চৈতন্য মহাপ্রভুর চরণচিহ্ন রয়েছে বাংলার এই তীর্থক্ষেত্রে
জীবে প্রেমের মাধ্যমেই আসল অভীষ্টপূর্ণ হয়। সকলের প্রতি ভালোবাসা প্রদান না করলে কখনো ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না।
শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু
অম্বিকা-কালনা বা শ্রীপাট এর অম্বিকা-কালনা একটি প্রাচীন ও বর্ধিষ্ণু স্থান বলেই পরিচিত সকলের কাছে। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে এই স্থানটি উল্লিখিত হয়েছে অম্বুয়া বা অম্বুয়া মুলুক নামে। ভাগীরথীর এক পারে কালনা, অপর পারে শান্তিপুর। জনশ্রুতি শোনা যায়, এই স্থানে অম্বরীশ ঋষির আশ্রম ছিল এবং তিনি দেবী অম্বিকা কালীর পূজার্চনা করতেন। তাঁর নামানুসারে এই স্থানের নাম হয় অম্বিকা।
উমাকান্ত প্রেমানন্দ শাহ রচিত 'Iconography of the Jain Goddess Ambika' প্রবন্ধটি অবলম্বনে, বিনয় ঘোষ Journal of the University of Bombay, 1940-তে মন্তব্য করেন যে,"অম্বিকা কালনার দেবী অম্বিকা ছিলেন জৈনদেবী। পরে তিনি হিন্দু শক্তিপূজায় স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দেন।বৌদ্ধতন্ত্রের প্রভাবের যুগেই বাংলায় অম্বিকা দেবীর পূজার প্রচলন ছিল বলে মনে হয়, অর্থাৎ সময়টা ছিল পালযুগ। অম্বিকা কালনার ইতিহাস হিন্দু পালযুগ পর্যন্ত বিস্তৃত না হলে,'অম্বিকা' কথার ব্যাখ্যা করা যায় না।"
আরও পড়ুন: এই মন্দিরে শায়িত স্বয়ং বলরামের মৃতদেহ!
শোনা যায়, সরকার সাতগাঁও-এর অন্তর্ভুক্ত, 'অম্বোয়া' নামে একটি পরগনার উল্লেখ আছে আইন-ই-আকবরিতে। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে ভনবেন ব্রুক-এর মানচিত্রে 'Ambowa' নামে যে স্থানটি প্রর্দশিত হয়, তা যে অম্বিকা কালনা, এতে কোনও সন্দেহই নেই। বৃন্দাবনদাস তাঁর 'চৈতন্যভাগবৎ'-এ অম্বিকা কালনার উল্লেখ করে লিখেছেন- 'এই মতে সপ্তগ্রামে অম্বুয়া মুলুকে
বিহরেন নিত্যানন্দ পরম কৌতুকে।' এতদ্ভিন্ন আমরা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রূপরাম চক্রবর্তীর লেখা 'ধর্মমঙ্গল' কাব্যে দেবী অম্বুয়া ও কালনার উল্লেখ পাই।তিনি লিখেছেন- "তোমার মহিমা মাতা কি বলিতে পারি
অম্বুয়ার ঘাটে বন্দে কালিকা ঈশ্বরী।"
এই অম্বুয়া তথা বর্তমান অম্বিকা কালনা মহাপ্রভু চৈতন্য ও গৌরী দাসের মিলনস্থলরূপে প্রসিদ্ধ। কালনা শহরের দক্ষিণ ভাগে (বর্তমানে মহাপ্রভু পাড়া) অতি প্রাচীন তেঁতুলবৃক্ষটির গায়ে একটি ফলকে লেখা আছে, 'শ্রী শ্রী মহাপ্রভুর বিশ্রাম স্থল,আমলিতলা।শ্রী শ্রী গৌর ও গৌরীদাস সম্মিলন। শ্রীপাট অম্বিকা।' মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের পাদস্পর্শধন্য এই কালনা শহর। এই গৌরীদাস ছিলেন নিত্যানন্দ শাখার দ্বাদশ গোপালের একজন মোহান্ত ও চৈতন্য উপাসক। ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে নদিয়া জেলার শালিগ্রামে তাঁর জন্ম। অনেক তীর্থ ভ্রমণ করে অবশেষে তিনি কালনায় আসেন।কথিত আছে, তিনি একটি তেঁতুলগাছের তলায় বসে ভাবতে থাকেন, এবার কোথায় কোন তীর্থে যাবেন, কোথায় গেলে প্রাণসখা গৌরাঙ্গর দেখা পাবেন। ঠিক সেই সময় ভাগীরথীর অপর পারে শান্তিপুরের নিকটবর্তী হরিনদী গ্রামে বসে মহাপ্রভুর মন উথালপাথাল করছে। পূর্বজন্মের প্রিয় সখা তাঁরই পথ চেয়ে অপেক্ষা করছে কালনায়। তিনি একটি ছোট ডিঙি নৌকো নিয়ে বৈঠা বেয়ে এপারে কালনায় চলে এলেন। প্রদীপের ম্লান আলোয় দেখলেন গৌরীদাসকে। গৌরীদাস মহাপ্রভুকে প্রণাম করতে যেতেই, চৈতন্য মহাপ্রভু গৌরীদাসকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। প্রায় মূর্ছিত গৌরীদাসকে মহাপ্রভু বললেন তাঁর পূর্বপরিচয়। আবেগবিহ্বল গৌরীদাসকে ভাগীরথীর তীরে নিয়ে গেলেন, ভাগীরথীর জলে ভেসে উঠল তাঁদের পূর্বপরিচয় ও লীলাখেলা।('আচম্বিতে অচৈতন্য প্রেমাবেশে শ্রী চৈতন্য, পড়ি গেলা আমলীর মূলে')। গৌরীদাস দেখলেন, তিনি পূর্বজন্মে কৃষ্ণসখা সুবল এবং মহাপ্রভু স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। মূর্ছিত গৌরীদাসকে মহাপ্রভু আবার বাস্তবে ফিরিয়ে আনলেন। তাঁর হাতে নিজের বৈঠাখানি দিয়ে বললেন- এ বৈঠা ভবনদী পারের বৈঠা। জীবকে যুগযন্ত্রণা থেকে উদ্ধারের নাম মন্ত্রস্বরূপ করবে, এই আমার ইচ্ছা। একটি গীতাও দিয়েছিলেন মহাপ্রভু, এগুলি আজও সযত্নে রাখা আছে শ্রীশ্রী গৌরাঙ্গ মন্দিরে, এছাড়াও আছে তালপাতার পুঁথি, মহাপ্রভুর নিজের লেখা। মহাপ্রভু ও গৌরীদাসের মিলনের অপূর্ব কাহিনির বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় 'ভক্তিরত্নাকর' গ্রন্থে। গৌর-গৌরীর মিলনস্থল এই তেঁতুলবৃক্ষটি আনুমানিক ৫০০ বছরের পুরনো। তাঁদের মিলনকে স্মরণে রেখে গাছতলায় একটি বেদি তৈরি করা হয়েছে। স্থানটির নাম 'মহাপ্রভুতলা'। এখানেই আছে গৌরীদাস পণ্ডিতের পাথরের সিংহাসন। বিশ্রামস্থলে রয়েছে চৈতন্য মহাপ্রভুর শ্রীচরণচিহ্ন ।
এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে, কিন্তু মহাপ্রভু-কে গৌরীদাস কিছুতেই নীলাচলে যেতে দিতে রাজি হচ্ছেন না, তখন অনন্যোপায় মহাপ্রভু কথা দিলেন গৌরীদাসকে।বললেন, গৌরীদাস তাঁর দারুমূর্তি প্রতিষ্ঠা করলে প্রত্যহ মহাপ্রভুর দেখা পাবেন। মহাপ্রভুর আদেশমতো নবদ্বীপে যে গাছের নিচে চৈতন্যদেব ভুমিষ্ঠ হয়েছিলেন, সেই নিমগাছের কাঠ এনে গৌরীদাস 'নিতাই-গৌর'-এর বিগ্রহ নির্মাণ করে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। জনশ্রুতি আছে, প্রত্যহ শ্রীচৈতন্যবিগ্রহ জীবন্ত হয়ে উঠে গৌরীদাসের সঙ্গে কথা বলতেন।
