ঐতিহাসিক জয়ের ১১ বছর, আজ কোথায় দাঁড়িয়ে মমতার তৃণমূল?

অস্বস্তিতে পড়েছে সরকার৷ রাজনৈতিক মহল বলছে, তৎকালীন শিক্ষা দপ্তর তথা শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিয়োগ-সংক্রান্ত বিষয়ে আরও সতর্ক, আরও সচেতন এবং আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলে, আজ এভাবে প্রশ্নের মুখে সরকারকে পড়...

 

২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ভোট গণনা হয় ১৩ মে৷ ওই দিনেই গোটা দেশ জেনে যায়, ৩৪ বছরের জগদ্দল বাম-পাথর সরিয়ে বাংলার ক্ষমতায় এসেছেন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ওই ক্ষমতায়নের ১১ বছর পূর্তির দিনে তৃণমূলের অনেক নেতা-নেত্রীই অনেক কথা বলেছেন৷ মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে ঘটে যাওয়া ওই নিঃশব্দ বিপ্লবকে কুর্নিশ করেছেন৷ বলেছেন, "সামনে এখনও দীর্ঘ পথচলা। দিদিই দল ও সরকারের প্রাণ, শক্তি, মুখ, শেষ কথা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেনাপতিত্বে তৃণমূল কংগ্রেস এগিয়ে চলবে।"

 

ওদিকে, ২০২২-এর ১৩ মে, তৃণমূল সরকারের ১২তম বর্ষে পা রাখার দিনেই কলকাতা হাই কোর্টে পেশ করা হয় বিস্ফোরক এক তদন্ত রিপোর্ট৷ আদালত-নিযুক্ত কমিটি তদন্ত শেষ করে জানিয়েছে, চরম কেলেঙ্কারি হয়েছে এসএসসি-র নিয়োগে৷ পরীক্ষা না দিয়েই শ'য়ে শ'য়ে লোকজন ভুতুড়ে নিয়োগপত্র পেয়েছেন৷ ওইসব নিয়োগপত্রে চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর স্ক্যান করে বসানো হয়েছে৷ বেনজির সব অভিযোগ৷ এই দুর্নীতিতে উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিকদের সক্রিয় ভূমিকার কথা তদন্ত কমিটি তুলে ধরেছে৷ এমনকী, কয়েকজনের দুর্নীতির বহর এতটাই বড়, যে, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশে এফআইআর করার পরামর্শ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে৷ যদি এই সুপারিশকে হাই কোর্ট মান্যতা দেয়, তাহলে বড় শাস্তির মুখে পড়তে পারেন একাধিক আধিকারিক৷ এবং সর্বাপেক্ষা গুরুতর বিষয়, এই নিয়োগ দুর্নীতিতে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর যোগ থাকারও প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে৷ ঐতিহাসিক জয়ের ১১ বছর পূর্তির দিনেই আদালত-নিযুক্ত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট নিশ্চিতভাবেই চরম অস্বস্তিতে ফেলেছে রাজ্য সরকারকে৷

 

এসএসসির গ্ৰুপ-ডি, গ্ৰুপ-সি এবং শিক্ষক নিয়োগ মামলার শুনানি হয় কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি সুব্রত তালুকদার এবং বিচারপতি আনন্দকুমার মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চে। প্রায় একমাস পর এই মামলার শুনানি হল শুক্রবার। এই দিনই আদালতের নিয়োগ করা এসএসসি-নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত কমিটি রিপোর্ট পেশ করে ডিভিশন বেঞ্চে।

 

আরও পড়ুন: মমতার বাংলা বিজয়ের বর্ষপূর্তি, অমিত-আগুনেই পুড়ল বঙ্গ বিজেপি?

 

রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে বেনিয়মের অভিযোগ ৷ বলা হয়েছে, প্যানেলের মেয়াদ শেষের পরও বেআইনিভাবে নিয়োগ করা হয়েছে৷ চরম দুর্নীতি হয়েছে নিয়োগ-পর্বে৷ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিতকুমার বাগ কমিটি স্কুলে গ্ৰুপ-সি কর্মী নিয়োগ নিয়ে তদন্ত শেষ করে তাঁর রিপোর্টে বলেছেন, ৩৮১ জনকে ভুয়া নিয়োগ করা হয়েছে। এই ৩৮১ জনের মধ্যে ২২২ জন কোনও পরীক্ষাই দেননি। অবশিষ্ট ১৫৯ জন পরীক্ষায় ডাহা ফেল করেছেন৷ তা সত্ত্বেও এই ৩৮১ জনই চাকরি পেয়েছেন৷ প্যানেলের মেয়াদ শেষ হয় ২০১৯ সালের মে মাসে। কিন্তু শীর্ষ স্তরের নির্দেশে ওই বছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত বেআইনিভাবে নিয়োগ করা হয়েছে।

