মুসলিমদের অকথ্য অপমান মোদির! প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কেন ব্যবস্থা নেবে না?
Narendra Modi Hate Speech against Muslim: মোদি কি সত্যি কথা বলছেন? কংগ্রেস কি এমন বলেছিল যে সমস্ত সম্পদের উপর মুসলমানদের অধিকার?
দেশের প্রধানমন্ত্রী তিনি! অথচ মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে নোংরা পর্যায়ের ঘৃণা ছড়ালেন মোদি, লোকসভা নির্বাচনের মধ্যেই। দেশে নির্বাচনকালীন আদর্শ আচরণ বিধি চালু রয়েছে। তিনি স্পষ্টত ঘৃণা ছড়িয়ে সেই বিধি ভেঙেছেন। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নিচ্ছে না নির্বাচন কমিশন। দেশের একজন প্রধানমন্ত্রী, তিনি জনসভা থেকে স্পষ্ট মুসলিম মানুষদের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য কথা বলছেন, তালি দিচ্ছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকরা। মোদি বলছেন, কংগ্রেস বলেছে দেশের সম্পত্তির উপর প্রধান অধিকার মুসলিমদের। কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে নাকি, 'ঘুসপেটিয়া'-দের মধ্যে নাগরিকদের সম্পত্তি বিলিয়ে দেবে! এমন ঘৃণা ছড়ানোর পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সোমবার নির্বাচন কমিশনে হাজার হাজার ভারতীয় দু'টি চিঠি পাঠিয়েছে।
চিঠিতে বলা হচ্ছে, "প্রধানমন্ত্রী, ভারতীয় জনতা পার্টির তারকা প্রচারক হিসাবে প্রচার করার সময়, রাজস্থানে গত ২১ এপ্রিল একটি ভাষণ দিয়েছেন যা ভারতের সংবিধানকে শ্রদ্ধা করা লাখো লাখো নাগরিকদের অনুভূতিকে আহত করেছে। মোদির এই ভাষণটি বিপজ্জনক এবং ভারতের মুসলমানদের উপর সরাসরি আক্রমণ।" এই পিটিশনে ২,২০৯ জন ব্যক্তি সই করেছেন।
রবিবার রাজস্থানের ওই জনসভায় মোদি বলেছিলেন, "কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা বলেছিল যে দেশের সম্পদের উপর মুসলমানদের প্রথম অধিকার রয়েছে। এর অর্থ হলো, যাদের বেশি সন্তান আছে এবং যারা অনুপ্রবেশকারী তাদের মধ্যে তারা সম্পদ বন্টন করবে। এটা কি আপনারা মেনে নেবেন?”
আরও পড়ুন- মোদির ‘সঙ্কল্পপত্র’-কে টেক্কা দিতে পারল ‘দিদির শপথ’? ভোটমুখী ইস্তেহারে এগিয়ে কারা?
যারা ওই পিটিশনে সই করেছেন, তারা নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছেন, ভোট চাওয়ার জন্য মোদি যেভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবমাননাকর ভাষা ব্যবহার করেছেন তাতে বিশ্বের কাছে ভারতের গণতন্ত্রের মর্যাদাই ক্ষুণ্ন হয়েছে।" আর নির্বাচন কমিশন যদি প্রধানমন্ত্রীর এই ধরনের ঘৃণাত্মক বক্তব্যের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ না করে জানতে হবে তা কোনও স্বাধীন সংস্থাই না। তা বিজেপি সরকারের পুতুল মাত্র। আদর্শ আচরণবিধি নির্বাচন কমিশন জারি করে। এতে বিবিধ নির্দেশিকা থাকে যা রাজনৈতিক দলগুলিকে ভোটের প্রচারের সময় অনুসরণ করতে হবে। অথচ চোখের সামনে বিধিভঙ্গ করে পার পেয়ে গেলেন মোদি।
এবার প্রশ্ন হলো, মোদি কি সত্যি কথা বলছেন? কংগ্রেস কি এমন বলেছিল যে সমস্ত সম্পদের উপর মুসলমানদের অধিকার? মোদি যে কথাগুলি বলেছেন, তা আসলে কংগ্রেস নেতা মনমোহন সিংয়ের ২০০৬ সালের ৯ ডিসেম্বরের একটি বক্তৃতার মধ্যেকার মন্তব্য। তবে সেই বক্তৃতার কোথাও তিনি এই কথা বলেননি। মোদি বক্তব্য বিকৃত করে পেশ করেছেন। সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছিলেন, দেশের অগ্রাধিকার হচ্ছে তপশিলি জাতি, তপশিলি উপজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি, সংখ্যালঘু এবং মহিলা ও শিশুদের উন্নয়ন করা। "সংখ্যালঘুরা, বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যালঘুরা যাতে উন্নয়নের ফলে সমানভাবে ভোগ করার ক্ষমতা পায় তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের উদ্ভাবনী পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে, তাঁদের সম্পদের প্রথম দাবি থাকতে হবে,” মনমোহন সিং বলেছিলেন। মনমোহন সিং এই মন্তব্য করেছিলেন, প্রাক্তন বিচারপতির অধীনে সরকার-নিযুক্ত প্যানেলের একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যেখানে দেখানো হয়েছিল, ভারতীয় মুসলমানদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাগত অবস্থা যে কোনও জাতি বা সম্প্রদায়ের চেয়ে অত্যন্ত খারাপ।
