কেবল ব্রাজিল নয়, পৃথিবীর এই বিখ্যাত ফুটবলারের নামও 'পেলে'! জানুন তাঁর আসল পরিচয়

Abedi pele ghana legend : ই ফুটবলারও একেবারে ফেলে দেওয়ার পাত্র নন। আফ্রিকান ফুটবল জগতে কান পাতলেই তাঁর নাম অহরহ শোনা যায়।

ব্রাজিলের ছোট্ট একটি জায়গায়, দরিদ্র এক পরিবারে তাঁর জন্ম। সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল উত্তরণের পথটা। এডমন আরান্তেস দে নাসচিমেন্তো থেকে পেলে হওয়ার কাহিনি কেবল নামের বদলেই নয়। এই কাহিনি লড়াইয়ের। ঘামে, জলে, কাদা মেখে বাড়ি ঢোকার সময় সেই স্বপনই জ্বলজ্বল করত। সেই স্বপ্ন ব্রাজিলের গণ্ডিতে কেবল আটকে নেই। ছড়িয়ে পড়েছে সাও পাওলো থেকে সোদপুর, কলকাতা থেকে কাশ্মীর, কাতার, মাদ্রিদ – সর্বত্র। শোনা যায়, পেলের জন্মের আগে তাঁর এলাকায় বিদ্যুৎটুকুও ছিল না। তাঁর জন্মের মুহূর্তেই প্রথমবার বিদ্যুৎ আসে সেখানে। তাই তাঁর বাবা ছেলের নাম দেন এডমন, থমাস আলভা এডিসনের নাম অনুসারে। সেই ছেলেই যে ইতিহাসের পাতায় বিদ্যুৎগতিতে নিজের নাম লেখাবে, ভেবেছিলেন কি!

২৯ ডিসেম্বর, ২০২২। সেই দৌড়ই থেমে গেল। সাও পাওলোর হাসপাতালে জীবনের শেষ যুদ্ধ হেরে গেলেন ফুটবল সম্রাট। কেবল বডি কন্ট্যাক্ট গেম নয়, ফুটবল যে আদ্যোপান্ত সুন্দর একটি খেলা, পৃথিবীর কাছে সেই তত্ত্বটাই তুলে ধরেন তিনি। পেলের মৃত্যু – কথাটা লিখতে গেলে এখনও অনেকেরই হাত কেঁপে উঠছে। তাঁর মতো কেউ আর আসবে না, বলছেন ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। পেলে তো পেলেই, তিনি একজনই হন। সত্যিই কি তাই?

পেলের জনপ্রিয়তা ঠিক কোন জায়গায়, সেটা হয়তো সামান্য একটি লেখায় তুলে ধরা যাবে না। কেবল একটি পরিসংখ্যান থাকল। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় ব্রাজিলে ‘এডসন’ নামের শিশু ছিল সাড়ে ৪৩ হাজার। পেলের কিংবদন্তি কাহিনি ও বিশ্বকাপ জয়ের পর সেই সংখ্যাটা লাখের গণ্ডি পেরিয়ে যায়। আর ‘পেলে’ নামটি ব্রাজিলের গণ্ডি টপকে ঢুকে পড়ে অন্য দেশে। ২৯ ডিসেম্বর পেলে মারা গেলেও, ‘পেলেশূন্য’ হয়ে যায়নি এই পৃথিবী। ঘানার আরেক বিখ্যাত ফুটবলারের নামের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন : প্রবল ঝগড়া থেকে কাছের বন্ধু, পেলে-মারাদোনার মধ্যে সম্পর্ক যেন ফুটবলের আস্ত একটি রূপকথা

আসল নাম আবেদি আয়েউ (Abedi Ayew)। এই নামেই জন্মেছিলেন তিনি। কিন্তু ফুটবল জগতে যাওয়ার পর তাঁর নাম বদলে যায়। আবেদি আয়েউ হয়ে যান ‘আবেদি পেলে’ (Abedi Pele)। ঘানার এই ফুটবলারও একেবারে ফেলে দেওয়ার পাত্র নন। আফ্রিকান ফুটবল জগতে কান পাতলেই তাঁর নাম অহরহ শোনা যায়। ঘানা তো বটেই, আফ্রিকার ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার আবেদি পেলে। নিজের সময় বিশ্বের মঞ্চও শাসন করেছেন তিনি। মূলত অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে খেলা এই ফুটবলারের বেড়ে ওঠাও বেশ কষ্টের মধ্যে। সেখানে রয়েছে হেরে যাওয়া, রয়েছে লড়াই। এই গল্প পেলের জীবনের থেকে কম রোমহর্ষক নয়, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিলও পাওয়া যায়।

দক্ষিণ ঘানার একটি অজ পাড়াগাঁ কিবি। সেখানেই হতদরিদ্র একটি পরিবারে ১৯৬৪ সালে জন্মান আবেদি পেলে। ১৮ জন ভাইবোন মিলে ভরা সংসার, কিন্তু পেট চালানোর মতো টাকার অভাব। লড়াইটা শুরু সেখান থেকেই। ছোট থেকেই আবেদির লক্ষ্য ছিল একটাই। পায়ে ফুটবল পড়লে দুনিয়ার সবকিছু ভুলে যেতেন। ভুলে যেতেন খাবারের কথা, মায়ের কান্না, ভাইবোনদের করুণ মুখ। কেবল দৌড়, দৌড় আর দৌড়। পা থেকে গোলার মতো বেরত শট। মাথার ওপর গনগনে সূর্য, রোদের হল্কায় তেতেপুড়ে যাচ্ছে চামড়া।

