বিধানসভায় হাতাহাতি শাসক বিরোধীর, বাংলার লজ্জার ট্র্যাডিশন চলছেই

রামপুরহাট গণহত্যা কাণ্ড নিয়ে আলোচনার মাঝেই নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী হল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা। বিধানসভার বাজেট অধিবেশনের শেষ লগ্নে রামপুরহাট-বগতুই কাণ্ড নিয়ে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন তৃণমূল ও বিজেপি বিধায়করা। 

রামপুরহাট গণহত্যা কাণ্ডে সরকারের ব্যর্থতা ও শাসক দল তৃণমূলের অভিযুক্ত থাকার অভিযোগে বিধানসভার ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন বিজেপি বিধায়করা। সিটের ব্যর্থতা ও মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে ও সরব হয় বিজেপি। সোমবার অধিবেশন চলাকালীন স্পিকার বিমান বন্দোপাধ্যায় বিজেপি বিধায়কদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘ আপনারা গত কয়েকদিন ধরে অধিবেশনের কাজ চালাতে সমস্যা তৈরি করেছেন।স্লোগান দিয়েছেন, চিৎকার করেছেন। ওয়াক আউট করেছেন।পুলিশ বাজেটে ও আপনারা উপস্থিত থাকেননি’। এরপরেই ওয়েলে নেমে প্রতিবাদ শুরু করেন বিজেপি বিধায়করা।এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল বিধায়কদের সঙ্গে হাতাহাতি হয় তাঁদের। বিজেপি বিধায়কদের সঙ্গে অশান্তিতে আহত হন তৃণমূল বিধায়ক অসিত মজুমদার। অন্যদিকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর দাবি, বিজেপি বিধায়কদের চশমা ভেঙে গিয়েছে। আহত হয়েছেন বিজেপি বিধায়ক মনোজ টিজ্ঞা। গোটা ঘটনায় বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী, মনোজ টিগগা, নরহরি মাহাত, শংকর ঘোষ, দীপক বর্মণকে সাসপেন্ড করার প্রস্তাব আনে তৃণমূল। সেই প্রস্তাবে সায় দিয়ে বিজেপির পাঁচ বিধায়ককে সাসপেন্ড করেন বিধানসভার অধ্যক্ষ। দীর্ঘ কয়েক দশকের রাজনৈতিক সংবাদদাতা জয়ন্ত ঘোষালের মতে, ‘পশ্চিমবঙ্গে এই ঘটনা প্রথম নয়। চিত্তরঞ্জন দাশের আমলে পুরসভাতে ও এই ধরনের অশান্তি হত। কিন্তু মাঝখানে এসব আর হয়নি। এই ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয়। শাসক এবং বিরোধী দুইদলের কাছেই নাগরিক দাবি থাকে উন্নয়ন, শিল্প, চাকরি। সেখানে এই নৈরাজ্যের ঘটনা রাজ্যের ভাবমূর্তিকেই কলঙ্কিত করবে। এপ্রিলেই বিশ্ব বাংলা সন্মেলন। সেখানে একাধিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা আছে। এই পরিস্থিতি দেখলে কোনও শিল্পগোষ্ঠী বিনিয়োগে রাজি হবে না যা আখেরে আমাদের ক্ষতি। সরকার-বিরোধী উভয়কেই এই বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে’।

কিন্তু বিধানসভার ইতিহাসে এই শাসক- বিরোধী অশান্তি, ভাঙচুর নতুন নয়। অতীতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা এই ঘটনার সাক্ষী থেকেছে।

২০০৬ সালে তৃণমূলের বিধানসভা ভাঙচুর

২০০৬ সালে সিঙ্গুরে টাটার জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে সরগরম পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য-রাজনীতি। ২০০৬ এর ৩০ নভেম্বর তৎকালীন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুর যেতে চাইলে তাঁকে পথে পুলিশ ফিরিয়ে দেয়। তারপরেই সোজা বিধানসভায় চলে যান মমতা। সেখানে বিধানসভায় ঢোকার সময় মমতার সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীদের একপ্রস্থ ধস্তাধস্তি হয়। দলনেত্রীকে আটকানোর ঘটনায় দ্রুত মেজাজ হারান তৃণমূল বিধায়করা। সেদিন শুভেন্দু অধিকারী ও রাজীব বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বিধানসভায় ভাঙচুর চালায় তৃণমূল কংগ্রেস। সেই ঘটনায় কংগ্রেসের এক বিধায়ককে শ্লীলতাহানি করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। আক্রান্ত হন সিপিএমের জাহানরা খান। বিধানসভার প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরতে সেদিন বিধানসভার দরজা সাধারণের জন্য খুলে দিয়েছিলেন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম। যদি ও পরবর্তীকালে এই ঘটনায় জড়িয়ে থাকার কথা অস্বীকার করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

২০১২ সালে বিধানসভায় বাম- তৃণমূল দ্বন্দ্ব

২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর সিপিএম- তৃণমূল অশান্তিতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা। সিপিএমের দেবলীনা হেমব্রমের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়েন তৃণমূলের মাহামুদা খাতুন।এরপরেই ঘটনা গড়ায় হাতাহাতিতে। দেবলীনা হেমব্রমকে শারীরিক হেনস্থার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। তাঁর পেটে ঘুসি মারা হয়। এই ঘটনায় আহত হন সিপিএম বিধায়ক গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়। হাতাহাতিতে চোয়াল ভেঙে যায় তাঁর। তৃণমূলের তরফে আক্রান্ত হন বিধায়ক ধীমান রায়। গোটা ঘটনায় স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় তিন বাম বিধায়ককে সাসপেন্ড করেন।

২০১৭ সালে বাম- কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের বচসা 

২০১৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। সম্পত্তি ভাংচুরের বিহিতের জন্য বিধানসভায় বিল পেশ হয়। সেই বিল নিয়ে আলোচনার মাঝেই শাসক তৃণমূল ও বিরোধীদল বাম- কংগ্রেসের ঝামেলা শুরু হয়। বিধানসভা ভাঙচুরের ছবি নিয়ে বিধানসভায় আসেন বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান। বিরোধী দলনেতাকে স্পিকার ছবি সাঁটানো পোস্টার খুলে ফেলতে বলেন। বিলের বিরোধিতা করে নোটিশ দেন আব্দুল মান্নান। মান্নানের নোটিশ খারিজ করেন অধ্যক্ষ। এরপরেই স্পিকারের ন্যায়দণ্ড তুলে নেন কংগ্রেসের মনোজ চক্রবর্তী। হাঙ্গামা শুরু হয় বিধানসভার ভেতরে। গোটা ঘটনায় আব্দুল মান্নানকে দায়ী করে তাঁকে সাসপেন্ড করেন অধ্যক্ষ। এই পরিস্থিতির মধ্যেই বিধানসভায় বিল পেশ করেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়।

More Articles