প্রবল ঝগড়া থেকে কাছের বন্ধু, পেলে-মারাদোনার মধ্যে সম্পর্ক যেন ফুটবলের আস্ত একটি রূপকথা

Pele Maradona Relationship : এখন আবার মারাদোনা-পেলের যুগলবন্দী। পেলে নিজেই তো বলে গিয়েছিলেন, তাঁকে অমান্য করার সাধ্যি কার?

There is still much to be said, but for now, may God give strength to family members. One day, I hope we can play ball together in the sky.

“হয়তো কোনও একদিন, কোনও একসময় আমরা আবার একসঙ্গে হব। আবার পায়ে তুলে নেব বলটা। আকাশের এক কোণায় দু’জনে মিলে ফুটবল খেলব।”

আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগের কথা। গোটা বিশ্ব সেই সময় করোনা মহামারীর সামনে। অসহায়, নানারকম চিন্তায়, অবসাদে উদ্বিগ্ন মানব সভ্যতা দেখল, জনসংখ্যার একটা অংশ হঠাৎ করেই হারিয়ে গেল। হঠাৎ করেই ‘নেই’ হয়ে গেলেন কয়েক লাখ মানুষ। আরও কয়েক লক্ষ মানুষ বাড়িতে, হাসপাতালে বিছানায় শুয়ে কাতরাতে লাগলেন। সবসময় ভয়, এবার কার পালা? করোনার সেই ভয়াল পরিবেশের মধ্যেই হঠাৎ সামনে এল দুঃসংবাদ। ফুটবলের আকাশ থেকে খসে পড়লেন দিয়েগো আর্মান্ডো মারাদোনা নামের এক নক্ষত্র। মাত্র ৬০ বছর বয়স হয়েছিল তাঁর। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিরতরে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন ফুটবলের রাজপুত্র।

ব্রাজিলে বসে সেই খবর শুনেছিলেন আরও একজন। এডমন আরান্তেস দে নাসচিমেন্তো, গোটা পৃথিবী অবশ্য তাঁকে চেনে পেলে নামে। বিশ্ব ফুটবলের এই কিংবদন্তিরও শরীর খুব একটা ভালো নয়। তারই মধ্যে ‘বন্ধু’র এই মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি তিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় অত্যন্ত সক্রিয় পেলে। সেই মাধ্যমটিকেই বেছে নিলেন এবার। লিখলেন একদম ওপরের সেই ইংরাজি লাইনগুলি, “I hope we can play ball together in the sky”। স্বর্গোদ্যানে একসঙ্গে ফুটবল খেলার স্বপ্নটি তখন থেকেই দেখেছিলেন তিনি।

পেরিয়ে গিয়েছে দু’টি বছর। ২০২২ সাল শেষের মুখে। আজ বাদে কাল নতুন একটি বছর শুরু হবে। তার আগে ফের ভেসে এল দুঃসংবাদ। ২৯ ডিসেম্বর দীর্ঘদিনের মারণসঙ্গী ক্যানসারের কাছে হেরে গেলেন পেলে। ৮২ বছর বয়সে চলে গেলেন ফুটবলের পৃথিবী ছেড়ে। তারপর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে আসে দু’বছর আগের সেই বিখ্যাত টুইট। ‘আকাশের এক কোণায় ফের আমাদের দেখা হবে। আমরা ফুটবল খেলব।’ এখন আবার মারাদোনা-পেলের যুগলবন্দী। পেলে নিজেই তো বলে গিয়েছিলেন, তাঁকে অমান্য করার সাধ্যি কার?