তার মধ্যেই ফুটবল খেলে যাচ্ছেন আবেদি আয়েউ। ছোট একটুখানি জায়গা পেলে একা একাই বল নিয়ে নেমে যেতেন। চলত নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ। আশপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে লোকজন। কেউ আড়চোখে দেখে চলে যেত, কেউ বা দাঁড়িয়ে দেখত। কেউ মুগ্ধ হতো, কারও মুখ থেকে বেরিয়ে আসত টোন টিটকিরি! আশেপাশের লোকজন বলত, ‘আরে! এ তো পুরো পেলের মতো খেলে!’ প্রশংসার পাশাপাশি আসত ব্যঙ্গোক্তিও। ‘কীরে? পেলে হবি নাকি রে তুই?’

অবাক চোখে তাকাত ছোট্ট আবেদি। কে পেলে? কোথায় থাকেন ইনি? আবেদির বাড়িতে যে টিভি নেই, বিদ্যুতের বন্দোবস্তও নেই। অন্ধকারেই কাটে তাঁর জীবন। এই পেলে কি আলো এনে দেবে? আবেদি হয়তো জানতেন না, পেলের বাড়িতেও কোনও বিদ্যুৎ ছিল না। তাঁর জন্মের পরই চলে আসে বিদ্যুৎ। নাম হয়ে যায় ‘এডসন’। এসব কাহিনি জানতে পারেননি আবেদি আয়েউ। কিন্তু তাঁর নামের সঙ্গে সেই ছোট্ট থেকেই জুড়ে যায় ‘পেলে’ নামটি। আবেদি আয়েউ হয়ে গেলেন আবেদি পেলে।

আরও পড়ুন : ছিল না ফুটবল কেনার সামর্থ্য, মোজা দিয়েই বল বানিয়ে মাঠে নেমে পড়তেন পেলে

আফ্রিকার দেশগুলি আজ বিশ্ব ফুটবলের কাছে নিজেদের জাত চিনিয়েছে। সাদা চামড়ার মানুষদের দম্ভের সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা। মুগ্ধ হয়েছে বিশ্ব। একসময় পেলেও বলেছিলেন, আফ্রিকান ফুটবল একদিন বিশ্বকাপ পাবেই। বিশ্বকে এই ভরসা যারা দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলেন আবেদি পেলে। আফ্রিকান ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম সেরা একটি মুখ। প্রথমে ঘানার ক্লাব, তারপর কাতারের আল সাদ, এভাবেই কাটছিল দিন। তারপর ঘানার জাতীয় দলের হয়েও খেলেছিলেন তিনি। কিন্তু ইউরোপের ফুটবলের সঙ্গে তখনও তেমন পরিচয় ছিল না। ঘানার আফ্রিকাজয়ী দলের অন্যতম সদস্য, কিন্তু তিনি জানেন, তাঁর জায়গা আরও বড় পৃথিবীতে।

এক সময় সুযোগ এল। ফ্রান্সের প্রথম সারির দল মার্সেইয়ের ম্যানেজমেন্টের নজরে পড়ে গেলেন আবেদি পেলে। হিরে চিনতে ভুল করেনি কেউ। কেবল ঘানা নয়, মার্সেই দলের সর্বকালের অন্যতম সম্পদ হয়ে নিজেকে অমর করেছেন আবেদি। নব্বই শতকের প্রথম ভাগে মার্সেই কার্যত অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছিল। ১৯৯৩ সালে মিলানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগও জেতে। ওই সময়ই চারবার লিগ ওয়ান জয়, দুবার ইউরোপের চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলা – মার্সেই যেন স্বর্ণযুগের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। আর সেই দলেরই অন্যতম স্তম্ভ হয়ে ওঠেন আবেদি পেলে। জঁ পিয়ের পাপিন এবং ক্রিস ওয়াডলের সঙ্গে জুটি বেঁধে আক্রমণভাগকে শানিয়ে তোলেন। আর মার্সেইতে তাঁর জার্সি নম্বরও ছিল '১০'। কাকতালীয়?

আরও পড়ুন : তিন তিনবার বিশ্বকাপ জয়! ফিরে দেখা ‘হ্যাট্রিকের রাজা’ পেলের জীবনের সেরা ম্যাচগুলি

তাঁর নেতৃত্বে ঘানা আফ্রিকার ফুটবলকে শাসন করে। ১৯৯২ সালের আফ্রিকান নেশনস কাপের সেরা খেলোয়াড় তিনি। কার্যত একার হাতে ঘানাকে ফাইনালে তোলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কার্ড সমস্যার জন্য ফাইনাল খেলতে পারেননি। আফ্রিকার ফুটবল যেন নতুন এই নক্ষত্রের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিল। তাঁর নতুন উপাধিও সামনে আসে এই সময় – ‘আফ্রিকার মারাদোনা’।

বিশ্ব ফুটবলে এর আগে কোনও একজন খেলোয়াড়কে পেলে আর মারাদোনার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে? এখনও হয় কি? জানা নেই। আবেদি পেলে নিজে সেই বিরল প্রতিভা, নিজস্ব পৃথিবীর সম্রাট। তাঁর ট্রফি ক্যাবিনেটও অনেকাংশেই পূর্ণ। পেলে চলে যাওয়ার পর শ্রদ্ধার্ঘ্যও জানান। হাজার হোক, অলক্ষ্যে এই মানুষটিই তো ছিলেন!

More Articles