কুবেরও লজ্জা পাবে অনুব্রতর দেহরক্ষীর সম্পত্তি দেখে! কেষ্টর গ্রেফতারের নেপথ্যে

অনুব্রতর দেহরক্ষীর যে সম্পত্তির খতিয়ান সামনে এসেছে, তাতে যে কেউ ভিরমি খেতে পারেন। আর এক্ষেত্রে মমতার 'আদরের কেষ্টা'-র নাম জড়িয়ে যাওয়ায়, তা যে দিদির পক্ষে অস্বস্তিকর, তা বলাই বাহুল্য।

অনুব্রত মন্ডল গ্রেফতার। কিন্তু এর সলতে পাকছিল সায়গল হোসেনের গ্রেফতারি থেকেই। ২০১০ সালে কনস্টেবল পদে চাকরি। পরে অনুব্রত মন্ডলের দেহরক্ষী। সায়গল হোসেন। তাঁর বাবার মৃত্যুতেই তিনি এই চাকরি পান। এরপর কিছুদিন মুর্শিদাবাদে সুতিতে কর্মরত ছিলেন সায়গল হোসেন। একজন সরকারি কর্মচারী হয়ে কীভাবে এই বিপুল সম্পত্তি করলেন সায়গল? এর কারণ যাই-ই হোক, তা নিয়ে তদন্ত চলবে। তবে তাঁর সম্পত্তির বহর শুনলে যে-কোনও আম-নাগরিক ভিরমি খেতে পারেন। যেমন চক্ষু চড়কগাছ হয়েছিল সিবিআইয়ের।

প্রথম চমক, কলকাতায় পরিচারিকার নামে ফ্ল্যাট। কীভাবে তাঁর এই উত্থান? সেটাই ভাবাচ্ছে তদন্তকারীদের। প্রথমে দেখা যাক তাঁর সম্পত্তি কোথায়, কীভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। কেনই বা সিবিআই কর্তাদের চোখ ছানাবড়া!

আয়ের সঙ্গে সংগতিবিহীন সম্পত্তির অভিযোগে এর আগে তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা অনুব্রত মন্ডলের দেহরক্ষী সায়গল হোসেনকে গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। তল্লাশিতে নেমে রীতিমতো কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে পড়ার উপক্রম। যার পরিণতিতে গ্রেফতার হলেন অনুব্রত। 

আরও পড়ুন: বঙ্গ বিজেপির কাহিল অবস্থা বেআব্রু সংঘের রিপোর্টে, বড় বিপদ অপেক্ষা করছে?

পরিচারিকার নামে ফ্ল্যাট
সিবিআই সূত্রের খবর, নিউটাউনে সায়গল হোসেনের তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে৷ যার মধ্যে ২টি ফ্ল্যাট সায়গলের স্ত্রীর নামে এবং আরেকটি পরিচারিকার নামে৷ তিনটি ফ্ল্যাট থেকে তল্লাশি চালিয়ে কয়েক কোটি টাকার সোনার গয়না বাজেয়াপ্ত করেছেন তদন্তকারীরা৷ একই সঙ্গে উদ্ধার হয়েছে প্রচুর পরিমাণ সম্পত্তি৷ রাজ্য পুলিশের একজন সাধারণ কর্মী হয়ে কীভাবে এত বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হলেন সায়গল, তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা৷ সেই সূত্রে উঠে এসেছিল অনুব্রত মন্ডলের নামও৷ 

মিলেছে ২০ কেজি সোনা
তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মন্ডলের দেহরক্ষী সায়গল হোসেনের নামে-বেনামে বিপুল সম্পত্তির হদিশ পেল সিবিআই। ডোমকলের আদি বাড়ি ছাড়াও নিউটাউনের মতো জায়গায় একাধিক ফ্ল্যাট, গাড়ির পাশাপাশি মিলেছে ২০ কেজি সোনা। মিলেছে নগদ কয়েক লক্ষ টাকাও।

রয়েছে রিসর্ট ও পেট্রোল পাম্প
সায়গলকে জেরা করে সিবিআই দাবি করেছে, রাজ্য পুলিশের এই কনস্টেবলের রিসর্ট, পাথর ক্র্যাশার, পেট্রোল পাম্প পর্যন্ত রয়েছে বলেও তারা খবর পেয়েছে। ৯ জুন রাতভর তল্লাশি চালিয়ে নিউটাউনের ফ্ল্যাট ও অন্যান্য জায়গায় হানা দিয়ে এই বিপুল পরিমাণ সোনা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বলে সিবিআই জানিয়েছে। সায়গলের নামে-বেনামে থাকা এই ফ্ল্যাটগুলির পাশাপাশি উদ্ধার হওয়া এই সোনা কেনার অর্থের উৎস নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে তারা। যদিও সায়গলের আইনজীবীদের দাবি, বৈধভাবে কেনা এই সোনার নথি ঠিক সময়ে আদালতে জমা দেবেন তাঁরা।

প্রচুর জমির দলিল
সায়গলের নামে-বেনামে প্রচুর জমির দলিলও মিলেছে। এতে নাকি তাঁর আত্মীয়দের নামও জড়িত। সিবিআই সূত্রে খবর, তাঁর আয়ের সঙ্গে বেতনের কোনও সামঞ্জস্য নেই। এর আগে গরুপাচার মামলায় বিএসএফ আধিকারিক সতীশ কুমার এবং এনামুল হককে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। অভিযোগ, এনামুল হকের সঙ্গে সায়গলের ফোনে কথোপকথনও কল লিস্টে দেখা গিয়েছে।

