'মহামেডান' বলেই আই লিগ জয়েও উদাসীন কলকাতা?
Mohammedan SC I-League: রমজান মাসে মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের আই লিগ চাম্পিয়ন হওয়া এই মুহূর্তে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী রাজনীতির সবচেয়ে বড় জয়।
এরকম অনেক বাঙাল দেখেছি কট্টর মোহনবাগানি। ঘটি ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টারও কিছু কম নেই। কিন্তু পদবি হিন্দু অথচ মহামেডান স্পোর্টিংয়ের সাপোর্টার, এ ঘটনা বিরলের মধ্যেও বিরল। ফুটবলের আবার হিন্দু-মুসলমান কী! এই বলে যাঁরা বিরক্ত বোধ করছেন, সেই অসাম্প্রদায়িক ফুটবল প্রেমিকদের অনুরোধ করব সাহিত্যিক এবং কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাততম উপন্যাস শ্রীকান্তর প্রথম অনুচ্ছেদটুকু আর একবার পড়তে। সেখানে আখ্যান শুরুই হয়, বাঙালিদের সঙ্গে মুসলমানদের ফুটবলা খেলা দিয়ে। বাঙালি মননে এই ভাবনা নর্মালাইজড হয়ে যায়, মুসলমান হলে বাঙালি হতে পারে না।
সারা পৃথিবীতে ফিরে আসছে একটা ভাবনা, অথবা বলা যেতে পারে একটা বিরাট ভাবনার সামান্য দুটো শব্দে প্রকাশ- 'এথনিক ক্লিনজিং'। রেমন্ড একটা নতুন পোশাকের ব্র্যান্ড লঞ্চ করেছে, যার নাম এথনিক্স। এই ধাঁচেরই আর একটা অতি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড মান্যবর। কিছু বছর আগেও ভারতের মতো নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলের দেশে ওরকম পোশাক পরে ঘোরাফেরা করলে পাড়ায় বেঞ্চে বসিয়ে তাঁর মাথায় জলটল ঢালা হতো। কিন্তু কী আর করা যায়! সময় যেমন এসেছে! এখন সংখ্যাগুরুকে বোঝানো গেছে, কোনও এক সুদুর অতীতে ওরকম প্রাণ হাঁসফাঁস করা পোশাক পরেই সকলে দৈনন্দিন কার্য চালাতেন। জানতে বড় সাধ হয়, কিনতে যাওয়ার আগে, শোরুমে কেউ প্রশ্ন করেছেন কিনা, এই পোশাক পরে বা খুলে বা তুলে খাঁটি ভারতীয় এথনিক পদ্ধতিতে শৌচ সম্ভব কিনা! আমরা আদিতে এমন ছিলাম, আর ওইরকম থাকাটাই খাঁটি থাকা, তাই আবার ওইরকম হয়ে উঠতে হবে, আর যারা ঠিক ওইরকম নয়, তারা হচ্ছে অপর। এইভাবে অপরকে চিহ্নিত করে, আত্মর নির্মাণ করা এবং আত্মর থেকে অপরের সমস্ত বৈশিষ্ট্য মুছে দেওয়া বা ক্লিন করাই হচ্ছে এথনিক ক্লিনজিং। ফুটবল ঠিক এর উলটো কাজটা করে। আমাদের সংবিধানের যে ভাবনা, তার সারবস্তু রয়েছে ফুটবলে। এখানে একটা টিম তখনই শক্তিশালী টিম, যখন সেই টিম বৈচিত্র্যময়। ইতিহাস বইতে যে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য আমরা নবম শ্রেণিতে পড়তাম, যা ইদানীং কালে আর পড়ানো হচ্ছে না, তার উদাহরণ ফুটবল টিম। একটা ভালো দেশও সেরকমই। সেকারণেই ফুটবল বারবার যে কোনও দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের অন্যতম তারিকা।
আরও পড়ুন- বন্দুকের নলের মুখে অসহায় সাংবাদিক! সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়েছিলেন এই ফুটবলার
দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে পরিচিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন এলাবার্ট লুথিনি। লুথিনি আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নেতা যিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। লুথিনি কর্মসূত্রে থাকতেন নাটালে। নাটালে তখন পরিযায়ী শ্রমিকদের ভিড়। বাড়ির থেকে বহুদূরে, কোনওমতে একটা কাজ জুটিয়ে নিয়ে বেঁচে থাকা, এইসব গরিব পরাধীন মানুষগুলোর একমাত্র মুক্তি ছিল বিকেলের অবসরে ফুটবল খেলা। এই মুক্তির বোধকেই সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত করেন লুথিনি। ফুটবলের লড়াই হয়ে ওঠে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার লড়াই, বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই। একই রাজনৈতিক বিন্যাস দেখা যাবে লাতিন আমেরিকায়। যারা আমাদের দেশে ফুটবল এনেছে, তারাই এনেছে দাসত্ব আর পরাধীনতা। তাদের খেলায় আমরা তাদেরই হারিয়ে দিই। ফুটবল জিতে যাওয়ার আনন্দ পেতে শেখায় ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়াকে, গোটা লাতিন আমেরিকাকে।
তেমনই আমাদের দেশে ১৯১১, মোহনবাগানের শিল্ড জয়। আজ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে ইতিহাস স্কুলে পড়ানো হয়, তাতে মাস্টারদা, ক্ষুদিরামের পাশাপাশি শিবদাস ভাদুড়ির কথাও আছে। কিন্তু নেই ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত টানা মহামেডান স্পোর্টিংয়ের লিগ জয়ের কথা। মুসলমানদের ক্লাব বলেই এই বিস্মরণ। ১৯১১ সালে শিল্ড জয়ের পর মোহনবাগান ক্লাবের কিন্তু পরের দুই দশকে কোনও বড় টুর্নামেন্ট জয় নেই। দেশে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জোয়ার, তাকে ফুটবল মাঠে ভাস্বর করেছে মহামেডান স্পোর্টিং। কিন্তু যতটা কদর এই সাফল্যের প্রাপ্য ছিল, তার ছিটেফোঁটাও জোটেনি। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে তুঙ্গ মুহূর্তেই যদি এই দশা হয়, তাহলে আজকের হিন্দু মহিমান্বিত দেশে মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের আই লিগ জয় কলকাতা শহর উদযাপন করবে কেন? ভদ্রলোক হিন্দু কলকাত্তাইয়া বাঙালি একে জয় না, নিজেদের হার মনে করছে। অথচ রমজান মাসে মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের আই লিগ চাম্পিয়ন হওয়া এই মুহূর্তে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী রাজনীতির সবচেয়ে বড় জয়।
আরও পড়ুন- বন্দুকের নলের মুখে অসহায় সাংবাদিক! সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়েছিলেন এই ফুটবলার
ইদের দিন মুখ্যমন্ত্রী, রেডরোডের জমায়েতে বললেন, বিজেপিকে ভোট না দিয়ে, তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিতে। এরচেয়ে অনেক শ্লীল শুনতে লাগত তিনি যদি একবার মহামেডান স্পোর্টিংকে অভিনন্দিত করতেন। একবার যদি উচ্চারণ করতেন ক্লাবের স্লোগান, 'জান জান মহামেডান'! ওই রেড রোডেই মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের তাঁবুর কাছেই আম্বেদকরের মূর্তি। ইদের ক'দিন পরেই ১৪ এপ্রিল ভীমরাও আম্বেদকরের জন্মদিন ছিল। যে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ভাবনা আমাদের সংবিধানের প্রধান আকর, তার রূপকার আম্বেদকরের জন্মদিনেও, মহামেডান স্পোর্টিংয়ের জয়কে অভিনন্দিত করে আম্বেদকরের প্রতিই শ্রদ্ধা প্রকাশ করা যেত। এই রেড রোডে একটা সময়ে নেটিভ ভারতীয়দের চলাচল নিষিদ্ধ ছিল৷ লড়াই করে সে অধিকার আদায় করা গেছে। সেই লড়াইয়ে ফুটবলের অংশীদারত্ব রাজনৈতিক দলের সমধিক। আজ যখন ভারতে মুসলমান মানুষদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানানোর জিগির তোলা হচ্ছে, তখনও ফুটবল প্রতিরোধ গড়তে পারে। মহামেডান স্পোর্টিং প্রতিরোধের সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়িত করল। জান জান মহামেডান আজ শুধু ক্লাবের স্লোগান নয়, বৈচিত্র্যময় ভারতের স্লোগান। এই বৈচিত্র্য থাকলেই টিম জেতে, এই বৈচিত্র্য থাকলে টিম ইন্ডিয়া জিতবে।