শরীরে কীভাবে ছড়াচ্ছে ক্যানসার? বাঙালি বিজ্ঞানীর আবিষ্কারে তোলপাড় বিশ্ব

Bengali Scientist on Cancer research : ক্যান্সার নিয়ে আমাদের সকলেরই চিন্তার শেষ নেই। সেই রোগের গবেষণাতেই কামাল বঙ্গ তনয়ের...

কোষের বেলাগাম বিভাজনের জন্যে যে ক্যানসার বাড়ে, এ কথা আমাদের মধ্যে অনেকেই জানেন। কিন্তু এই বেলাগাম বিভাজনের পরেও কোষগুলি শরীরের একই জায়গায় আটকে থাকে না। তারা সেই গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে। ঠিক যে ধাপটিকে ক্যানসার বিজ্ঞানের পরিভাষার বলে "মেটাস্ট্যাসিস"।

বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় অবস্থা এবং রোগের কারণে কোষের বাহ্যিক সান্দ্রতার অদল-বদল ঘটতে পারে। কিন্তু কোষের পারিপার্শ্বিক সান্দ্রতা ক্যানসারের পিছনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তা এ যাবৎ কোনও গবেষণাতেই উঠে আসেনি। এমনকী কোষের পার্শ্ববর্তী অংশে কীভাবে সান্দ্রতা বদলাচ্ছে, তা ক্যানসার কোষগুলি কীভাবে বোঝে বা কোন রাসায়নিক বার্তা তার নেপথ্যে কাজ করে, তা-ও অজানাই ছিল।

আরও পড়ুন : ইউয়িংস সারকোমাই প্রাণ কাড়ল লড়াকু ঐন্দ্রিলার! কী উপসর্গ এই মারণ রোগের?

খুব সাম্প্রতিক এক গবেষণায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এবার সেই প্রশ্নের উত্তর দিলেন। পরীক্ষায় উঠে এলো, কোষের বাহ্যিক অংশের সান্দ্রতা কীভাবে কোষকে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে গড়েপিঠে তুলছে। চলতি মাসের শুরুতে গবেষণাটি ‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশিতও হয়েছে। সেই গবেষণায় অন্যতম অংশ হিসেবে যুক্ত রয়েছেন এক বাঙালি গবেষকও।

ড: কনস্ট্যানটিনোস কনস্ট্যানটোপোলস, যাঁর তত্ত্বাবধানে এই গবেষণা, তিনি জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটির একটি প্রেস রিলিজে় জানিয়েছেন, "সুস্থ এবং ক্যানসার আক্রান্ত, এই দুই ধরণের মানুষের শরীরেই কোষ কীভাবে তার পার্শ্ববর্তী তরলের সান্দ্রতার পরিবর্তন বুঝতে পারে, তা আমরা এই গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছি।" গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, যখনই কোষের বাইরে সান্দ্রতা বাড়ছে, তখনই ধীরে ধীরে যান্ত্রিক চাপ বাড়ছে, যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে "মেকানিক্যাল লোডিং"। মেকানিক্যাল লোডিং বাড়লে কোষের ভেতরে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে অ্যাকটিক এবং মায়োসিনের মতো প্রোটিন। এই সেই প্রোটিন যারা আমাদের পেশির গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এবং এই দুই প্রোটিনই কোষের চলনে সাহায্য করে। এরা ছাড়া কোষ প্রায় চলনক্ষমতাহীন।
কোষ যে শরীরের এক অংশ থেকে আরেক অংশে ছড়িয়ে যায়, এই বিষয়টিকে কি আমরা ক্ষতিকর বলবো? তা কিন্তু একেবারেই না। ক্যানসারের ক্ষেত্রে এই ঘটনা নি:সন্দেহে ক্ষতিকর। কিন্তু বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার জন্যে কোষের এই চলন কিন্তু অপরিহার্য। সে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বেড়ে ওঠাই হোক কিংবা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সক্রিয়া রাখা – কোষের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে পৌঁছনো একান্তই আবশ্যক।

আরও পড়ুন : নীরবে এই রোগ প্রাণ কেড়েছে ঐন্দ্রিলার! প্রতি বছর আক্রান্ত দু’কোটি, কীভাবে সতর্ক হবেন

