চোখে অন্ধকার, হাত পা অসাড়, রোজের জীবনেই লুকিয়ে ব্রেন স্ট্রোকের ফাঁদ! সতর্ক হবেন কীভাবে?

Brain Stroke Treatment: আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ১৮ লক্ষ মানুষ ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন। পৃথিবীর প্রেক্ষিতে এই সংখ্যাটা ১ কোটির কিছু বেশি। এদের মধ্যে ৬৫ লক্ষ মানুষ সঠিক সময়ে চিকিৎসার অভাবে মারা যান।

আপনি কি ধূমপান করেন? ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় আছে? অবসাদে ভুগছেন? তা হলে সাবধান থাকুন। কারণ বিশেষজ্ঞদের মতে এগুলি স্ট্রোক বা ব্রেন স্ট্রোকের আশঙ্কা অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়। ‘টাইম ইজ ব্রেন’। হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন, টাকার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মস্তিষ্ককে ঠিক রাখতে স্ট্রোকের লক্ষণগুলি সম্পর্কে অবগত থাকুন। নাহলে আপনার এক সেকেন্ডের অবহেলাই ডেকে আনতে পারে মৃত্যু। হঠাৎ দেখছেন কথা বলতে বলতে আচমকা জিভ অবশ হয়ে গেল, হাত তুলে বোঝানোর চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলেন হাত তোলাও অসম্ভব। চোখের সামনে নেমে এক কালো পর্দা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার সব আগের মতোই স্বাভাবিক। তাই সে যাত্রায় ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা মাথাতেই এল না। রোজের ব্যস্ততায় ধীরে ধীরে থিতিয়ে যেতে শুরু করল এই ঘটনা। কয়েকমাস পরে এক বড়সড় স্ট্রোকের ধাক্কায় একেবারে যমে-মানুষে টানাটানি!

কয়েক মিনিট এরকম কথা বলতে না পারা, হাত বা পা অসাড় হয়ে যাওয়া অথবা চোখে অন্ধকার দেখার মতো ঘটনাকে চিকিৎসার পরিভাষায় বলে ‘ট্র্যানসিয়েন্ট ইসকিমিক অ্যাটাক’ বা ‘টিআইএ’। সাধারণভাবে একে ‘মিনি স্ট্রোক’ বলা যায়। এই সময়ে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ না নিলে কিছু দিনের মধ্যেই বড়সড় ব্রেন স্ট্রোকের আশঙ্কা থাকে। আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ১৮ লক্ষ মানুষ ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন। পৃথিবীর প্রেক্ষিতে এই সংখ্যাটা ১ কোটির কিছু বেশি। এদের মধ্যে ৬৫ লক্ষ মানুষ সঠিক সময়ে চিকিৎসার অভাবে মারা যান। ‘সোসাইটি ফর থেরাপিউটিক নিউরো-ইন্টারভেনশন’-এর (STNI-2020) এক সম্মেলনে এমন নানা তথ্য জানালেন দেশ-বিদেশের বহু খ্যাতনামা নিউরো রেডিওলজিস্ট, নিউরো ইন্টারভেনশনিস্ট এবং নিউরো সার্জনদের টিম। স্ট্রোক-সহ মস্তিষ্কের নানা জটিল অসুখের চিকিৎসায় ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি ইদানিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশনের এক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, ভারতের গ্রামাঞ্চলে ইদানিং ব্রেন স্ট্রোকে মৃত্যুর হার হু হু করে বাড়ছে। গ্রামাঞ্চলের ১ লক্ষ মানুষের মধ্যে ২১০ জন স্ট্রোক আক্রান্ত চিকিৎসার অভাবে মারা যান। দিল্লিতে আয়োজিত তিন দিনের এক সম্মেলনে আন্তর্জাতিক স্নায়ু বিশেষজ্ঞরা জানান, ভারতে ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া রোগীর মধ্যে ২০ শতাংশের বয়স ৪০ বছরের নীচে। এ দেশে বাড়তে থাকা ধূমপানের অভ্যাস, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাইপার টেনশনের মতো সমস্যাকেই দায়ী করেছেন চিকিৎসকরা। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রতি বছর ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। সংখ্যাটা সত্যিই চমকে ওঠার মতো।

কিন্তু এই স্ট্রোক আসলে কী?

সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যে আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে, এমনকী মস্তিষ্কের কোষেও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত সঞ্চালন প্রয়োজন। কোনও কারণে মস্তিষ্কের রক্তবাহী ধমনীর পথ সংকীর্ণ হয়ে বা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রক্ত চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলে মস্তিষ্কের কোষ অক্সিজেনের অভাবে নিস্তেজ হয়ে যায়। একেই চিকিৎসকেরা স্ট্রোক বলেন।

স্ট্রোক মূলত দু’রকম। ইস্কেমিক স্ট্রোক এবং হেমোরেজিক স্ট্রোক। ইস্কেমিক স্ট্রোক তখনই হয়, যখন মস্তিষ্কে অজান্তেই রক্ত জমাট বাঁধে এবং সেখান থেকে ধমনীর পথ আরও বেশি সংকীর্ণ হয়ে যায়। হেমোরেজিক স্ট্রোক হল, হঠাৎ ধমনী থেকে মস্তিষ্কে রক্তপাত হতে শুরু করে এবং মস্তিষ্কের কাজ বাধা পায়। এছাড়াও কোনও কারণে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে সেখান থেকেও স্ট্রোকের সম্ভাবনা থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্ট্রোকের মূল ধরন হল ইস্কেমিক স্ট্রোক। এই ধরনের স্ট্রোকই ৮৭ শতাংশ। স্ট্রোক হল ইমার্জেন্সি। এই রোগে আক্রান্ত হলে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন চিকিৎসার। এক্ষেত্রে চিকিৎসায় দেরি হলে মৃত্যুর আশঙ্কা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

আরও পড়ুন- ঘরে ঘরে শিশুদের শরীরেও হানা দিচ্ছে এই ঘাতক ডায়াবেটিস! কীভাবে লক্ষণ চিনবেন

ইস্কেমিক স্ট্রোকের প্রধান লক্ষণ

ইস্কোমিক স্টোক হল একটি প্রাণঘাতী অবস্থা। তাই এই অবস্থায় স্ট্রোকের লক্ষণ চিনে রেখে সোজা চিকিৎসকের কাছে পৌঁছে যাওয়া খুবই জরুরি। এই লক্ষণগুলি দেখলেই সাবধান-

১. চোখের সমস্যা। দেখতে অসুবিধা হয়।

২. শরীরের একদিকে প্যারালাইসিস হয়ে যেতে পারে।

৩. মাথা ঘোরা।

৪. কিছু বুঝতে না পারা।

৫. হাত অসাড়ের লক্ষণ।

ইস্কেমিক স্ট্রোকের অন্যতম লক্ষণ হল হাতের প্যারালাইসিস। এক্ষেত্রে স্ট্রোকের কিছুক্ষণ আগে থেকেই এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকী ব্যক্তির শরীরে এই লক্ষণ দেখা দিতে পারে কয়েকঘণ্টা বা কয়েকদিন আগেও। এক্ষেত্রে হাতে ব্যথা থাকার কারণে হাত তোলা সম্ভব হয় না। শরীরে যে কোনও দিকের হাতে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।

স্ট্রোক বুঝবেন কীভাবে

যদি কথা বলতে বলতে আচমকা জিভ অসাড় হয়ে যায় অথবা অল্প সময়ের জন্যে চোখে অন্ধকার দেখেন অর্থাৎ ব্ল্যাক আউট হয়, কাজ করতে করতে হাত-পা বা শরীরের কোনও একদিক হঠাৎ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়, অথবা চোখে দেখতে সমস্যা হয়, ঝাপছা দৃষ্টি বা ডাবল ভিশন হয়, কথা বলতে অসুবিধে হয় অথবা ঢোঁক গেলা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়, মুখ থেকে লালা বেরোতে থাকে অথবা সম্পূর্ণ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় রোগী।

স্ট্রোক হওয়ার কারণ

১. যাদের রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি তাদের স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেশি। মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ। বিশেষ করে অনিয়ন্ত্রিত ব্লাড প্রেশার থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।

২. স্ট্রেস ও ডিপ্রেশন সহ অন্যান্য মানসিক সমস্যা থাকলেও এই সমস্যার সম্ভাবনা থাকে।

৩. পুষ্টিকর খাবারের পরিবর্তে ভাজাভুজি, ফার্স্ট ফুড বেশি খেলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। ধূমপানের ফলে অন্যান্য অনেক অসুখের সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রোকের ঝুঁকিও অনেকটাই বেড়ে যায়। নিয়মিত অতিরিক্ত মদ্যপানের অভ্যাস স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

৪. যাঁরা ডায়াবেটিসে ভুগছেন এবং তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডায়েট বা এক্সারসাইজ করেন না, তাঁদেরও স্ট্রোকের সম্ভাবনা অনেক বেশি। হার্টের অসুখ থাকলে ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি।

স্ট্রোকের চিকিৎসা ও গোল্ডেন আওয়ার

মাথা ব্যথা বা অ্যাসিডিটির মতো সেলফ মেডিকেশন আমাদের মজ্জাগত। কিন্তু টিআইএ বা স্ট্রোকের ক্ষেত্রে এটা-ওটা করতে গিয়ে সময় নষ্ট করলেই মহা বিপদ। প্রাণে বাঁচার সম্ভাবনা ক্রমশ কমে যায় তো বটেই, সেইসঙ্গে প্রাণে বাঁচলেও জবুথবু হয়ে পড়ে থাকার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই স্ট্রোকের লক্ষণ দেখলেই যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা প্রয়োজন। স্ট্রোক হওয়ার পর সাড়ে চার ঘণ্টা হল গোল্ডেন আওয়ার। এর মধ্যে ইন্টারভেনশন পদ্ধতির সাহায্যে মস্তিষ্কের রক্তবাহী ধমনীর রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক করে দিতে পারলে রোগীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সময় লাগে না। কিন্তু দেরি হলেই বিপদ। আর এই কারণেই চিকিৎসকরা বলেন, ‘টাইম ইজ ব্রেন’। চিকিৎসায় দেরি হলে প্যারালিসিস হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ে। সুতরাং স্ট্রোকের লক্ষণ দেখলেই হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া উচিত।

কারা সাবধান হবেন?

উচ্চ রক্তচাপের রোগী, ধূমপান, জর্দা, গুটখা, খৈনি খান এমন ব্যক্তি, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরলের রোগী, হার্টের অসুখে ভোগা ব্যক্তি, স্থূলত্ব বা ওবেসিটিতে আক্রান্ত মানুষ, স্ট্রেসে ভোগেন এমন ব্যক্তি, অত্যধিক মানসিক চাপ, পরিবারে স্ট্রোকের ইতিহাস আছে এমন ব্যক্তির স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

আরও পড়ুন- একাদশ শ্রেণিতে ক্যান্সার, ফুসফুসে ১৯ সেমির টিউমার! ঐন্দ্রিলা আসলে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা!

স্ট্রোক প্রতিরোধ

ব্লাড প্রেশার ১২০/৮০ রাখার চেষ্টা করতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ থাকলে কাঁচা নুন খাবেন না। রক্তচাপ না থাকলেও দিনে তিন গ্রামের বেশি নুন খাওয়া চলবে না। ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখুন। রক্তে বেশি কোলেস্টেরলে থাকলে কমান। ওজন বেশি থাকলে কমান। নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। রেড মিট খাবেন না। মিষ্টি, তেল, ঘি কম খাওয়াই ভালো। সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, খৈনি ইত্যাদি তামাকজাত দ্রব্য ত্যাগ করুন। মদ্যপান ছাড়তে হবে। হার্টের অসুখ থাকলে, আগে স্ট্রোক হয়ে থাকলে থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ খান।

বিশ্ব জুড়েই বাড়ছে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা। বছরে প্রায় ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয় এই স্ট্রোক থেকে। বিশ্ব জুড়ে বছরে স্ট্রোকে আক্রান্ত হন ১৪ কোটি। এখনই সচেতন না হলে স্ট্রোকে মৃত্যুর সংখ্যা পরের বছর দাঁড়াতে পারে ৭ কোটিতে। আমেরিকান স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশন বলছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় স্ট্রোকের ঝুঁকিও। এক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে আমাদেরকেই। ৫৫ বছর বয়সের পর প্রতিটি মানুষের মধ্যেই বাড়ে স্ট্রোকের সম্ভাবনা। এবং প্রতি ১০ বছর অন্তর সেই ঝুঁকি বাড়তেই থাকে। তবে প্রি-স্ট্রোকের ক্ষেত্রে বেশ কিছু উপসর্গও থাকে। মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমতে শুরু করলে একাধিক লক্ষণও দেখা দেয়। তবে যেভাবে লক্ষণ প্রকাশ পায় তাতে স্ট্রোক মনে হলেও তা কিন্তু ২৪ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয় না। ব্রেন অ্যাটাকই স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় লক্ষণ।

খুব কম বয়সীরাও আজকাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে। এর জন্যও কিন্তু দায়ী জীবনযাত্রা। অতিরিক্ত উচ্চাশা, মানসিক চাপ, হতাশা, শরীরের উপর অত্যাচার, ঠিক সময়ে ঘুম-খাওয়া দাওয়া না করা, মাত্রাতিরিক্ত ধূমপান, মদ্যপান বাড়িয়ে দেয় স্ট্রোকের সম্ভাবনা। কারও পারিবারিক ইতিহাসে স্ট্রোকের সমস্যা থাকলে সেখান থেকেও আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই সাবধান হোন। সুষম খাবার খান এবং সুস্থ থাকুন।

More Articles