গাজার পর লেবাননেও 'মারণ' ফসফরাস হামলা! যে ভয়ঙ্কর অভিযোগ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে
Phosphorus Attack on Lebanon: বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, এই সাদা ফসফরাস অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলেই রাসায়নিক বিক্রিয়া করে ৮১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপ উৎপন্ন করতে পারে। যা মারাত্মক ভাবে পুড়িয়ে দিতে পারে ত্বক।
প্রায় ৬ মাস ধরে লেবাননে ফসফরাস বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। ফের ভয়াবহ অভিযোগে কাঠগড়ায় ইজরায়েল। ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ ৬ মাস পার করে গিয়েছে। এই ছ'মাসে মৃত্যুর সংখ্যা ছাপিয়ে গিয়েছে ৩৪ হাজার। এরই মধ্যে ইরানের সঙ্গে সংঘাত জোরালো হয়ে উঠেছে ইজরায়েলের। দিন কয়েক আগে ইজরায়েলে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়েছে ইরান। সপ্তাহ না ঘুরতেই তার পাল্টা উত্তর দিয়েছে ইজরায়েল। আকাশপথে তারা হামলা চালিয়েছে ইরানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ইসফাহানে। এই সংঘাতে ইরানকে প্রচ্ছন্ন ভাবে মদত দিয়েছে লেবাননে জঙ্গিগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের জঙ্গিগোষ্ঠী হাউথি ও প্যালেস্টাইনের সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী হামাস।
হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ লাগার পর থেকেই হিজবুল্লাহের সঙ্গে সংঘাত বেড়ে ওঠে ইজরায়েল। মধ্যিখানে ইজরায়েলের উত্তরে হামলা চালায় হিজবুল্লাহ। তাতে ১৪ জন ইজরায়েলি সেনা জখম হয়েছিল বলে খবর। তবে এ কোনও পৃথক ঘটনা নয়। লেবাননের সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরেই অশান্তি লেগে রয়েছে ইজরায়েলের। হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে দেওয়ার পর পর গাজায় ফসফরাস বোমা ব্যবহার করার অভিযোগ উঠল ইজরায়েলের বিরুদ্ধে। এবার তেমনই হামলা দক্ষিণ লেবানন সীমান্তের উপর লাগাতার চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে নালিশ করা হয়েছে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন: ইরানকে হামলার জবাব ইজরায়েলের, নেতানিয়াহুর হাতে রাফাহ দিয়ে যুদ্ধ থামাতে পারবেন বাইডেন?
আন্তর্জাতিক আইনে এই ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা ও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তবে গাজায় সেই নিয়ম মানেনি ইজরায়েল। একই ভাবে সেই নিয়ম মানা হয়নি লেবাননের সশস্ত্র জঙ্গিদের বিরুদ্ধেও। বিশ্বের একাধিক দেশ এর জন্য ক্ষুব্ধ ইজরায়েলের উপর। তবে নিজেদের দেশের উপর কোনও রকম আঘাতের শঙ্কাটুকুও এলে যে সমস্ত নীতি-নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ভয়াবহ কাণ্ড ঘটাতে পারে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সেনা, তা এতদিনে গোটা বিশ্ব জেনে গিয়েছে। একাধিক মানবাধিকার সংস্থার দাবি, ইজরায়েলের এই ফসফরাস হামলার বিরুদ্ধে যুদ্ধোপরাধের তদন্ত প্রয়োজন। এমনিতেই গাজায় গণহত্যার মামলায় আন্তর্জাতিক আদালতে কোণঠাসা হয়েছে ইজরায়েল। তবে তা দমাতে পারেনি ইজরায়েলি আগ্রাসনকে।
কী এই সাদা ফসফরাস। এ আসলে এমন এক রাসায়নিক পদার্থ, যা অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলেই পুড়ে যায়। আর্টিলারি শেল, বোমা ও রকেটেও এই ধরনের পদার্থের ব্যবহার দেখা যায়। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, এই সাদা ফসফরাস কোনও ভাবে অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলেই রাসায়নিক বিক্রিয়া করে ৮১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপ উৎপন্ন করতে পারে। বিষাক্ত এই গ্যাস মারাত্মক ভাবে পুড়িয়ে দিতে পারে ত্বক। চোখ এবং ফুসফুসেরও ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারে এর প্রভাবে। সাদা ফসফরাস ব্যবহার করে বিধ্বংসী আগুন তৈরি করা সম্ভব, যা এক নিমেষে পুড়িয়ে দিতে পারে একের পর এক ঘর-বাড়ি, বহুতল। এই সাদা ফসফরাস উপযুক্ত পরিমাণে ব্যবহার হলে তা মানবদেহের হাড় পর্যন্ত পুড়িয়ে দিতে পারে। বিশেষজ্ঞেরা জানান, সাদা ফসফরাসের জেরে কোনও মানুষের শরীরের দশ শতাংশও পুড়ে যায়, তা-ও ভয়ানক হতে পারে। সাদা ফসফরাসের সংস্পর্শে এলেই শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে দেয় মানুষের।