ঠিক কী কী কারণে কোষের বাহ্যিক অংশের সান্দ্রতা বাড়ে? আপাতত আসা যাক সেই প্রসঙ্গে। কোষের আশেপাশের সান্দ্রতা বাড়ার পিছনে বিভিন্ন ধরণের ম্যাক্রো মলিকিউল দায়ী। এবং সেরকমই একটি ম্যাক্রো মলিকিউল হল মিউসিন। এই পেপারের ফার্স্ট অথার, বাঙালি গবেষক ড: কৌস্তভ বেরা ইন্সক্রিপ্টকে একটি ই-মেলে জানিয়েছেন, "রক্তে কোলেস্টেরল বাড়লেও, বাড়তে থাকে কোষের পার্শ্ববর্তী অংশের সান্দ্রতা"। নিত্যদিনের অভ্যাসজনিত কারণে বাড়ে কোলেস্টেরল। রক্তে কোলেস্টেরল বাড়ার পিছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে - যার মধ্যে খাদ্যাভাস তো দায়ী বটেই, তার পাশাপাশি দায়ী আমরা শরীরকে কতটা সচল রাখছি তা-ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর কোলেস্টেরল বাড়লে যে রক্তের সান্দ্রতা বাড়ে এই কথা বিভিন্ন গবেষণায় আগেই প্রমাণিত হয়েছে।
তবে কেবল ফ্যাট-সমৃদ্ধ খাবার নয় বা নিজের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস নয়, টিউমার কলা বাড়তে বাড়তে যখন লিম্ফ্যাটিক নালিগুলির পথ প্রায় বন্ধ করে ফেলে, তখনও কোষের পার্শ্ববর্তী তরলে ম্যাক্রো মলিকিউলের ঘনত্ব বাড়তে পারে। যার অবশ্যম্ভাবী প্রভাবে বাড়তে থাকে সেই তরলের সান্দ্রতা। টিউমারের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বা টিউমার মাইক্রো-এনভায়রনমেন্টে থাকা কোষের বাইরের ধাত্র বা ম্যাট্রিক্সও খুব দ্রুত নষ্ট হয়। আবার তার ফলেও কোষের বাইরের তরলে মেশে বিভিন্ন ম্যাক্রো মলিকিউল।
যদিও আগের বেশ কিছু গবেষণায় দেখানো হয়েছিল, কোষের সান্দ্রতা বাড়তে থাকলে ক্যান্সার কোষ তো বটেই, স্বাভাবিক কোষেরও চলনক্ষমতা বাড়ে।

আরও পড়ুন : শুধু স্বাদে নয়, গুণেও ফলের রাজা তাল! ক্যানসার থেকে দৃষ্টিশক্তি সারিয়ে তুলতে রোজ খেতেই হবে

নতুন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, কোষের বাইরের সান্দ্রতা বাড়লে কোষ ফুলতে শুরু করে। শুধু তাই নয়, কোষপর্দায় টানও পড়ে। অ্যাকটিন প্রোটিনের নেটওয়ার্ক বা আন্তর্জাল আরও মজবুত হয়। দেখা যাচ্ছে, এই অ্যাক্টিন প্রোটিনই আদতে কোষের পার্শ্ববর্তী সান্দ্রতার পরিবর্তনকে বুঝতে কোষকে সাহায্য করে। গবেষণার সময় মাইক্রোস্কোপে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যাচ্ছে, ক্যানসার কোষের আশেপাশে সান্দ্রতা বাড়তেই অ্যাকটিক প্রোটিনের অন্তর্জাল কেবল মজবুতই হচ্ছে না, প্রোটিনগুলি নিজেদেরকে আবার নতুন করে সাজিয়েও নিয়েছে। যাতে তারা দেহের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে পারে। অ্যাকটিন প্রোটিনগুলি নতুন ভাবে সেজে ওঠার ফলেফলে ধাপে ধাপে একাধিক প্রক্রিয়ার কোষের ভেতরে বাড়তে থাকে ক্যালসিয়াম আয়নের প্রবেশ। আর তাতেই কোষগুলির চলন ক্ষমতা বাড়ে। ক্যানসার কোষগুলি শরীরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে পারে এ ভাবেই।

আরও পড়ুন : চোখে অন্ধকার, হাত পা অসাড়, রোজের জীবনেই লুকিয়ে ব্রেন স্ট্রোকের ফাঁদ! সতর্ক হবেন কীভাবে?

"যে সমস্ত কোষ আগেভাগেই বেশি সান্দ্রতার সম্মুখীন হয়েছে, তারা যেন এক ধরণের স্মৃতি গঠন করে রেখেছে নিজেদের মধ্যে, তারাই যেন শরীরে বেশি দূর ছড়িয়ে পড়তে পারছে", জানাচ্ছেন ড: কনস্ট্যানটোপোলস। দেখা যাচ্ছে, কোষের চারপাশে সান্দ্রতা যত বাড়ছে, তত বাড়ছে যান্ত্রিক চাপ। তখন কোষও যেন সেই চাপকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে অনবরত। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শক্তিশালী হচ্ছে অ্যাক্টিন প্রোটিনের আন্তর্জালিকা। অ্যাক্টিন প্রোটিনের আন্তর্জালিকা শক্তিশালী হলে স্বাভাবিক ভাবেই কোষের চলন ক্ষমতা বাড়তে থাকবে।

নেচারে প্রকাশিত গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ড: সালমা সেরা জন্স হপকিন্সের একটি প্রেস রিলিজে় জানালেন, "এ যেন ক্যানসার কোষগুলির জিমে গিয়ে পেশিশক্তি বাড়ানোর মতো। যে সমস্ত কোষ আগে থেকেই মেকানিক্যাল প্রেশারের বিরুদ্ধে লড়ছিল, তাদের মধ্যে পেশির (পড়ুন অ্যাকটিন ও মায়োসিনের মতো প্রোটিন) বৃদ্ধি ঘটেছে অপেক্ষাকৃত বেশি হারে। তারাই যেন শরীরে বেশি দূর ছড়িয়ে পড়তে পেরেছে।"

 

 

তথ্যসূত্র-

Extracellular fluid viscosity enhances cell migration and cancer dissemination (https://www.nature.com/articles/s41586-022-05394-6)

More Articles