সংবিধান বাঁচাও নাগরিক অভিযানের আরেকটি চিঠিতে, ১৭,৪০০ জনেরও বেশি মানুষ সই করেছেন। সেই চিঠিতে অভিযোগ করা হয়েছে যে, মোদি নির্বাচনী আচরণ বিধি এবং জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫১ লঙ্ঘন করেছেন। তাঁর বক্তৃতা 'সাম্প্রদায়িক' এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের মধ্যে বিদ্বেষকে উস্কে দেয় এবং হিন্দুদের উত্তেজিত করে।
সংবিধান বাঁচাও নাগরিক অভিযানের চিঠিতে অভিযোগ করা হয়েছে, মোদি মুসলমানদের এমন একটি জনসংখ্যা হিসাবে পেশ করছেন যারা বেশি বেশি শিশুর জন্ম দেয় এবং যারা এই দেশে অনুপ্রবেশকারী। মোদি সম্পূর্ণ মিথ্যা বলছেন কারণ কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহারে কোথাও বলা নেই যে তারা হিন্দু মহিলাদের মালিকানাধীন সোনাদানার তথ্য সংগ্রহ করবে এবং মুসলমানদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে।
দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে একটি বক্তব্যকে বিকৃতিভাবে পেশ করে, নিজেরই দেশের এক বিশেষ ধর্মের নাগরিকদের এমন নোংরা অপমান করার অধিকার তাঁকে কে দিল? কে তাঁকে অধিকার দিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের খেপিয়ে তোলার? তিনি খুব ভালো করেই জানতেন, তাঁর এই বক্তব্য ভাইরাল হবে, তাঁর এই ভিডিও দেশের কোণায় কোণায় মানুষ দেখবে, যাদের ৯৯ শতাংশই খতিয়ে দেখবেই না কংগ্রেসের ইস্তেহারে আসলে কী বলা আছে? তারা মোদির কথায় বিশ্বাস করেই সহনাগরিক মুসলিমদের শত্রু ভাবতে শুরু করবে, ঘৃণা করবে, বিজেপির ভোট বাড়বে, মানুষের লাশ। এবং দেশের নির্বাচন যাতে সুস্থ পদ্ধতিতে হয়, তা যাদের দেখার কথা, সেই নির্বাচন কমিশন কোনও ব্যবস্থাই নেবে না প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। তিনি সমস্ত আইনের উর্ধ্বে!
আরও পড়ুন- রাজনৈতিক দলগুলির ইস্তেহার কতটা ভরসাযোগ্য, ফাঁকগুলি কী কী?
অন্যদিকে বিরোধী কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধিকে নিয়ে ভুয়ো ভিডিও ছড়ানো হচ্ছে যেখানে তাঁর গলায় বলানো হচ্ছে, বিজেপি দেশকে জুড়তে চাইছে আর কংগ্রেস ধর্মের ভাগে, জাতের ভাগে ভাগ করছে। অর্থাৎ বিজেপির তরফে ঘৃণা ছড়ানোর কোনও অস্ত্রই ব্যবহার বাদ রাখা হচ্ছে না। রাজস্থানের স্থানীয় নির্বাচন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মোদির বিরুদ্ধে কমপক্ষে দু'টি অভিযোগ জমা পড়েছে যেখানে তাঁর নির্বাচনী প্রচার স্থগিত করার এবং তাঁকে গ্রেফতারের দাবি উঠেছে।
মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি অর্থাৎ বিজেপি দীর্ঘদিন ধরেই দেশের ২০০ মিলিয়ন মুসলমানকে 'বহিরাগত' হিসাবে চিত্রিত করে আসছে। তাঁদের মূল লক্ষ্যবস্তু বাংলাদেশ ও মায়ানমার থেকে আসা মুসলিম শরণার্থীরা। বিজেপি এবং এর বন্ধু শক্তিরা দীর্ঘকাল ধরে একটি তত্ত্বকে সামনে আনছে যেখানে বলা হচ্ছে, ভারতীয় মুসলমানরা শেষ পর্যন্ত সংখ্যায় দেশের হিন্দুদেরও ছাড়িয়ে যাবে, তাই আরও বেশি করে সন্তান উৎপাদন করে তারা। বাস্তবে, সরকারি তথ্যই বলছে, অন্য সব সম্প্রদায়ের মধ্যে ভারতে মুসলিমদের উর্বরতার হার দ্রুত গতিতে কমছে এবং গত তিন দশকে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে।
মোদি নিজেই এই নোংরা প্রচার বহুকাল ধরেই কছেন। ২০০২ সালে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। মুসলিম বিরোধী সেই ভয়াবহ দাঙ্গার পরে বলেছিলেন, ত্রাণ শিবিরগুলি বাচ্চা উৎপাদনের কারখানা। ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পরেও তাঁকে ঘৃণাকেই ব্যবহার করতে হচ্ছে ভোট পেতে। এখনও যদি এই ঘৃণাকে মানুষ ছুড়ে না ফেলে দেয়, গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক শুধু সময়ের অপেক্ষা।