ফলে এই ভয়াবহ যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার নিয়ে আন্তর্জাতিক আইনের বেশ কিছু কড়াকড়ি রয়েছে। কনভেনশন অন কনভেনশন উইপনস (সিসিডব্লিউ) এর প্রোটোকল ৩ অনুযায়ী, কোনও জনগোষ্ঠী বা অসামরিক এলাকায় এই সাদা ফসফরাস ব্যবহার নিষিদ্ধ। এই ধরনের রাসায়নিক স্ক্রিনিং এবং চিহ্নিতকরণ ছাড়া অন্য কোনও কারণে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ সেই সব নিয়মের পরোয়া না করেই নাকি লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে একাধিক বার সাদা ফসফরাস বোমা ফেলেছে ইজরায়েল।
ইজরায়েলের ঘনিষ্ঠতম মিত্র দেশ আমেরিকা। যে কোনও পরিস্থিতিতেই নেতানিয়াহুর সঙ্গে যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রয়েছেন, তা বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন বাইডেন। লেবাননে ফসফরাস বোমা হামলা নিয়েও পরোক্ষ ভাবে ইজরায়েলেরই পক্ষ নিয়েছে আমেরিকা। ওই দুই দেশে আদৌ ইজরায়েল ওই রাসায়নিক ব্যবহার করেছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে জো বাইডেন সরকার।
দক্ষিণ লেবাননের একাধিক বাসিন্দার কথায় প্রমাণ মিলেছে ইজরায়েলের সাদা ফসফরাস ব্যবহারের। দক্ষিণ লেবাননের স্থানীয় কৃষক ৪৮ বছর বয়সী আলি আহমেদ আবু সামরা জানান, ২০২৩ সালে একবার সাদা ধোঁয়ার মেঘের মধ্যে পড়ে যান তিনি। তীব্র রসুনের মতো বা তার চেয়েও খারাপ একটা গন্ধ অনুভব করেছিলেন তিনি। যা নাকি নিকাশি লাইনের গন্ধের চেয়েও ভয়ঙ্কর। চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়ছিল আলির। কোনওমতে ভেজা কাপড়ে নাক-মুখ চেপে রেহাই পান। নাহলে হয়তো মৃত্যুই অবধারিত ছিল আলি আহমেদের। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সূত্রের খবর, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত লেবাননের অন্তত চারটি শহর ও গ্রামে একাধিক বার সাদা ফসফরাস হামলা চালিয়েছে ইজরায়েলি সেনা।
গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই লেবানন সীমান্তেও বারবার হামলা চালিয়ে গিয়েছে। হামাসকে গোড়া থেকেই সমর্থন করে এসেছে লেবাননের জঙ্গিগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। আর এই হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর হাতে রয়েছে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রের শক্তি। যা হামাসকে আরও শক্তিশালী করছে বলে অভিযোগ ইজরায়েলের। ইজরায়েলের প্রতিটি হামলাকে দাপটের সঙ্গে মোকাবিলা করেছে হিজবুল্লাহ। প্রায়শই ইজরায়েলে পাল্টা হামলাও চালিয়ে বসেছে তারা।
আরও পড়ুন:নেতানিয়াহুর হুমকির পরেই ইরানে জারি রেড অ্যালার্ট! কোন দিকে যাচ্ছে ইজরায়েল-ইরান অশান্তি?
তবে তাতে ইজরায়েলের এই সাদা ফসফরাস হামলার 'সাত খুন' মাফ হয়ে যায় না মোটেও। লেবাননে লাগাতার এই রাসায়নিক হামলার খবর প্রকাশ্যে আসতেই ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দ্বিগুণ করেছে বিশ্বের সমস্ত সংবেদনশীল দেশগুলি। অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশানাল জানিয়েছে, ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধোপরাধের তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তবে আদৌ সেই তদন্তও কি বশে আনতে পারবে ইজরায়েলের আগ্রাসন। হামাস থেকে শুরু করে ইরানের হামলা, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই যুদ্ধ জারি রাখার এক অদমনীয় ভঙ্গি দেখা গিয়েছে ইজরায়েলের মধ্যে। এখনও পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে আগ্রাসী সরকার সম্ভবত বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরকার। আর তিনি যে কোনও মতেই হার মানার পক্ষে নন, তা একাধিক বার বুঝিয়ে দিয়েছে ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী।