'জনকে কাটিয়ে, বাঁ পায়ের দুরন্ত শটে গোলকিপার ফিলিয়োলকে পরাস্ত করে।
যদিও কেউ তখন বুঝতে পারেনি, তবে সেদিন থেকেই ইতালি চার বছর পরে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্বকাপ জয়ের রাস্তায় চলতে শুরু করে।
সান্ডারল্যান্ডের গোল
১৯৭৯-র কথা বলছি। ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে আর্সেনাল আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মধ্যে এফএ কাপের ফাইনাল ম্যাচ চলছিল।
খেলা মোটামুটি ভালোই চলছিল, কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি যে ১৮৭১ সালে শুরু হওয়া এফএ কাপের ইতিহাসে সবচেয়ে টানটান আর উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচটা সেদিনই খেলা হবে। সে একবারে নাটকের উপর নাটক! আর্সেনাল দীর্ঘক্ষণ ২-০ এগিয়ে ছিল, খেলাও প্রায় শেষের দিকে। কী হতে চলেছে বুঝে গিয়ে দর্শকরা একটু একটু করে স্টেডিয়াম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ছে। এমন সময় হঠাৎ যেন মেঘ ফেটে গোলের হড়পা বান এল। দু'মিনিটে তিন গোল- ম্যাককুইনের চমৎকার শটে একটা গোলের পর ম্যাকলরি আর্সেনালের পেনাল্টি বক্স ভেদ করে আর একটা গোল করে এল। ম্যাকলরি রক্ষণের দু'জন খেলোয়াড় আর গোলকিপারকে কাটিয়ে গোলটা করেছিল। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দু'গোল শোধ করল খেলার ৮৬ এবং ৮৭ মিনিটে। কিন্তু ৮৮ মিনিট শেষ হবার আগেই আর্সেনাল ফের এক গোলে এগিয়ে গেল। লিয়াম ব্র্যাডি- আহা, কী অসামান্য খেলা ছিল, সে-ই বলটা তৈরি করল আর সান্ডারল্যান্ড নিখুঁত শটে আর্সেনালকে ৩-২ গোলে ম্যাচ জিতিয়ে দিল।
আরও পড়ুন- ফাইনালের আগেই ট্রফি গেল চুরি! কাপ খুঁজে বিশ্বকাপের নায়ক হয়েছিল এক কুকুর…
১৯৮২-র বিশ্বকাপ
হলিউডে হাঙ্গেরির পরিচালক ইস্তবান সাবো-র [ইস্তভান জ়াবো] ‘মেফিস্টো’, শিল্প আর বিশ্বাসঘাতকতার অতুলনীয় সৃষ্টি, অস্কার পাচ্ছে। একই সময়ে জার্মানিতে অসামান্য প্রতিভাবান কিন্তু চিরটাকাল নানাভাবে অত্যাচারিত চলচ্চিত্র পরিচালক ফাসবিন্দার নেহাতই অল্প বয়সে মারা যাচ্ছেন। অভিনেত্রী রোমি স্নেইডার আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে, কর ফাঁকি দেওয়ায় সোফিয়া লোরেনের কারাদণ্ড হচ্ছে। পোল্যান্ডে ট্রেড ইউনিয়নের নেতা লেক ভায়েলসাকে [লেচ ওয়ালেসা] গারদে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
লাতিন আমেরিকার কবি, ভিখিরি, গায়ক-বাজনদার, পয়গম্বর, যোদ্ধা আর যত আতিপাতি ফক্কড়দের হয়ে গার্সিয়া মার্কেস নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করছেন। এল সালভাদোরের এক গাঁয়ে মিলিটারি শিলাবৃষ্টির মতো বুলেট চালাল, সাতশোর বেশি চাষাভুসো মানুষ মারা গেল, যার অর্ধেক শিশু। গুয়াতেমালায় জেনারেল রিয়োস মন্ত স্থানীয় ইন্ডিয়ানদের কচুকাটা করার কাজ ত্বরান্বিত করতে ক্ষমতা দখল করে বসল, ঘোষণা করল স্বয়ং ঈশ্বরই তাকে গুয়াতেমালার সিংহাসনে বসিয়েছেন এবং এবার থেকে নাকি ‘পবিত্র আত্মা’ গুয়াতেমালার গুপ্তচর বাহিনীর পথ নির্দেশ করবেন।