সম্পত্তির উৎস
সিবিআই সূত্রে খবর, গরুপাচারে মূল অভিযুক্ত এনামুল হক বীরভূম এলাকা থেকে কর্মকাণ্ড চালাতেন বলে সিবিআইয়ের কাছে দাবি করেন। ফলে সেখান থেকে বেআইনি টাকার মাধ্যমে লেনদেন চলত! কিছুদিন আগে সিবিআই তল্লাশি করে তাঁর বাড়িতে। এত সম্পত্তি, আর্থিক লেনদেন, এসবের উৎস কোথায়?  সেই টাকায় বেআইনি সম্পত্তি? সায়গলের সম্পত্তির উৎসের সঙ্গে আয়-ব্যয়ের বিস্তর ফারাক। সদুত্তর নেই সায়গলের। সেই কারণেই গ্রেফতার করা হয়, দাবি সিবিআইয়ের। শনিবার আসানসোল সিবিআই স্পেশাল আদালতে পেশ করা হয় সায়গলকে। সেখানে সিবিআই হেফাজতের জন্য আবেদন করা হয়। তাঁকে হেফাজতে নিলে এই মামলায় গুরুত্বপূর্ণ সূত্র মিলবে বলে দাবি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার।

উত্থানের নেপথ্যে?
প্রথম থেকেই সায়গল হোসেনের এত প্রতিপত্তি বা তাঁর উত্থান লক্ষ করা যায়নি। এমনটাই মত অনুব্রত-ঘনিষ্ঠদের। তবে ছবিটা বদলাতে শুরু করে ২০১৬ থেকে। তখন থেকেই কার্যত অনুব্রতর ছায়াসঙ্গী হিসেবে সর্বত্র দেখা যেতে থাকে সায়গল হোসেনকে। আর তারপরই তাঁর এই উত্থান।

বর্তমানে অনুব্রতর প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক সমস্ত কাজের তদারকি করতেন সায়গল হোসেন। তাঁর ফোন দ্বারাই পরিচালিত হতো সবটা। বিরোধীদেরও অভিযোগ, বীরভূমের সব কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতেন সায়গল হোসেন। এখন, সায়গল হোসেনেরও কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি আছেন, যাঁদের ওপরেও সিবিআই-এর নজর রয়েছে বলে সূত্রের খবর। স্বাভাবিকভাবেই সায়গল হোসেনের গ্রেফতারি বীরভূম জেলার ব্যবসায়িক মহলে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে।

কেষ্টা মাথায় হাত রাখতেই সায়গল ফুলে-ফেঁপে ওঠেন। এমনটাই তদন্তে নেমে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। রাজ্য পুলিশের কনস্টেবল পদে কর্মরত সায়গল হোসেনের বাড়ি ডোমকল পুরসভা এলাকার ১২ নম্বর ওয়ার্ডে। স্থানীয়দের দাবি, তাঁর বাবাও পুলিশের এসআই হিসাবে কর্মরত ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর পুলিশে চাকরি পেয়েছিলেন সায়গল।

কিন্তু অনুব্রতর রক্ষী নিযুক্ত হওয়ার পরই তাঁর অবস্থা বদলাতে শুরু করে। সায়গলের স্ত্রী প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পান। আত্মীয়দের নামেও সায়গলের একাধিক সম্পত্তি রয়েছে বলে অভিযোগ। সিবিআই সূত্রের দাবি, অনুব্রত কোথায় যেতেন, কাদের সঙ্গে দেখা করতেন, সেখানে কী কথা হত, তা নিয়ে সায়গলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলতে পারে।

গরুপাচার-কাণ্ডে ধৃত সায়গল হোসেনের ১৭ জুন পর্যন্ত সিবিআই হেফাজতের নির্দেশ হয়েছিল, আসানসোল সিবিআই স্পেশাল কোর্টে রাতভর সায়গলকে জেরা করে সিবিআই। সিবিআই সূত্রে খবর, সায়গলের সম্পত্তি-সম্পর্কিত দলিল, নথি কার কার নামে রয়েছে, সায়গলের কতগুলি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, কোন কোন অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন বা ট্রানজাকশন বেশি হতো, গরু পাচার-কাণ্ডের সময় এনামুল হকের সঙ্গে  কী বিষয়ে ফোনে কথা হয়েছিল তাঁর, এইসব খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।

একথা ঠিক, বিরোধীদের বারবার দমিয়ে দিতে, থামিয়ে দিতে সিবিআই-ইডি জুজু ব্যবহার করেছে কেন্দ্র। এক্ষেত্রেও এই অভিযোগ উঠতে পারত, তবে অনুব্রতর দেহরক্ষীর যে সম্পত্তির খতিয়ান সামনে এসেছে, তাতে যে কেউ ভিরমি খেতে পারেন। আর এক্ষেত্রে মমতার 'আদরের কেষ্টা'-র নাম জড়িয়ে যাওয়ায়, তা যে দিদির পক্ষে অস্বস্তিকর, তা বলাই বাহুল্য।

More Articles