এই মন্দিরে শায়িত স্বয়ং বলরামের মৃতদেহ!

তুফানগঞ্জ মহকুমার চিলাখানা মৌজায় ঘোগারকুটি গ্রামে গদাধর নদীর পাশেই অবস্থিত দরিয়া বলাইয়ের দেবালয়। আনুমানিক অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি এই দেবালয়টি নির্মিত হয়। মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা কে, তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও ঐতিহাসিক প্রমাণ, তথ্য এবং গ্রন্থের বর্ণনা থেকে জানা যায় মহারাজ উপেন্দ্রনারায়ণের (১৭১৪-১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্বকালে নাজির দেও শান্তনারায়ণ এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং পুজো-অর্চনার ব্যবস্থাও করেছিলেন। এক সময় এই মন্দির দেবোত্তরের অধীনে থাকলেও বর্তমানে স্থানীয় লোকজন কমিটি করে মন্দিরটি পরিচালনা করেন। 'দরিয়া' কথার অর্থ নদী এবং 'বলাই' অর্থে বলরাম। এককথায় নদীর তীরে বলরাম। বলরাম ঠাকুরের নামানুসারে ওই এলাকার নাম 'দরিয়া বলাই' বা বলরামের ধাম।

 

লোকশ্রুতি অনুযায়ী এবং মন্দির প্রাঙ্গণের সামনের অঙ্কিত চিত্রের বর্ণনা অনুযায়ী, আজ থেকে অনেক অনেক বছর পূর্বে বাবা বলরাম লাঙল দিয়ে জমিতে চাষ করেছিলেন। দীর্ঘক্ষণ রোদে মাঠে চাষ করার ফলে তার প্রচণ্ড তেষ্টা পায়। তৃষ্ণা নিবারণের জন্য তিনি তার স্ত্রীকে হাতের পান্তির ইশারায় জল আনতে বলেন। হতভম্ব স্ত্রী ভেবেছিল, তার দিকে বলরাম পান্তি তাক করে মারতে আসছেন। ভয়গ্রস্থ হয়ে বলরামের স্ত্রী মুখ ঘুরিয়ে দৌড়তে লাগলেন। স্ত্রীর দৌড়নো দেখে বলরাম তার পিছু নেন। দৌড়নোর সময় বলরামের স্ত্রীর হাত থেকে কলস পড়ে যায় ভুচুংমারি (বলরাম আবাসের নিকটে) এলাকায় ও তৃষ্ণার্ত বলরাম পড়ে যান দরিয়া বলাই এলাকায় এবং সেখানেই বাবা বলরাম দেহত্যাগ করেন। বলরামের হাতের পান্তি গিয়ে পড়ে বর্তমান ধুবুরি জেলার ন্যাতাপোতা ঘাটে (এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের কথা অনুযায়ী)। সেই থেকেই ন্যাতাপোতা ঘাটে অষ্টমী তিথিতে দরিয়া বলাইয়ের অনুকরণে অষ্টমীর স্নান ও মেলা হয়ে আসছে। 

কৃষির দেবতা অসীম বলিয়ান বলরাম ঠাকুর মন্দির গৃহে পূর্ব-পশ্চিমে শায়িত আছেন পাকা দেওয়াল এবং চারচালা পশ্চিমমুখী মন্দিরে। আনুমানিক ১৫ হাত বা তাঁর বেশি দীর্ঘদেহী লম্বা পাথরের মূর্তি, পূর্বে মাটির মূর্তি ছিল। হাতে রয়েছে একটি লাঙল ও জোয়াল। পূর্বে নিত্যপুজো হত এই দেবতার, কিন্তু বর্তমানে আর্থিক দুরবস্থার জন্য বিশেষ তিথিতে শুধুমাত্র পুজো হয়। এছাড়া কোনও পুণ্যার্থীর বিশেষ মানত উপলক্ষেও এখানে পুজো হয়। দোলসোয়ারি, অষ্টপ্রহর, রাধাষ্টমীতে এখানে পুজো হয় স্থানীয় কমিটির তত্ত্বাবধানে। এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে এবং কৃষক সমাজের কাছে এই দেবতা শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হয়‌।

আরও পড়ুন: মথুরা-বৃন্দাবন নয়, এই বাংলাতেই রয়েছে শ্রীকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র