দুজনের মধ্যে ২২ বছরের তফাৎ। দুই প্রজন্মে খেলেছেন তাঁরা। কখনও বিশ্বকাপ, কোপা আমেরিকার মতো বড়ো মঞ্চে একে অপরের বিরুদ্ধে খেলতে দেখা যায়নি। তবুও বিশ্ব ফুটবলের অমীমাংসিত এই প্রশ্নটি বারবার তাড়া করে – পেলে না মারাদোনা? কে সর্বকালের সেরা ফুটবলার? পেলের সঙ্গী তিন তিনটে বিশ্বকাপ। সবচেয়ে কমবয়সী খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ খেলা, সেইসঙ্গে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে হ্যাটট্রিকের রেকর্ড। নামের পাশে ১২৮১ টি গোলের রেকর্ড – পেলেকে ব্যাখ্যা করা কি এতই সহজ?

আপামর বিশ্বকে ব্রাজিলের সাম্বা মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন পেলে। আর সেই একচ্ছত্র সাম্রাজ্যে প্রথম আঘাতটি আনলেন যিনি, তাঁর বাড়ি আর্জেন্টিনায়। ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনার দ্বন্দ্ব যেন ফুটবল জগতের রূপকথা। প্রতিবেশী দুটি দেশের লড়াইয়ে একটা সময় অবধি বাজি জিতে রেখেছিলেন পেলে। সত্তর দশকের শেষ থেকে সেখানে থাবা বসালেন মারাদোনা। এক মুহূর্তে গোটা পৃথিবী যেন আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গেল। ১৯৮৬-র বিশ্বকাপ সেই বিভাজন আরও স্পষ্ট করল। তাতে ইন্ধন যোগাল হ্যান্ড অফ গড। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিতর্কিত এই গোলটির পরই নেমে এল শতাব্দীর সেরা গোল। দ্বন্দ্ব কীরকম ছিল? বিংশ শতাব্দীর সেরা ফুটবলার কে, এটা নিয়ে ইন্টারনেটে ভোটের আয়োজন করেছিল ফিফা। সেখানে জনতার বিচারে পেলেকে টপকে সেরার জায়গায় বসেন মারাদোনা। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল বিতর্ক। তর্ক, পাল্টা তর্কে উত্তপ্ত গোটা বিশ্ব। শেষমেশ ফিফা আরও একটি ভোটের আয়োজন করে। সেই ভোটে পেলে শতাব্দীর সেরা ফুটবলার বিবেচিত হন। ফলে একদিক দিয়ে দেখলে, পেলে ও মারাদোনা একইসঙ্গে শীর্ষস্থান দখল করে রয়েছেন। কিন্তু চরম মীমাংসা হল না।

এসব তর্ক, বিবাদ তো সমর্থকদের মধ্যে। পেলে আর মারাদোনার সম্পর্কে সেই আঁচ পড়েনি। সত্যিই কি পড়েনি? ১৯৭৯ সালে তরুণ মারাদোনাকে প্রথমবার দেখেছিলেন পেলে। তখন তিনি স্বীকৃত কিংবদন্তি, ফুটবল সম্রাট। তারপর রূপকথার এই গল্প শুরু হয়। কিন্তু প্রথমদিকে দুজনের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছিল বিশেষ কিছু কারণে। নিজের আত্মজীবনীতে আরেক ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি গ্যারিঞ্চাকে নিয়ে কথা বলেন মারাদোনা। সেখানেই পেলেকে একহাত নেন। মারাদোনা বলেন, গ্যারিঞ্চার অতিরিক্ত মদে আসক্তি তাঁকে শেষ করল। কিন্তু সেই সময় তাঁরই বন্ধু পেলে কিছু করলেন না। স্ফুলিঙ্গ যেখানে লাগার কথা ছিল, সেখানেই লাগল। পরে পেলের সতীর্থ সেলসোও মারাদোনাকে কটাক্ষ করেন। শুরু হয় দুই নক্ষত্রের প্রতিযোগিতা।