 

আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য তুলে ধরা হয়েছে ওই রিপোর্টে৷ বিচারপতি বাগ জানিয়েছেন, এই ভুয়া নিয়োগের সঙ্গে এসএসসি-র তৎকালীন প্রতিটি কর্তাই কোনও না কোনওভাবে জড়িত৷ দুর্নীতিতে যুক্তদের নামও প্রকাশ্যে এনেছে ওই তদন্ত কমিটি৷ যাঁদের নাম সামনে এনেছে, তাঁরা সকলেই দায়িত্বশীল অফিসার৷ পুলিশে এফআইআর করার সুপারিশ করা হয়েছে নিয়োগ-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির আহ্বায়ক শান্তিপ্রসাদ সিনহা, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বর্তমান সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়, স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান সৌমিত্র সরকার, স্কুল সার্ভিস কমিশনের সচিব অশোক কুমার সাহা এবং স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রোগ্রামিং অফিসার সমরজিৎ আচার্যর বিরুদ্ধে ৷ এই পাঁচজনের পদের দিকে নজর দিলেই বোঝা যায় নিয়োগ দুর্নীতির শিকড় কত গভীরে ছিল এবং একই সঙ্গে স্পষ্ট হয়, এই স্তরের পদাধিকারীরা যে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, সেই দুর্নীতির বিষয়টি শিক্ষা দপ্তরের শীর্ষ স্তরে অজানা থাকার প্রশ্নই নেই৷

 

এছাড়াও বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছে সুবীরেশ ভট্টাচার্য (স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান), শর্মিলা মিত্র, শুভজিৎ চট্টোপাধ্যায়, শেখ সিরাজউদ্দিন, মহুয়া বিশ্বাস, চৈতালি ভট্টাচার্য (প্রত্যেকেই কমিশনের আঞ্চলিক চেয়ারম্যান), রাজেশ লায়েকের (বোর্ডের টেকনিক্যাল অফিসার) বিরুদ্ধে ৷ নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি করতে হলে উঁচু পদে থাকতে হয়৷ এবং এঁরা কেউই কম ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন না৷ বলা হয়েছে, স্কুল সার্ভিস কমিশনের আধিকারিক অশোক কুমার সাহা, শান্তিপ্রসাদ সিনহা ও সৌমিত্র সরকারের নির্দেশে প্রোগ্রাম অফিসার সমরজিৎ আচার্য ভুয়া নিয়োগপত্র তৈরি করেন৷ বিশেষ কোনও মহলের নির্দেশে প্যানেলের র‍্যাঙ্ক পরিবর্তন করেছেন অশোককুমার সাহা, শান্তিপ্রসাদ সিনহা এবং সৌমিত্র সরকার৷ বলা হয়েছে, মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বকেয়া নিয়োগ শেষ করতে বলেন। তাঁর নির্দেশেই ৫ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটিই যাবতীয় দুর্নীতি করেছে৷ নম্বর বাড়িয়ে ওএমআর শিটে পর্যন্ত গণ্ডগোল করা হয়েছে৷

 

স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ নিয়ে বেশ কয়েকবছর ধরেই অভিযোগ তুলেছিল চাকরিপ্রার্থীরা৷ এসব এতদিন অভিযোগ পর্যায়েই ছিল৷ নিয়োগ-দুর্নীতির শিকড় কতদূর পর্যন্ত ছড়িয়েছে, তা জানতে কলকাতা হাইকোর্টই তদন্ত কমিটি গঠন করে৷ সেই তদন্ত কমিটির পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর দেখা যাচ্ছে, গাদা গাদা রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকা পালন করে বেকায়দায় ফেলেছে রাজ্য সরকারকে৷ রাজ্যে পরিবর্তনের ১১ বছর অতিক্রম করার দিনেই এই দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার ঘটনা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে৷ বিরোধীরা সরব হয়েছে৷ অস্বস্তিতে পড়েছে সরকার৷ রাজনৈতিক মহল বলছে, তৎকালীন শিক্ষা দপ্তর তথা শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিয়োগ-সংক্রান্ত বিষয়ে আরও সতর্ক, আরও সচেতন এবং আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলে, আজ এভাবে প্রশ্নের মুখে সরকারকে পড়তে হতো না৷ মন্ত্রীর ঢিলেঢালা মনোভাবের কারণেই রাজ্য প্রশাসনের গায়ে নিয়োগ-দুর্নীতির কালি লাগতে চলেছে৷

 

আগামী ১৮ মে এই মামলার রায় ঘোষণা করবে হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ৷ আইনি মহলের অনুমান, সেদিন নিশ্চিতভাবেই মুখ পুড়বে রাজ্য সরকারের৷

 

More Articles