এরপর কত মাস, বছর পার হলো, চৈতন্য মহাপ্রভু ইহলীলা সাঙ্গ করলেন, তখন তিনি হলেন অপ্রকট। এদিকে মহাপ্রভুর জীবন্ত দারুমূর্তি দর্শনের নিমিত্তে দলে দলে ভক্ত সমাগম হতে লাগল।গৌরীদাস মনে মনে প্রমাদ গুনলেন, ভাবলেন তাঁর আরাধ্য দেবতাকে কেউ যদি চুরি করে নিয়ে যায় এবং প্রাণশক্তিকে নিজের হৃদয়ে ধারণ করে,তখন কি উপায় হবে! এই ভেবে তিনি মন্দিরদ্বার রুদ্ধ করে দিলেন। তখন দর্শনপ্রার্থী ভক্তগণ শচীমাতার স্মরনাপন্ন হলো এবং শচীমার আদেশে পুনরায় মন্দির খোলা হলো, কিন্তু শর্তসাপেক্ষে। শর্তটি হল কোনও ভক্ত চাইলে একবার মাত্র ক্ষণিকের জন্য দর্শন পাবে, এই ঝলক দর্শন প্রথা এখনও ঐতিহ্যকে বয়ে নিয়ে চলেছে।
জনশ্রুতি নিত্যানন্দ দাস মহাপ্রভুর দ্বিতীয় সত্তা (১৪৭৩-১৫৪৫ তাঁর লীলাখেলা)। মাত্র ১২ বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করেন(শোনা যায় জনৈক সন্ন্যাসী বিশ্বরূপের সহিত) তীর্থ পর্যটনের উদ্দেশ্যে। টানা কুড়ি বছর ভারতের বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্র ভ্রমণ করে অবশেষে নবদ্বীপে আসেন এবং শ্রীশঙ্করাচার্যের গৃহে চৈতন্যদেবের সঙ্গে মিলিত হন। এরপর দু'জনে শ্রীক্ষেত্র এবং বাংলায় সকলের মধ্যে কৃষ্ণনামের মধুর সুধা বিতরণ করেন।একসময় চৈতন্যদেবের অনুরোধে সংসারজীবনে প্রবেশ করলেন অবধূত নিত্যানন্দ দাস। কালনার গৌরীদাস পণ্ডিতের ভ্রাতা সূর্যদাস সরখেলের দুই কন্যা, বসুধা ও জাহ্নবাকে বিবাহ করলেন (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গৌরীদাস বিবাহ করেননি)। সূর্যদাসের মন্দির অঙ্গনটি গৌরীদাসের মন্দিরের অনতিদূরেই অবস্থিত। এখানে শ্যামসুন্দর ও নিতাই-গৌরের সুন্দর বিগ্রহ মন্দির আলো করে অবস্থান করছে। মন্দিরের ঠিক বিপরীতেই রয়েছে সেই কুলগাছতলা, যেখানে নিত্যানন্দ মহাপ্রভু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। আজও ইতিহাস সাক্ষী হয়ে আছে। জনশ্রুতি শোনা যায় যে, বিবাহযোগ্যা কোনও মেয়ে এই স্থানে ভক্তিসহকারে প্রণাম করলে অনতিবিলম্বেই তার বিবাহ সম্পন্ন হয় এবং সুখী হয়।
ঐতিহ্যময় কালনা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পাদস্পর্শে ধন্য হয়েছে।ভাগীরথী নদী ইতিহাস-সাক্ষী হয়ে নীরবে বয়ে চলেছে। চৈতন্যদেবের বাণী আজকের দিনেও চিরন্তন হয়ে কালনা বাসীর মনের মণিকোঠায় সযত্নে রয়েছে।
নাম-ই ব্রহ্ম, নামগানেই মুক্তি
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ
কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম
রাম রাম হরে হরে।
[তথ্যসূত্র: কালনার জনশ্রুতি ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার: বৈষ্ণব তীর্থ অম্বিকা কালনা (অরুণ শীল)]