দু’টি রেখা আপাতদৃষ্টিতে সমান্তরাল, দু’জনের মধ্যে কোনও মিল নেই। কিন্তু একটা জায়গায় এসে এই রেখা দুটি একে অন্যের সঙ্গে ঠিক মিশে যায়। সেই বিন্দুটি হল ফুটবল। পেলে, মারাদোনার এই বৈরিতা যেন হওয়ারই ছিল; আবার তা মিটে যাওয়ারও কথা ছিল। একসঙ্গে গিটার নিয়ে বসে থাকা, পার্টিতে দোলনায় বসে আছেন দুজনে – দুই নক্ষত্র যেন একসঙ্গে আবার জুড়ে গিয়েছিলেন। টিভি শোয়ের মঞ্চে দুজনে শুধু হেড করেই ফুটবল খেলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও দুজনকে দেখা গিয়েছে। একটা সময় পর পেলেও বলেন, আমরা এখন বন্ধু।

তবে খুনসুটি থামেনি। দুজনেই সেরার সেরা, অনেক কীর্তি, অনেক রেকর্ড, ফুটবল মাঠের কিংবদন্তি দৃশ্যের জন্ম দিয়েছেন। পেলেও ইয়ার্কির ছলেই মারাদোনাকে বলতে পারেন, আমার জায়গায় আসতে গেলে তোমায় হাজারটা গোল করতে হবে। মারাদোনাও নাছোড়বান্দা, পেলের কথা ঠিক হলেও তাতে যে কিছু যায় আসে না, সেটাও স্পষ্ট করে দেন। তুলনা, দ্বন্দ্ব, সবকিছু নিয়ে দুজনের মধ্যে চলত ইয়ার্কি। ২০১৮ বিশ্বকাপের সময় একসঙ্গে উপস্থিত হয়েছিলেন পেলে আর মারাদোনা। হুইল চেয়ারে বসা পেলেকে দেখে ছুঁতে গিয়েছিলেন মারাদোনা। জড়িয়ে ধরে কপালে চুম্বনও করেছিলেন। বিশ্ব ফুটবল দেখেছিল দুই কিংবদন্তির এক স্মরণীয় মুহূর্ত। 

সেই সমস্ত ঘটনা এসে থেমেছিল ২০২০ সালে। ফুটবল ঈশ্বরেরও কি অদ্ভুত সমাপতন! ২০২২ সালের বিশ্বকাপের সময়ই পেলে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। অবস্থা একটু একটু করে খারাপ হতে থাকে। অথচ তাঁর স্বপ্ন ছিল ব্রাজিলকে নিয়ে। স্বপ্ন ছিল এবার তাঁর দেশ ষষ্ঠবার বিশ্বকাপ জিতবে। কিন্তু হল না। অন্যদিকে রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে ফ্রান্সকে হারিয়ে তৃতীয়বারের জন্য বিশ্বকাপ জিতল আর্জেন্টিনা। লিওনেল মেসির স্বপ্ন, লাখ লাখ আর্জেন্টিনাবাসীর স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হল। কিন্তু যিনি এই দৃশ্য দেখলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন, তিনিই আর নেই।

সাও পাওলোর হাসপাতালে বসে সেই ‘বন্ধু’র কথাই মনে পড়ছিল অসুস্থ পেলের। বিকেলের আলো ততক্ষণে মুখ ছুঁয়ে নেমে গিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অসুস্থ শরীরেও পেলে লিখলেন, “দিয়েগো নিশ্চয়ই এখন হাসছে”। মারাদোনার এই স্বপ্ন বুকে তুলে পেলে এবার পাড়ি দিলেন অন্য জগতে। যে জগতে তুলনা নেই, দ্বন্দ্ব নেই। রয়েছে ছোট্টবেলার সেই দুটো বালক, লড়াই করে, দারিদ্র্যের সঙ্গে যুঝে যাঁদের উঠে আসা। বল নিয়ে আপন মনে খেলে চলেছেন দুজনে। ‘আকাশের এক কোণে দুজনে অপেক্ষা করব’… বন্ধু দিয়েগো, ক্যাবিনেট থেকে খেলার সরঞ্জাম বের করো। ‘বন্ধু চল, বলটা দে’… খেলা হবে এবার।

More Articles