মিশর ছ'দিনের যুদ্ধে ইজ়রায়েলের কাছে খোয়ানো সাইনাই উপদ্বীপ পুনর্দখল করল। পৃথিবীতে প্রথমবার কোনও মানুষের বুকে কৃত্রিম হৃদ্যন্ত্রের লাব-ডাব শোনা গেল। মিয়ামির সর্বজ্ঞ মাতব্বররা বলে বেড়াচ্ছিল খুব শিগগিরই নাকি ফিদেল কাস্ত্রোর পতন অনিবার্য। আর সেরেফ কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা শুধু! ইতালিতে মহামহিম পোপ দ্বিতীয়বারের জন্য আততায়ীর আক্রমণের হাত থেকে বাঁচলেন। হিস্পানি দেশের কংগ্রেস আক্রমণকারীদের তিরিশ বছরের জেল হলো, সোশালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির ফেলিপে গঞ্জালেস প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য অভিনব প্রচার শুরু করলেন, ওদিকে বার্সেলোনায় দ্বাদশ বিশ্বকাপের আসর বসল।
সেবার চব্বিশটা দল অংশগ্রহণ করেছিল, আগেরবারের চেয়ে আটটা দল বেশি, কিন্তু আমাদের মহাদেশের ভাগে বাড়তি কিছু জোটেনি, ইওরোপ থেকে খেলল চোদ্দোটা দল, আমেরিকা থেকে ছ'টা, আফ্রিকার দুটো দল আর সেইসঙ্গে কুয়েত এবং নিউ জ়িল্যান্ড।
প্রথম দিনেই গতবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আরহেন্তিনা বার্সেলোনায় হেরে বসল। ওদিকে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে আরহেন্তিনার সামরিক বাহিনী ইংল্যান্ডের কাছে হারল। দীর্ঘকালের স্বৈরশাসনে নিজের দেশের মানুষকেই ক্রমাগত হারিয়ে অভ্যস্ত আরহেন্তিনার ওইসব মহান সমরনায়কেরা ইংল্যান্ডের হাতে ভেড়ার পালের মতো আত্মসমর্পণ করল। টিভিতে গোটা দুনিয়া জুড়ে সেসব ছবি দেখানো হলো, দক্ষিণ জর্জিয়া দ্বীপে নৌ-বাহিনীর কর্তা আলফ্রেদো আস্তিস, যে কোনওদিন মানবাধিকারের তোয়াক্কা করেনি, সে ব্যাটাও মাথা ঝুঁকিয়ে অসম্মানজনক শর্তে আত্মসমর্পণের সনদে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হলো।
পরের কয়েকদিনে টিভি জুড়ে শুধু ’৮২-র বিশ্বকাপের ছবি- আরবদেশের চিরাচরিত জোব্বা পরিহিত শেখ ফাহাদ আল-আহমেদ আল-সাবাহ কুয়েতের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের চার নম্বর গোল বাতিল করাতে সোজা মাঠে ঢুকে পড়ল; খেলা শুরুর তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে গোল করল ইংল্যান্ডের ব্রায়ান রবসন। বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্রুততম গোল [তথ্যটি ঠিক নয়, অনু.]; জার্মান গোলকিপার শুমাখার হাঁটু দিয়ে মেরে ফরাসি স্ট্রাইকার বাতিস্তঁর নাক ফাটিয়েও কেমন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মাঠে দাঁড়িয়েছিল (গোলকিপার হওয়ার আগে শুমাখার একটা কামারশালায় কাজ করত)।
টুর্নামেন্টের প্রথম সারির সব জায়গাগুলো ইওরোপের দেশগুলোই দখল করে নিল। যদিও জ়িকো, ফালকাও, সক্রেটিসের দৌলতে ব্রাজ়িল যথেষ্ট ভালো খেলে। কিন্তু ভাগ্য তাদের সহায় ছিল না। তবে ওরা দর্শকদের প্রচুর আনন্দ দিয়েছে। আর সদ্য দক্ষিণ আমেরিকার সেরা খেলোয়াড়ের শিরোপা পাওয়া জ়িকো দেখিয়ে দিয়েছিল ‘জ়িকোম্যানিয়া’ কাকে বলে। দর্শকদের কাছে তার জনপ্রিয়তার ধারেকাছে কেউ ছিল না।
সেবার কাপ জিতল ইতালি। যদিও তারা শুরুর দিকে বেশ খারাপ খেলছিল। কিন্তু তাদের দলের বাঁধনটা ভালো ছিল, আর ছিল সুযোগসন্ধানী পাওলো রোসির দুরন্ত সব শট। ফাইনালে ৩-১ গোলে জার্মানিকে হারায় ইতালি।
বনিয়েকের সুরেলা ফুটবলের দৌলতে পোল্যান্ড তৃতীয় স্থান পায়। ফ্রান্স যদিও চতুর্থ হলো, তবু তাদের ফল আরও ভালো হওয়া উচিত ছিল। ফরাসি দলের মাঝমাঠে ইওরোপীয় করণকৌশল আর আফ্রিকার আনন্দময়তার মিশেল সত্যিই ভোলা কঠিন।
ইতালির রোসি ছ'টা গোল করে তালিকার শীর্ষে থাকল, তার পরেই পাঁচ গোল করেছিল জার্মানির রুমেনিগে। রুমেনিগে শুধু গোলই করেনি, দলটাকেও ক্রমাগত চাঙ্গা করে গেছে।