বলরাম ঠাকুরের বিশেষ আকর্ষণ হল চৈত্র মাসে অষ্টমী তিথি উপলক্ষে এখানে  হাজার হাজার পুণ্যার্থী স্নান করে এবং বাবা বলরামের দর্শনে পূর্ণতা লাভ করে। প্রচলিত ছোট অষ্টমীর স্নান বা গদাধরের মেলা উপলক্ষে এখানে বিরাট মেলা বসে। ভোর থেকেই স্নান শুরু হয়‌। স্নানাদির পরে বাতাসা, ফুল ,জল দিয়ে মন্দিরে পুজো করে ভক্তরা। তারপরে কাদামাটির ঢেলা করে তুলসী গাছ পুঁতে দেওয়া হয় এবং ফুল, জল দিয়ে বাবা বলরামের উদ্দেশে পুজো দেয়। পুজোর পর দই-চিড়া খাওয়া হয়।তীর্থযাত্রী দই-চিড়া নিয়ে আসে। পাঁঠা, কবুতর, হাঁস প্রভৃতি উৎসর্গ করেন অনেক তীর্থযাত্রী। তিনদিনব্যাপী এই মেলা চলে।গদাধরের জলে ডুব দিয়ে সখা ও সখী পাতানোর ব্যবস্থা আছে।একই বয়সের ছেলে বা মেয়ে ও বয়স্ক ব্যক্তি যৌথভাবে গুয়া পান হাতে নিয়ে ডুব দিয়ে উঠলে তারা দু'জনে সখা ও সখীতে পরিণত হয়। তুলসীতলায় গুয়া ও পান হাতে নিয়ে ভাবি, সখা ও সখীরা বসবে। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি আম্রপল্লব দিয়ে ওদের মাথায় জল ছিটিয়ে দিবে। সখা বা সখীরা তাদের বাবা-মাকে তাওয়াই বা মাওয়াই  বলে ডাকে। প্রচুর ভক্তসমাগম হয় এবং বিশেষ করে অসম থেকে প্রচুর লোক এই মেলায় অংশগ্রহণ করে। লোকমুখে প্রচলিত, স্নানপর্বে বাবা বলরামের কাছে কোনও কিছু লবণ দিয়ে মানত করলে পূর্ণ হয়। হিন্দু, বিশেষ করে রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ মৃত পিতৃপুরুষদের স্বর্গলাভের আশায় সংরক্ষিত অস্থি গদাধরের জলে ক্ষেপণ করে। ক্ষৌরকাজের দ্বারা মস্তক-মুণ্ডন করে এবং ব্রাহ্মণের মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে তর্পণ করে‌।
ভক্তদের বাতাসা, উৎসর্গের প্রাণীতে ভরে যায় মন্দির। কেউ কেউ দাতব্য দ্রব্য, সোনা, রূপো উপহার ইত্যাদি প্রণামী উপহার দেয়। মন্দির কর্তৃপক্ষ নিজের সেবার জন্য কিছু রেখে বাকি জিনিসগুলি বিক্রি করে দেন। পূর্বে এপার-ওপার সংযোগের জন্য বাঁশের মাচা তৈরি করা হত। বর্তমানে নদীর ওপর সেতু নির্মিত হওয়ায় যোগাযোগ নতুন মাত্রা পেয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা গজেন বর্মন বলেন, ১৯৬০-'৬২ সালের বিধ্বংসী বন্যায় বাবা বলরামের শিলাবিগ্রহ, রুপোর ষাঁড়, রাধাগোবিন্দের সোনার বিগ্রহ, কাঁসার ঘণ্টা চুরি হয়ে যায় বর্তমান পুরোহিত যতীন্দ্রনাথ দেবশর্মা, বংশপরম্পরায় এখানে পুজো করে আসছেন। দেউড়ি হিসেবে আছেন মনো বর্মন। মন্দির পরিচালনা কমিটির অন্যতম কর্তা অমল বর্মন বলেন, ২২ কাঠা জমির ওপর এই মন্দির ও প্রাঙ্গণ এবং অনেকটাই খোলামেলা জায়গা এবং জায়গাগুলো সংরক্ষণ এবং পরিচর্যার জন্য সরকারি সাহায্যের বিশেষ প্রয়োজন। মন্দির পরিচর্যা, পূজা-অর্চনা এলাকাবাসীর সক্রিয় সহযোগিতায় সম্পন্ন হয়। পুরোহিত এবং দেউড়ির বাৎসরিক যৎসামান্য বেতন মন্দিরের এবং বিভিন্ন অনুদান থেকে দেওয়া হয়। আরেক অধিবাসী, গুমানাথ বর্মনের পৌত্র শিবনাথ বর্মন বলেন, মন্দিরের কিছু জায়গা তার পূর্বপুরুষ পশুনাথ বর্মন দান করেছিলেন।

ঐতিহাসিক স্মৃতি বহন করা এই মন্দির একপ্রকার অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। বিশেষ বিশেষ তিথিতে এর জৌলুস ফিরলেও পাকাপাকিভাবে এর পরিচর্যা এবং সংরক্ষণ না হলে অদূর ভবিষ্যতে এই মন্দির ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবে।

More Articles